
মানুষের অন্যান্য প্রাণী হতে আলাদা হয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল ভাষা। ভাষা মানুষকে সামাজিকভাবে সংযুক্ত হতে সাহায্য করে। সেটি কীভাবে? হারারি এ সম্বন্ধে একটি মজার তথ্য দিয়েছেন।
তিনি বলছেন, পরচর্চা খুবই উপকারী সামাজিক গুণ হিসেবে কথিত জ্ঞানবিপ্লবের যুগে আবির্ভূত হয়েছিল। মানুষ তথ্য সংগ্রহ এবং সঞ্চালন করতো ভাষার মাধ্যমে। সামাজিক সম্পর্ক ভাগাভাগি করতো পরচর্চার মাধ্যমে!
আরেকটি বড় গুণ মানুষের সভ্যতাকে অনেক দূর নিয়ে এসেছে। সেটি হলো, মানুষের গল্প বানানো এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে সেগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বলে যাওয়ার ক্ষমতা।
বর্তমানে কাল্পনিক বাস্তবতা পার্থিব বাস্তবতার ওপর রাজত্ব করছে। এরকম একটি কাল্পনিক বাস্তবতার উদাহরণ দিয়েছেন হারারি: টাকা। একটি বিশেষ কাগজ, যার বস্তুগত মূল্য খুব বেশি নয়। কিন্তু আমরা এর উপর একটি কাল্পনিক মূল্য আরোপ করেছি। যার ফলে একটি সাধারণ কাগজ ‘টাকা’ হয়ে উঠেছে।
টাকার মতো এমন বহু জিনিস আমরা নিজেদের মধ্যে একটি সাধারণ গল্পে বিশ্বাসী হয়ে নির্মাণ করেছি, যার কাল্পনিক মূল্য তার বস্তুগত উপযোগকে বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে।
মানুষ একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে ছোট থেকে বড় গোষ্ঠী এবং ধীরে ধীরে একসময় সাম্রাজ্য পর্যন্ত নির্মাণ করেছে। কীভাবে? বিভিন্ন মুখরোচক কিন্তু কার্যকরী গল্পে বিশ্বাস করে! কার্যকরী এই কারণে যে, এমন অভিনব বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা মানুষের আরেকটি প্রজাতি হোমো নিয়ান্ডার্থালনেসিসের ছিল না। আর ছিল না বলেই মানুষের চেয়ে শক্তিশালী এবং বিভিন্ন দিক দিয়ে অধিকতর বুদ্ধিমান হয়েও মানুষের মতো জগতের কর্তৃত্ব হাতে নিতে পারেনি তারা। এটি পুরোদস্তুর একটি সামাজিক গুণ।
মানুষের এই গল্প বলার ক্ষমতা এবং কল্পনাশক্তিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এর সরাসরি ফল হলো, মানুষের সমাজের বিশাল আয়তন এবং এর গঠনের জটিলতা। প্রাচীন অনেক মানুষ যখন একই স্থানীয় দেবতায় বিশ্বাস করে, তখন তারা এক অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার দ্বারা একসূত্রে আবদ্ধ হয়ে সহজেই যেকোনো বন্যপ্রাণীর চেয়ে বড় এবং সুশৃঙ্খল দল গঠন করতে পারে।
এমন একটি সামাজিকভাবে সুসংবদ্ধ এবং তুলনামূলক বৃহৎ দল বা গোষ্ঠী নিয়ে স্যাপিয়েন্সরা ইতিহাসজুড়ে কী কী ঘটনা, অঘটন এবং দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বেড়িয়েছে, তারই একটি বয়ান হলো ‘স্যাপিয়েন্স’। বেশিরভাগই জানা গল্প। কিন্তু ‘কেন’ এবং ‘কীভাবে’র উত্তর হারারির এই ‘গল্পতত্ত্ব'র মতোই নতুন।
জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক তিনি। তবে স্যাপিয়েন্স গতানুগতিক ইতিহাসের বই নয়। লেখক ইতিহাসের সাথে বির্বতনের জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং সর্বোপরি দার্শনিকতা মিশিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ করিয়েছেন। মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বিপ্লব এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে মিলিয়ে চারটি মূল অধ্যায়ে বই বিন্যস্ত হয়েছে।
মানব প্রজাতির প্রথম বিপ্লব ছিল 'জ্ঞান বিপ্লব'। যার অন্যতম উপাদান ছিল ভাষা আবিষ্কার, কল্পনা করতে পারার সক্ষমতা এবং গল্প, বিভিন্ন মিথ ও বিশ্বাসের অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী সূতা দিয়ে প্রচুর মানুষকে বেঁধে ফেলা।
মানুষের শুরু হয়েছিল জীবজগতের এক খুবই নগণ্য দুর্বল প্রাণী হিসেবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সবকিছুকে জয় করে মানুষ ভবিষ্যতে যে ঈশ্বর হতে চলেছে, এই ভ্রমণকে হারারি শুধু অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো নির্লিপ্ত বর্ণনা করেই ক্ষান্ত দেননি, নিয়মিত বিজ্ঞানসম্মত এবং দার্শনিক মূল্যায়ন করে গেছেন। প্রশ্ন করে গেছেন, যেটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিহাসজুড়ে স্যাপিয়েন্সদের এই অসাধারণ উত্থান অবশ্যই হারারির বর্ণনাভঙ্গির চেয়েও বেশি আকর্ষণীয়, বিস্ময়কর। এই ভ্রমণের সাক্ষী হওয়া, হারারির সাথে, সৌভাগ্যজনক বলতে হয়। বর্তমানের সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বুদ্ধিজীবীর সাথে অবশ্যই আমাদের পরিচয় ঘটা দরকার।
জানা থাকা দরকার ইতিহাসে ন্যায়বিচার বলে কিছু আছে কি না, এতদিনের উদযাপিত কৃষিবিপ্লব কীভাবে স্যাপিয়েন্সদের ফাঁদে ফেলেছে, কীভাবে মধ্য এবং আধুনিক যুগের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক মিথগুলো অসংখ্য মানুষকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে।
খুবই কিঞ্চিতকর বলে আপাতভাবে মনে হতে পারে- এমন কোনো বিষয়ে ইতিহাস পরিবর্তনের বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে। হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানুষের ভ্রমণের পদচিহ্ন এত গভীর আর গাঢ় করে এই গ্রহের বুকে ছাপ ফেলে গেছে যে, মানুষের ইতিহাস পৃথিবীর স্থলজ সকল প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যকে এবং পৃথিবীর পুরো বাস্তুতন্ত্রকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
বহুল আলোচিত বিষয়ের আলোচনা তো আছেই, সাথে অনালোচিত ইতিহাস এবং ইতিহাস অবলোকনের মানবকেন্দ্রিক ন্যারেটিভ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে।
খাদ্য সংগ্রাহক পর্ব পার করে কৃষি বিপ্লব, পরবর্তীতে শিল্প বিপ্লব এবং আরো পরের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিপ্লব পাড়ি দিয়ে এসে মানুষ যখন দ্রুত পরিবর্তনশীল বর্তমান এবং অজানা ভবিষ্যতের রূপরেখা আঁকছে, হারারি তখন স্যাপিয়েন্স-এ আধুনিক মানুষের আমলনামার মতো অতীত উল্টেপাল্টে বিশ্লেষণ করে দেখছেন।
অতীতের অশোধনযোগ্য ভুল থেকে যতটা শিক্ষা নেওয়া যায়, মানুষের ভবিষ্যৎ যে পথে যাচ্ছে তার অল্পখানিক রূপরেখা নির্ণয়ের প্রচেষ্টা, মানুষের ইতিহাসের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লবের ফলশ্রুতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে সাবলীলভাবে।
বিশ্বাসযোগ্যভাবে লেখক মানুষকে ইতিহাসের প্রাচীন ও মধ্যযুগের বিভিন্ন বিখ্যাত সাম্রাজ্যগুলোর সামন্ততন্ত্রের মধ্যে দিয়ে চরিয়ে নিয়ে এসে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের বৈশ্বিক বাজারের ছোট ছোট গ্রহীতাদলে এবং আরো ছোট টুকরো ব্যক্তিতে ভেঙেছেন।
হারারি মানুষের ইতিহাসকে জীববিজ্ঞান এবং প্রাসঙ্গিক আরো কিছু শৃঙ্খলাবিদ্যার যন্ত্র ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রচুর পরিমাণে তথ্য উপাত্ত নিয়ে মানচিত্রের বিভিন্ন বিচিত্র কোনায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে একটি পরিশ্রমী এবং পরবর্তীতে জনপ্রিয় ও অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে প্রসঙ্গক্রমে আলোচনা ও বিশ্লেষণের পর মোটাদাগে তার নিজস্ব মত খুঁজতে গেলে হতাশ হতে হবে। তিনি খুব কমই স্পষ্টভাবে কোনো প্রচলিত মত বা পথের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করেছেন। বিভিন্ন ধারণা, ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা এবং মোড়ের ব্যাপারে যৌক্তিক আলোকপাতের পর তিনি প্রায় সময় তার সিদ্ধান্ত নামিয়েছেন, যা পাঠকের কাছে নতুন কিন্তু অনিবার্য মনে হতে পারে।
ইতিহাসের বড় বড় ঘটনাগুলো যেখানে মূল্যায়নের সময় নিজগুণে বিতর্কিত, সেখানে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে গেলে বাতাসে জাল বুনতে হয়। তারপরেও মানুষের অদম্য জ্ঞানস্পৃহাকে ধন্যবাদ।
মানুষের অতীত জানার আগ্রহ শুধু জানার তাগিদে হলেও ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্যে তা উপকারী বিবেচিত হতে পারে। ইতিহাস যেখানে ব্যর্থ, সেখানে বিজ্ঞান একটা সম্ভাবনা হাজির করে।
পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন গুহায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষ এবং নানা প্রাণীর উদ্ধারকৃত ফসিল থেকে নানা তথ্য হাজির হয়। সেসব তথ্যের ওপর ভর করে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী ধারণা আমরা গড়ে উঠতে দেখি। এই ধারণাগুলোর মধ্যে ভারসাম্যমূলক একটা আলোচনার চেষ্টা করেছেন হারারি।
বিজ্ঞানের যুগে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে নিশ্চিত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়ে অভ্যস্ত। এই অভ্যাসে ধাক্কা খেতে হয় ইতিহাস, দর্শন এবং ধর্মের মতো মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখায় আলোচনার অগ্রগতিতে। বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক, পরস্পরবিরোধী মতামতের উপস্থিতি ইত্যাদি এসকল শৃঙ্খলাবিদ্যার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
এইসব ক্ষেত্রে অনেক সময় সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ে সিদ্ধান্তহীনতার দার্শনিক অস্বস্তিতে পড়তে হয়। তার উপর যখন হারারি প্রায়ই ঘুরেফিরে বিভিন্ন অধ্যায়ে একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন যে, মানুষের সুখের পরিমাণ উপর্যুপরি বেড়েছে না কমেছে, তখন বিষয়টা জটিল হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে হয়।
কিন্তু জটিলতাগুলোকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে লেখক হারারির ভূমিকা অসামান্য। তিনি অকাট্য যুক্তি-তর্ক দিয়ে বারবার নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে পেরেছেন এবং মানুষের ইতিহাসের বিভিন্ন ধোঁয়াশাকেও পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন।
আধুনিক সময়ে বিজ্ঞানের প্রভাব মানববিদ্যার বিভিন্ন শাখায় পড়েছে। ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে হারারি সেই ধারারই সর্বশেষ সংস্করণ। তিনি ইতিহাস আলোচনার ধারায় মূল্যায়নমূলক, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণনির্ভর এবং প্রয়োজনীয় দার্শনিক আলাপের যোগান দিতে চেয়েছেন।
মানুষের ইতিহাসে গল্পকথকদের ভূমিকা অপরিসীম। বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক গল্পগুলো যখন বিশাল সংখ্যক মানুষ একইসাথে সত্য বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে, তখন মানুষের এক বিশাল গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। একটি সমাজ এভাবে গঠিত হয় এবং মানুষ সামাজিক জীবন শুরু করতে পারে। তাই পুরোনো সমাজকাঠামোতে আঘাত করা নতুন ধারণাগুলো সবসময় বৈপ্লবিক হিসেবে চিহ্নিত হয়।
হারারি একটি অস্বস্তিকর সত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন। মানুষের সমস্ত প্রথা-প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এমনকি নৈতিক ধারণা এবং বিভিন্ন অধিকারগুলোও স্রেফ তাদের সম্মিলিত বিশ্বাসের ফসল।
এগুলো মানুষের সম্মিলিত কল্পনার মধ্যে সত্য হয়ে মানুষকে প্রায় সত্তর হাজার বছর ধরে প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধে ছোট ছোট খন্ডযুদ্ধে ক্রমাগত জয়ী হতে হতে মানুষকে স্বঘোষিত 'সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী'তে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করেছে।
ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোর নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন বিভিন্ন সময়ে সহজে বোঝার জন্য ছক এবং ডায়াগ্রাম আকারেও দেওয়া হয়েছে। প্রথম পড়া ইংরেজি বই হলেও বুঝতে অসুবিধা হয়নি শুধুমাত্র হারারির সহজবোধ্য ভাষা, দারুণ বর্ণনাভঙ্গী এবং বিষয়বস্তুর আকর্ষণে। এমন একটি পরিচ্ছন্ন চমৎকার যুগান্তকারী বই আগে কখনো পড়া হয়নি।
বইয়ের নাম: স্যাপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড || লেখক: ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি
প্রকাশক: ভিন্টেজ বুকস্ || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম
This is a Bangla article. It is a review of the book 'Sapiens: A Brief History of Humankind' written by Yuval Noah Harari.
Featured Image: A Good Reed Review