'৭০ এর মাঝামাঝি। মিশিগানের সেই শহরতলী। স্বপ্নিল অনুভূতি ঘেরা এক শহরতলী। গাছ-গাছালিতে ভরা। পাখিদের মুক্ত গুঞ্জন যেন প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে চারপাশটায়। কেউ পরিষ্কার করছে বাড়ির সামনের লন, কেউবা বসে রয়েছে রোয়াকে। গল্পের কথক শুধু তার হয়ে বলছে না এই গল্প। বলছে তার 'ব্রাদারহুড ক্লাব'-এর বাকি সকলের হয়ে। কথকের বাড়ির ঠিক উল্টো পাশটায় লিসবন বোনেদের বাড়ি। মাঝেমাঝে পাঁচ বোন মিলে গা এলিয়ে বাড়ির সামনের ঘাসের সেই বিছানায়। কথক আর বন্ধুগণ বিমোহিত হয়ে দেখে তাদের।
তবে তাদের নম্রমধুর ভালোলাগার গল্প এটি নয়। লিসবন বোনেদের নাম আর বয়স কথকের মুখ হতে জানার পর, দর্শক এও জানতে পারে বোনেদের মাঝে সর্বকনিষ্ঠ সিসিলিয়াই (১৩ বছর) সর্বপ্রথম আত্মহত্যা করেছিল। গাঢ় নীল রঙ মাখা ফ্রেমে বাথটাবে দু'হাত পাশে ছড়িয়ে চোখ মুদে শুয়ে আছে সিসিলিয়া, আর না ওঠার পণ নিয়ে। বাথটাব হতে মেডিকেল টিমের দু'জন মিলে ধরাধরি করে তার শীর্ণকায় দেহটি যখন বয়ে নিচ্ছিল, সকলের অলক্ষ্যে তার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে যায় একটি কার্ড। ভার্জিন মেরির কোলে ছোট্ট যীশুর ছবি সেই কার্ড। প্রারম্ভিক দৃশ্যের স্বপ্নিল আনন্দে ভরে ওঠা চোখ দুটোর অভিব্যক্তি মুহূর্তেই করুণ হয়ে ওঠে স্ট্রেচারে উঠিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে চলা সিসিলিয়াকে দেখে।
সিনেমার নামটিই অন্তিম পরিণতির আভাস দেয়। বাকিটুকুও গল্পকথক নিশ্চিত করেন প্রারম্ভিক দৃশ্যে। গল্পকথক সেই '৭০ এর সময়ে বসে নয়, এই সময়ে বসে বলছেন সেই গল্প। লিসবন বোনেদের আত্মহত্যা তখনো যেমন ছিল রহস্যে ঘেরা, আজো তেমন।
তবে কেন এই গল্প বলা? কারণ শহরতলীর বাকি সবাই ভুলে গেলেও, কথক আর তার বন্ধুরা আজো ভোলেনি লিসবন বোনেদের। মাঝে কেটেছে অনেক সময়। কিন্তু লিসবন বোনেদের মোহাবিষ্ট জাল ছিঁড়ে আজো বেরুতে পারেনি তারা। হয়তো আত্মহত্যার কোনো কারণ জানতে না পারাতেই গোটা ঘটনাটায় আজো এতখানি আচ্ছন্ন হয়ে আছে তারা। কেন করেছিল লিসবন বোনেরা আত্মহত্যা? ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭- এই ছিল তাদের বয়স। গোটা জীবনটাই তো পড়ে ছিল তাদের। পাদ্রী যখন সিসিলিয়াকে সে কথা বোঝাচ্ছিল, স্থিরভাবে তাকিয়ে সিসিলিয়া বললো, "স্পষ্টত, আপনি কখনো ১৩ বছর বয়সী মেয়ে ছিলেন না" তবে? অথচ এমন নয় যে, তারা পিতামাতা দ্বারা অত্যাচারিত হতো। হ্যাঁ, মা'টার শাসনের অভ্যাস ছিল। সে তো সব মায়েদেরই থাকে।
তবে রক্ষণাত্মক ছিল বেশ। কিশোরী থেকে তরুণী ধাপে পদার্পণ করতে গিয়ে প্রথম ভালোবাসা আর যৌনতার আবিষ্কার করে মেয়েরা। এই বয়সের স্বাভাবিক ছাপ। মা তাই তটস্থ থাকতেন এসব নিয়ে। এই বয়সের দোষগুলো যাতে তার মেয়েদের ছুঁতে না পারে, তাই যতখানি সম্ভব বাকি দুনিয়া হতে তাদের বিচ্ছিন্ন রাখতে চাইতেন। সাথে ধর্মীয় অনুশাসন তো আছেই। বাবা পড়ে থাকতেন নিজ জগতে। সিসিলিয়ার মারা যাওয়ার পরে একসময় তো বাকি চার বোনের ঘর হতে বের হওয়াও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চার দেয়ালেই সারাদিন বন্দী থাকতো চার বোন। তবে কি মুক্তির পথটা তারা আত্মহত্যার মাধ্যমেই খুঁজে নিয়েছিল?
সবকিছুই সম্ভাবনা। সত্যটা তাদের মৃতদেহের সাথেই মাটিচাপা পড়েছে। ভেতরের অবস্থা জানতে পারে না দর্শকরাও। কারণ এই গোটা গল্পই যে কথকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছে দর্শক। চার দেয়ালের মাঝে জমা পড়ে থাকা অনুচ্চারিত কথাগুলো, ওভাবেই থেকে যায়। কথক আর তার বন্ধুদের মতো দর্শকের মনে শুধু টুকরো স্মৃতি, রঙিন কল্পনা আর কৌতূহলের পাহাড় জমা পড়ে রয়।
পরিচালক সোফিয়া কপোলা (লস্ট ইন ট্রান্সলেশন, দ্য বিগাইল্ড, ম্যারি আন্টইনেত)-র অভিষেক সিনেমা এটি (দ্য ভার্জিন সুইসাইডস)। মাস্টার পরিচালক ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার মেয়ে তিনি। তাই বলা যায়, চলচ্চিত্রে নিয়ে শিক্ষাদানে শ্রেষ্ঠ শিক্ষককেই পাশে পেয়েছেন। তাও একেবারে আপনজনে। বৃথা যায়নি তার শিক্ষা। তবে বাবার ছায়াতলে নয়, সোফিয়া কপোলার নিজস্ব দক্ষতা প্রমাণে একটি লস্ট ইন ট্রান্সলেশন (২০০৩)-ই যথেষ্ট।
দ্য ভার্জিন সুইসাইডস নির্মাণের আগে ১৪ মিনিটের একটি সাদাকালো শর্টফিল্ম (দ্য লিক স্টার) নির্মাণ করেছিলেন তিনি। সে কথা উল্লেখ করার কারণ, ওই শর্টফিল্মটি দেখলে বুঝতে পারা যায়, ১৪ মিনিটে রাখা অনেক কিছুই পরবর্তীর সিনেমাগুলোতে সিগনেচার স্টাইল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন সোফিয়া। প্রধানত বলা যায়, নারীকেন্দ্রিক এবং নারীত্ববোধের কথা। তার সিনেমাগুলো নারীকেন্দ্রিক তো বটেই, একইসাথে নারীবোধের বিষয়টিও উত্থাপন করে, যার মজ্জাগত ধারণা ওই শর্টফিল্মেই প্রোথিত।
পরিষ্কার দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখা যায়, সোফিয়ার সিনেমাগুলোয় প্রচলিত অর্থে কোনো গল্প থাকে না। থাকে বিভিন্ন বিষয় এবং চরিত্র। একই নামের উপন্যাস হতে নির্মিত এই, দ্য ভার্জিন সুইসাইডস'ই দেখা যাক। কোনো কাঠামোগত গল্প নয়, বরং একটির পর একটি বিষয় উত্থাপিত হয়েছে, সোফিয়ার স্বকীয় ধারার সমাজ ও মানুষজন হতে বিচ্ছিন্ন চরিত্রগুলো (কেন্দ্রীয়) দিয়ে। যৌবনে পদার্পণ, নারীবোধের আবিষ্কার, শৈশবের বাড়ন্ত মনের রঙিন সব কল্পনা এবং সবকিছুকে ছাড়িয়ে স্বাধীনতা। স্বাধীনতার অনুনাদ শুনতে পাওয়া যায় প্রতি মুহূর্তে, যে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে আত্মবিসর্জন ও স্বাভাবিক হয়ে পড়ে।
সিনেমাটি যতটা লিসবন বোনদের, ততটাই ওই তরুণদের। নারীচেতনাকে দ্ব্যর্থবোধক আর রহস্যময়ী রাখতেই পছন্দ করেন সোফিয়া কপোলা। এই সিনেমায়ও তেমনটিই রেখেছেন। তাদের ব্যক্তিগত গণ্ডিতে যেতে পারেনি ওই তরুণরা, একইভাবে দর্শকও। এই সিনেমার গোটা ন্যারেটিভ মূলত কিছু তথ্য, সম্ভাবনা আর বিরাট অংশে কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত। ন্যারেটর এখানে অবিশ্বাসযোগ্য একজন পাত্র। বলতে গেলে সেও দর্শক। পর্দার সামনে দর্শক আর কথক অবস্থান এখানে একই। দু'পক্ষই শুধু উপরিতল দেখছে। 'এমনটা নাও হতে পারে'- এই সম্ভাবনা গোটা ন্যারেটিভেই উপস্থিত। এই ন্যারেটিভ গঠনবিন্যাসই দ্য ভার্জিন সুইসাইডস'কে 'টিনেজ জঁনরা'র আর দশটা সিনেমা হতে আলাদা করেছে।
সোফিয়া এমন কোনো দৃশ্য সিনেমায় রাখেননি, যেটিতে আত্মহত্যার সুস্পষ্ট কারণ পাওয়া যায়। একদিক থেকে এই গঠনবিন্যাস কিছুটা হতাশার। তবে, এই গোটা সিনেমাই আদতে স্বপ্ন এবং স্মৃতির মাঝে ছুটে চলা একটি সফর। তরুণ বয়সের প্রেমময় স্মৃতি আর বাধাহীন কল্পনাই এই সিনেমার কেন্দ্রের দু'টি বিষয়। বাস্তব এখানে কতখানি বাস্তবিক, সে ব্যাপারটি ধোঁয়াশার। হোমকামিং ড্যান্স, প্রথম চুম্বন, কুমারিত্ব হারানোর গৎবাঁধা দৃশ্যগুলোও তাই বাস্তব আর কল্পনার মাঝে চরকির মতো ঘুরে বেড়ায়। এই অলংকারগুলো টিনেজ জঁনরার প্রচলিত অলঙ্কার, তবে সোফিয়া এমন চতুর উপায়ে আর উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করেছেন এখানে, বাহবা তাকে দিতেই হয়।
দুঃসহ অতীতের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, দ্য ভার্জিন সুইসাইডসকে। আর তেমন রূপে এই সিনেমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অনন্য এক ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ সৃষ্টি করেছেন সোফিয়া কপোলা। হ্যা, 'টেরেন্স মালিক'-এর 'ব্যাডল্যান্ডস; (১৯৭৩) সিনেমার ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজের সাথে সাদৃশ্য আছে এর। সাদৃশ্য আছে ব্যাডল্যান্ডসের কাব্যিক ধারার সাথেও। তবে তার মাঝ দিয়ে যে স্বকীয়তা এই অভিষেক সিনেমাতেই সোফিয়া প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা পরবর্তীর লস্ট ইন ট্রান্সলেশন, ম্যারি আন্টইনেত সিনেমাগুলোয় তো আরো স্বচ্ছ।
ডিটেইল এবং কম্পোজিশনে হঠকারী এক দক্ষতা অর্জন করেছেন তিনি। মডেলিং এবং ডিজাইনিংয়ে ভালোরকম জানাশোনা থাকায় কস্টিউম ডিজাইন এবং প্রোডাকশন ডিজাইনে বরাবরই তিনি অনবদ্য। 'নিখুঁত' বিশেষণটি অনায়সেই জুড়ে দেওয়া যায়। 'সংবেদনশীলতা', এই সিনেমা সহ তার বাকি সিনেমাগুলোয়ও অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হয়ে থাকে। সোফিয়া চান, দর্শক তার সিনেমাগুলো শুধু দেখুকই না, বরং অনুভবও করতে পারুক। তাই সংবেদনশীলতাকে তিনি আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রাখেন। এবং দ্য ভার্জিন সুইসাইডস এর মতো টিনেজ এই সিনেমায় সেটি আরো বেশি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায় তার নিপুণ দক্ষতা তৈরিতে জড়িত ছিলেন বাবা ফোর্ড কপোলা। ভালোভাবেই যে রপ্ত করেছেন, তা বোঝা হয়ে যায় এই সিনেমার প্রারম্ভিক দৃশ্যে। চরিত্রগুলোকে পেছন থেকে ব্লক করে ধীরে ধীরে হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরা নিয়ে চরিত্রদের নিকট থেকে নিকটে যান এবং সবটুকু আবেগকে তুলে আনেন ফ্রেমে। চরিত্রের অভিব্যক্তিকে কাজে লাগিয়ে সংলাপবিহীন ক্লোজ শটে আবেগকে পুরোপুরি তুলে আনতেই হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরার ব্যবহার করেন তিনি, যেটিকে স্বকীয় স্টাইল হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন পরের সিনেমাগুলোয়।
দ্য ভার্জিন সুইসাইডস-এ অনেক দৃশ্যেই, যেখানে চাইলেই সংলাপ ব্যবহার করা যেত, সেখানে নৈঃশব্দ্যকে ব্যবহার করেছেন সোফিয়া। ব্যক্তিগত রহস্য আর গোপনীয়তা তার সিনেমার চরিত্রগুলোর গঠনে অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ, যার সবচেয়ে বড় উদাহারণ এই সিনেমার লিসবন বোনেরা। ভাবাবেগকে জাগিয়ে তোলেন তিনি নৈঃশব্দ্য দিয়ে।
সোফিয়ার 'লিক দ্য স্টার' শর্টফিল্মটি এবং এই সিনেমা, দু'টিরই প্রারম্ভিক দৃশ্যে গাড়ির ব্যবহার দেখা যায়। শুধু ওই দৃশ্যেই নয়, এই সিনেমায় আরো অনেক দৃশ্যেই গাড়ির উন্মুক্ত শট দেখা যায়। তবে তা অহেতুক নয়। লক্ষ করলে, সোফিয়ার প্রতিটি সিনেমাতেই দেখা যায়, ক্যামেরা গাড়ির জানালার বাইরে থেকে ফোকাস করে আছে গাড়ির ভেতরে থাকা কোনো চরিত্রের জানালার কাঁচের মাঝ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার দিকে। এই 'কার শট' দিয়ে সোফিয়া তার চরিত্রগুলোর ভেতরের অবস্থাকে তুলে ধরতে চান, জানালার সেই স্বচ্ছ কাঁচকে ব্যবহার করে। দ্য ভার্জিন সুইসাইডস-এ, শেষ কার-শটে দেখা যায় লাক্স চরিত্রটি খোলা চুলে গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে প্রকৃতির নির্মলতা উপভোগ করছে, যা তার মুক্তিকামী মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
লাইটিংয়ে সফট বা ন্যাচারাল লাইটিং এর ব্যবহার করেছেন সোফিয়া। প্যাস্টেল কালার দিয়ে সাজিয়েছেন প্রতিটি কালার প্যালেট। আবহসঙ্গীতে রেখেছেন আধুনিক সব গান। এই সবকিছুকে মিশিয়ে এক স্বপ্নিল বাতাবরণের আয়োজন করেছেন সোফিয়া, তার এই সিনেমায় এবং করেন সব সিনেমায়। 'ফোর্থ ওয়াল ব্রেকিং' স্টাইল দিয়ে সোফিয়া কপোলা কিছুটা ডকু-ন্যারেটিভের ধাঁচও যুক্ত করেছেন এই সিনেমায়। ব্যবহার করেছেন ডিসলভ প্রক্রিয়ার এবং পরিচালক 'ব্রায়ান দে পালমা'র হাত ধরে জনপ্রিয় হওয়া সেই 'স্প্লিট ডিওপ্টার' শটের।
সোফিয়ার এই নন্দনতত্ত্বের উপরিতলের নিচে গভীরতা নেই- এমন সন্দেহ মনে দানা বাঁধলেও তা সঠিক নয়। কারণ দ্য ভার্জিন সুইসাইডস-এর ন্যারেটিভ অতীব সূক্ষ্ম এবং পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল, সোফিয়ার সিনেমা অগ্রসর হয় বিষয়াদির উপর ভিত্তি করে। যথেষ্ট নিগূঢ় একটি টিনেজ ড্রামা এই সিনেমা। রহস্যকে রহস্যই রেখেছে, ভাঙা কিংবা ব্যাখ্যার চেষ্টা করেনি এই সিনেমা। এবং ওটিই এই সিনেমার বিশেষত্ব।
This is a review of the film 'The Virgin Suicides' (1999). It's the debut of the acclaimed director 'Sofia Coppola', who is the daughter of the legendary filmmaker 'Francis Ford Coppola'.
Featured Image: Paramount