Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য আইরিশম্যান: দেয়ালে তাজা লাল রক্তের আলপনা আঁকতেন যিনি

দীর্ঘ ও প্রশস্ত একটা হলওয়ে। হলওয়ের দু’পাশে খোলামেলা জায়গায় বেশ কয়েকটি বসার ঘর। সেখানে অসংখ্য বয়স্ক মানুষের আনাগোনা। তাদের মধ্যে কেউ বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে আছেন, কেউ দাবা কিংবা কার্ড খেলায় মগ্ন, কেউবা আত্মীয়স্বজনের সাথে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছেন, কেউবা হুইল চেয়ারে চড়ে হলওয়ের এপাশ থেকে ওপাশে চলাচল করেছেন। হলওয়েতে তাদেরকে ছাড়াও আইডি কার্ড ও ইউনিফর্ম পরা কিছু লোকের উপস্থিতিও চোখে পড়বে। যে কেউ একনজর দেখলেই বলে দিতে পারবে, এটা কোনো বৃদ্ধাশ্রমের চিত্র।

আর এ বৃদ্ধাশ্রমের হলওয়ে ধরে সোজা এগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর বামে মোড় নিয়ে ডাইনিং রুমের সন্ধান মিলবে। সে রুমে একটা টেবিলের পাশে হুইলচেয়ারে গা এলিয়ে পেছন দিয়ে মুখ করে বসে আছেন ধবধবে সাদা চুলের এক বৃদ্ধ। সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে, তার চোখে কালো চশমা, গায়ে কালো ওয়েস্ট কোট আর পায়ের কাছে রাখা আছে একটা কাঠের খড়ি। সাদা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখের বর্ণ আর চেয়ারের সাথে জমে থাকা নিথর দেহ দেখে যে কেউ তাকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মৃত বলেও ধরে নিতে পারেন। কিন্তু ঠিক যে মুহূর্তে যে কেউ এমনটা ভেবে নিতে তৎপর হবেন, সে মুহূর্তেই তাকে অবাক করে দিয়ে নিজের জীবনের গল্প বলা শুরু করবেন এ বৃদ্ধ।

প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই নিজস্ব একটা গল্প থাকে। বিশেষ করে, বার্ধক্যের কোঠায় এসে পৌঁছালে প্রতিটা মানুষই পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোতে নিজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মিলিয়ে নিজের মতো করে নিজের জীবনের একটা গল্প সাজিয়ে নেয়। কারো কারো অপ্রাপ্তির পাল্লা এতটাই ভারি থাকে যে সে গল্প নিজের বুকের ভেতর চেপে রেখেই কবর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যান। আবার কারো কারো প্রাপ্তির সীমানা এতটাই উচ্চতায় গিয়ে থামে যে নিজে ওপারে পাড়ি জমানোর আগে সে গল্পটা সম্পত্তির মতো আপনজনদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে করে যান।

তবে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষের ভাগ্যেই ইতিহাসের পাতায় নিজের নামটুকু লেখার জন্য একটুখানি জায়গা দখল করে নেওয়ার সুযোগ ঘটে। আর তাদের মধ্যে আবার আরো অল্প কিছু সংখ্যক ব্যক্তির কপালেই জীবনকে পূর্ণভাবে ভোগ করে একদম শেষবেলায় এসে নিজের হাতে লেখা ইতিহাসকে স্মরণ করে পর্বতসমান প্রাপ্তির পরও একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গোনার সৌভাগ্য/দুর্ভাগ্য জোটে।

রক্তের আলপনা আঁকিয়ে; Source: IGN

আর আমাদের গল্পের এ বৃদ্ধ দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। নিজেকে ‘পেইন্টার’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া এ বৃদ্ধ কিন্তু সাধারণ কোনো চিত্রকর কিংবা রংমিস্ত্রি ছিলেন না। বছরের পর বছর ধরে তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেয়ালে দেয়ালে রঙের বর্ণচ্ছটা ছড়াতেন ঠিকই, কিন্তু টকটকে সেই লাল রং নিতান্ত কোনো লাল রং ছিল না। দমকা হাওয়ার গতিতে এসে মানুষের শরীরের শিরা-উপশিরায় বহমান গরম রক্ত দিয়ে দেয়ালে নিজের চিহ্ন এঁকে দিয়ে হাওয়াতেই মিলিয়ে যেতেন তিনি।

উপরে এতক্ষণ ধরে মার্টিন স্করসেসির নব্য সৃষ্ট ‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমার নামের পেছনে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। বায়োগ্রাফিক্যাল, ক্রাইম, ড্রামা জনরার সংমিশ্রণে সৃষ্ট এ সিনেমার পটভূমি বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক শেষের দিক থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলমান একটি নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে গড়ে উঠেছে।

সে সময়ের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রদেশে অপরাধ জগতের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু প্রভাবশালী পরিবারের অস্ত্বিত্ব ছিল। তাদের বিচরণ অপরাধ জগতের ছোটখাট বিষয়ে নয়, সরাসরি সেসময়কার রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার সাথে জড়িত ছিল। মাফিয়া পরিবার নামে সর্বজন পরিচিত এ পরিবারগুলোর প্রত্যেকের আলাদা আলাদা এলাকা ছিল। তারা নিজ নিজ এলাকাতে তো রাজত্ব করে বেড়ানোর পাশাপাশি স্ব স্ব অবস্থানে থেকেই পুরো দেশ জুড়ে নিজেদের আধিপত্য প্রকাশে সদাপ্রস্তুত থাকত। তবে অন্যান্য বড় বড় সম্প্রদায়ের মতো নিজেদের মধ্যে অহেতুক রক্তারক্তি তাণ্ডব এড়াতে মবস্টারদের নিজস্ব একটা সংঘ ছিল। আর সে সংঘের মবস্টারদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পারস্পরিক রেষারেষি, গোলটেবিল বৈঠক দ্বারা দলীয় সিদ্ধান্ত ইত্যাদি সহ আরো অনেক খুঁটিনাটি ব্যাপার এ সিনেমাতে একদম সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতমভাবে চিত্রিত হয়েছে।

তবে ‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমাকে সাধারণ কোনো বায়োগ্রাফিক্যাল-ক্রাইম-ড্রামা ঘরানার ধরে নিলে ভুল হবে। এগুলো ছাড়া এ সিনেমাকে ‘এপিক’ নামের এক বিশেষ ফিল্ম ক্যাটাগরির অধীনে নাম লেখাতে হবে। এখন পর্যন্ত ফিল্মের যতগুলো জনরা আবিষ্কৃত হয়েছে, এপিক তাদের মধ্যে একদম প্রাচীনগুলোর একটি।

এপিক জনরার যেমন নিজস্ব সংজ্ঞা আছে, তেমনি আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। সাধারণত, বৃহত্তর মাপকাঠিতে, সুদূরপ্রসারী ব্যাপ্তিকাল ও মনোরম ঘটনাবলীকে মাথায় রেখে বানানো ফিল্মগুলোকেই এপিক ঘরানার ফিল্ম বলে গণ্য করা হয়। এ ঘরানার ফিল্মগুলো নির্মাণের পেছনে বড় অংকের টাকা খরচ করার পাশাপাশি সিনেমার শিল্পীদের ক্ষেত্রেও উপরের সারির তারকাদের বাছাই করা হয়। এপিক ঘরানার ফিল্মগুলো ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা বা ব্যক্তিকে ঘিরে তৈরি হতে পারে। কোনো বিশেষ সময়কাল ধরে চলতে থাকা রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বা যুদ্ধকালীন সময়ের ঘটনা নিয়েও এপিক ফিল্ম হতে পারে। আবার মিথিক্যাল কোনো ঘটনার উপরেও নির্মিত হতে পারে। এপিক সিনেমার শ্যুটিং সেট ও কস্টিউমসে কোনো রকমের কমতি রাখা হয় না। বড় পরিসরে সিনেমার প্রতিটা দৃশ্য এমনভাবে ক্যামেরাবন্দী করা হয়ে থাকে যে সিনেমার প্রতি মুহূর্তে রাজকীয়তার ছাপ চোখ এড়িয়ে যাবার মতো নয়। আর ‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমা এ ঘরানার সবক’টা মানদণ্ডেই উত্তীর্ণ হতে সফল হয়েছে।

দুই কিংবদন্তীকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন আরেক কিংবদন্তী; Source: konbini

‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সিনেজগতের অন্যতম মহারথী রবার্ট ডি নিরো। সিনেমার প্রথম দৃশ্যতে তাকেই বৃদ্ধাশ্রমে হুইলচেয়ারে অসহায়ভাবে বসে থাকতে দেখা যাবে। এ সিনেমার পুরো কাহিনী তার নিজস্ব ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধি অনুসারে সজ্জিত হয়েছে।

গল্পের শুরুটা হয়েছিল ১৯৫০ দশকের দিকে। ‘দ্য আইরিশম্যান’ উপাধিপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তি তখন ফিলাডেলফিয়াতে বসবাসকারী অতি সাধারণ এক ট্র‍্যাক ড্রাইভার। যার নাম কি না ফ্র্যাঙ্ক শিরান। ট্রাকে করে শূকরের মাংস চালান দিতেন তিনি। সামান্য ড্রাইভার হলেও শিরান ছিলেন অতি চালাক। এমনকি মানুষকে পটানোর দারুণ সব কৌশল জানতেন তিনি। বাইরে থেকে দেখতে ভদ্র আর সৎ গোছের হলেও তার ভেতরে ছিল চতুর এক সত্তা। তাই তো ড্রাইভারের এ চাকরি থেকে ছলচাতুরী করে নিজের পকেটে দু পয়সা বেশি আনার পন্থা বের করে নিয়েছিলেন শিরান। আর এভাবে চোরাই পন্থা অবলম্বন করে পকেট ভারী করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে তার পরিচয় হয় ফিলাডেলফিয়ায় নিজেদের আস্তানা গেড়েছেন এমন এক ইতালিয়াল মবস্টার রাসেল বাফালিনোর সাথে। তবে তার সাথে আরো ভালোভাবে পরিচয় হয় অন্য এক ঘটনার মাধ্যমে।

শিরান যে কোম্পানির ট্রাক চালাতেন, তারা তার পণ্য চুরি করে অন্য জায়গায় বিক্রি করে বাড়তি আয়ের ব্যাপারটা ধরে ফেলে। কোম্পানি এ অপরাধে শিরানের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকলে, তার আইনজীবী হিসেবে বাফালিনো পরিবারের আরেক সদস্য বিল বাফালিনো এগিয়ে আসে। শেষমেশ মামলা শিরানের অনুকূলে ইতি টানলে বিলের সাথে বেশ খাতির হয়ে যায় শিরানের। আর এর সূত্র ধরেই বিলের কাজিন রাসেল বাফালিনোর সাথে এক টেবিলে বসে কথা বলার সুযোগ পান শিরান। শিরানের মধ্যে এমন কিছু ছিল যা রাসেলকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। রাসেল বুঝতে পারেন, শিরানকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিলে তাকে নিজেদের দলে ভেড়ানো কোনো ব্যাপারই না। শিরানের মধ্যে একজন বিশ্বস্ত ও পরিশ্রমী কর্মীকে খুঁজে পেলেন রাসেল। সবথেকে বড় কথা, সময়ের সাথে শিরান রাসেলের ঘনিষ্ঠতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তাকে নিজের পরিবারের সদস্য ভাবতে শুরু করেন রাসেল।

এভাবে শিরানের দিন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটছিল। রাসেল বাফালিনোর সাথে হাত মেলানোর পর থেকে প্রায় প্রতি রাতে তার হাত মানুষের তাজা রক্তে রাঙা হতে লাগল। অবশ্য শিরানের জন্য এসব তেমন নতুন কিছু ছিল না। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন সেনা ছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে তাকে অনেক পাশবিক কর্মকান্ডেই সাক্ষী তো হতে হয়েছিলই, তিনি নিজেও শত্রুপক্ষের প্রতি নির্দয় ছিলেন।

আইরিশম্যানের একাল-সেকাল; Source: Indiewire

তারপর কোনো একদিন রাসেল বাফালিনো শিরানকে আরো এক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার যৌথভাবে পরিচালিত লেবার ইউনিয়ন ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড অব টিমস্টারস’ (আইবিটি) এর প্রধান জিফ হফার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। হফার সাথে বাফালিনো পরিবারের আর্থিক লেনাদেনার সম্পর্ক ছিল। জিম হফাকে সে সময়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে গণ্য করা হতো। বিশেষ করে, অপরাধ বা মাফিয়াদের জগতে তাকে কদর করত না এমন কেউ ছিল না। যতই ভেতরে ভেতরে শত্রুতা থাকুক না কেন, হফার সাথে সরাসরি লড়াইয়ে নামার সাহস ও ক্ষমতা কারোই ছিল না। তবুও গোপনে গোপনে সে সময়ে হফাকে আইবিটি প্রধানের গদিতে নামানোর নানা ধরনের চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছিল বিপক্ষ দলের লোকজন। আর হফা নিজের প্রাণের ভয়ে বিশ্বাসভাজন একজন দেহরক্ষীর সন্ধানে বন্ধু রাসেলের শরণাপন্ন হন।

সেই সুবাদেই রাসেল তার কাছে শিরানের নাম সুপারিশ করেন। শিরানের সাথে প্রথমবারের মতো ফোনে কথা হয় হফার। সে ফোনালাপে কয়েক মিনিট কথা বলেই হফা বুঝে ফেলেন শিরানের চেয়ে যোগ্য লোক এ কাজের জন্য আর কেউ হতে পারে না। হফার ‘আই হার্ড ইউ পেইন্ট হাউজেজ’ এর জবাবে শিরানের ‘আই অলসো ডু মাই ওন কার্পেন্টরি’ বলার ধরনে যে আত্মবিশ্বাস মিশে ছিল, তা মুগ্ধ করেছিল হফাকে। তাই তিনি সেদিনই শিরানকে ফিলাডেলফিয়া থেকে নিজের কাছে শিকাগোতে চলে আসতে বলেন। শিরানও ছিলেন উপরস্থদের অনুগত লোক।

শিরান ও হফা যখন থেকে এক ফ্রেমে বন্দি হতে লাগলেন তখন থেকে সিনেমার গল্প অন্য দিকে মোড় নিতে লাগল। রাসেলের মতো হফার সাথেও ধীরে ধীরে গভীর বন্ধুত্বে জড়িয়ে গেলেন শিরান। হফা শিরানকে যতটা না নিজের অধীনস্থ কোনো কর্মী ভাবতেন, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি নিজের ভাই ভাবতেন। শিরান যেখানে স্বল্পভাষী ঠান্ডা মাথায় চলা লোক ছিলেন, হফা ছিলেন ঠিক তার উল্টো। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হফা যেমন সহজে রেগেমেগে আগুন হয়ে যেতেন, ঠিক তেমনি অনুকূল পরিবেশে তিনি ছিলেন হাসিখুশি বাচাল এক লোক। তাদের মধ্যবর্তী এ সম্পর্ক সময়ের সাথে যতই না পাল্লা দিয়ে মজবুত হতে লাগল, অপরাধ জগতের অভ্যন্তরীণ বিদ্বেষ, পারস্পরিক আক্রমণ ততই সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকল। আর এভাবেই সিনেমার কাহিনী সামনের এগোনোর সাথে সাথে জটিল থেকে ক্রমান্বয়ে জটিলতর ধাঁধার জালে আটকে যেতে লাগল।

শেষ যাত্রা; Source: The Film Experience

রাসেল বাফালিনো চরিত্রটিকে পর্দায় মেলে ধরেছেন স্বনামধন্য অভিনেতা জো পেশি। এ সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রায় এক দশক পর বড় পর্দার সামনে হাজির হোন পেশি। অবশ্য স্করসেসি প্রথমে যখন তার কাছে রাসেল বাফালিনো চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব নিয়ে যান, “আবারো গ্যাংস্টার নিয়ে মুভি” এমন কিছু একটা বলে স্করসেসিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু স্করসেসি হার মানেননি। বহুবার পেশির মুখ থেকে “না” শোনার পরেও শেষমেশ তাকে রাসেল চরিত্রে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হতে বাধ্য করেন স্করসেসি। স্করসেসি সাথে এ সিনেমার মাধ্যমে চতুর্থবারের মতো কাজ করেন পেশি। এর আগে তার পরিচালিত ‘গুডফেলাস’, ‘ক্যাসিনো’, ‘র‍্যাগিং বুল’ সিনেমাতে দেখা গিয়েছিল পেশিকে।

রবার্ট ডি নিরোর সাথে এটা ছিল পেশির সপ্তম সিনেমা। এর আগে ‘র‍্যাগিং বুল’, ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’, ‘গুডফেলাস’, ‘আ ব্রোনক্স টেইল’, ‘ক্যাসিনো’ ও ‘দ্য গুড শেফার্ড’ সিনেমাতে নিরো ও পেশি একসাথে কাজ করেন। রবার্ট ডি নিরোর জন্য এটা ছিল স্করসেসি পরিচালিত নবম মুভি। অন্যদিকে, জিমি হফা চরিত্রে অভিনয় করা কালজয়ী অভিনেতা আল পাচিনোর এ সিনেমার মধ্যদিয়েই প্রথমবারের মতো স্করসেসির জাদুর খাতায় তার নাম লিখিয়েছেন। রবার্ট ডি নিরোর সাথে আরো কয়েকবার জুটি বেঁধে কাজ করলেও পেশির সাথে এটাই ছিল পাচিনোর প্রথম কাজ। স্করসেসির যেমন আল পাচিনোর মতো সিনেজগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতাকে নিজের সিনেমায় কাজ করিয়ে নিজের অর্জনের মুকুটে আরো একটি রত্ন যুক্ত করেছেন, তেমনি পাচিনোও স্করসেসির মতো সিনেজগতের অন্যতম সেরা স্রষ্টার সাথে কাজ করে নিজের সাফল্যের গল্পে আরো একটি অর্জনের গল্প লিখেছেন।

‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমায় পাচিনো, নিরো ও পেশি ছাড়াও আরো বিভিন্ন চরিত্রে অনেক গুণীমানী অভিনেতাকে দেখা গিয়েছে। সিসিলিয়ান-আমেরিকান মবস্টার অ্যাঞ্জেলো ব্রুনো চরিত্রে হার্ভি কাইটেল, রাসেল বাফালিনোর আইনজীবী কাজিন বিল বাফালিনো চরিত্রে রে রোমানো, গ্যাংস্টার স্কিনি রেজর চরিত্রে ববি ক্যানভাল, ফ্র্যাঙ্ক শিরানের স্ত্রী আইরিন শিরানের চরিত্রে স্টেফানি কুর্টজুবাকে, রাসেল বাফালিনোর স্ত্রী ক্যারি বাফালিনোর চরিত্রে ক্যাথরিন নার্দুচ্চিকে দেখা গিয়েছে। প্রধান তিনটি চরিত্রের অভিনয়শিল্পীদের অভিনয় প্রসঙ্গে তো নতুন কিছু বলার প্রশ্নই আসে না, এমনকি প্রতিটি চরিত্রই আপন আপন ভূমিকায় পুরো সিনেমা জুড়ে প্রজ্জ্বলিত ছিল।

“যে ছবি কথা বলে”, সিনেমার একটি পোস্টার; Source: Change.org

২০৯ মিনিটের এ সিনেমায় কীসের না কমতি ছিল? একটা সিনেমাকে সর্বগুণ সম্পন্ন হতে হতে যে উপাদান তার মাঝে ধারণ করে নিতে হয়, তার যেন প্রত্যেকটা একদম সঠিক পরিমাণে ‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমাতে ঢেলে দিয়েছেন মার্টিন স্করসেসি। মাফিয়াদের নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন বলে যে তাতে শুধু রক্তারক্তি, গোলাগুলি, বোমা ছোড়াছুড়ি বা ষড়যন্ত্রের নকশা তৈরির কাহিনীই দেখিয়েছেন এমন কিন্তু নয়। এগুলো অবশ্যই মূখ্য উপাদান হিসেবে সিনেমাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছিল। তবে এগুলো ছাড়াও সিনেমাতে আরো অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। রাসেল সাথে কিংবা হফার সাথে শিরানের বন্ধুত্বের গল্প, সবচেয়ে বিশ্বাসভাজনের বিশ্বাসঘাতকতা করার গল্প, শিরান ও তার মেয়ে পেগির মধ্যকার পিতা-কন্যা সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প, একজন স্ত্রীর স্বামীর পাপ ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার গল্প ইত্যাদি এমন অনেক ছোট ছোট অনুভূতির গল্প নিয়ে পুরো সিনেমা অলংকৃত করা হয়েছে।

এত দীর্ঘ সিনেমাতে একঘেয়ে ভাব আসা তো দূরের কথা, পুরোটা সময় জুড়েই যেন নিত্যনতুন ছন্দের আনাগোনা হচ্ছিল। কেমন একটা রমরমা আমেজ ছড়িয়ে যাচ্ছিল সিনেমার প্রতিটা দৃশ্য। দর্শক যদি খানিকটা মনোযোগ দিয়ে সিনেমাটা উপভোগ করতে বসেন, শিরানের গল্প বলার ধাঁচে কখন যে নিজেও সিনেমার গল্পে প্রবেশ করে ফেলবেন টেরও পাবেন না। দর্শকে কীভাবে সিনেমায় বুঁদ করে রাখার জন্য বেশ কারসাজিই করেছেন স্করসেসি। ক্যামেরার সামনে কোথায়, কখন, কাকে, কতটুকু সময় দিতে হবে বেশ নিখুঁতভাবেই নির্ণয় করে নিয়েছিলেন তিনি।

সিনেমার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মুহূর্তের কথা নিয়ে কিছু না লিখলেই নয়।

সিনেমার একদম প্রথমদিকে যখন রাসেল বাফালিনোকে নিজের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন, শিরান তখন একটা বিশেষ গল্প দর্শককে শিরান চরিত্র নিয়ে বেশ স্বচ্ছ একটা ধারণা দিবে।

প্রতিপক্ষ দলের বন্দি দুজন সেনা মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেদের কবর তৈরি করছে। বন্দুক হাতে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন তরুণ সেনা শিরান। বন্দি সেনারা যখন মাটি খোঁড়া শেষ করে উপরে উঠে শিরানের সামনে এসে দাঁড়ালো, তখনো তাদের মনের কোনো এক কোণে বেঁচে থাকার আশা মৃদু মৃদু জ্বলছিল। মৃত্যু তাদের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জেনেও তাদের চোখেমুখে শেষবারের মতো আকুতি ফুটে উঠেছিল। হয়তো মায়া হবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জমের। কিন্তু না, তার মনে তো দয়ামায়ার জন্য কোনো স্থান নেই৷ নাকি তার আদৌ কোনো মন নেই?

তবে তা-ই হোক; Source: Time 

আরেকটা দৃশ্যে দেখা যাবে, জিমি হফার সাথে শত্রুতাকে কেন্দ্র করে সে সময়ে ইউনিয়নের ক্ষমতায় থাকা প্রতিপক্ষ দল ইউনিয়নের উচ্চ পদে কর্মরত জিমির স্ত্রী জোসেফিন হফাকে চাকরিচ্যুত করে। জোসেফিন নিজের জিনিসপত্র হাতে করে নিয়ে অফিস থেকে রাগে কটমট করতে করতে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠেন। কিন্তু গাড়িতে উঠার পর গাড়ি স্টার্ট দিতেও গিয়েও থেমে যান তিনি। কয়েক সেকেন্ড জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে অবশেষে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দেন কাঁপা কাঁপা হাতটি। দুরু দুরু বুকে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার পরেও যখন কোনোকিছু ঘটল না, সব আগের মতোই রইল। জোসেফিন স্বস্তির নিঃস্বাস ছেড়ে বাঁচলেন। এ দৃশ্য সত্যিই দর্শকদের কয়েক মুহূর্তের জন্য চিন্তায় ফেলে দেবে।

মূলত, তখন দু’পক্ষের মাঝেই বোমা মেরে গাড়ি থেকে শুরু করে বোট পুড়িয়ে ছারখার করার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। তাই জোসেফিনও স্বাভাবিকভাবে খারাপ কিছু ঘটার আশংকা করেছিলেন।

রাসেল বাফালিনোর কন্যার বিয়ের একটা দৃশ্য থাকে সিনেমাতে। সে দৃশ্যটাও অদ্ভুত রকমের সুন্দর। বাফালিনোর মেয়ের বিয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাফিয়া দুনিয়ায় তখন হফাকে শায়েস্তা করার জন্য মরিয়া উঠেছিল সবাই। এর মাঝে হফার ভাগ্য নির্ধারণও শেষ বলা যায়। অথচ বিয়ের দিনে যখন নব বর ও বধূ মঞ্চে এসে হাত ধরে নিজেদের শপথ পাঠ করছিল, চারিদিকে যে এতকিছু ঘটেছে বা ঘটে চলেছে তার রেশমাত্র কারো চেহারায় ফুটে উঠতে দেখতে পাবেন না দর্শক। এত স্বাভাবিক ও পরিপাটিভাবে মাফিয়া জগতের মাথাওয়ালারা একই ছাদের নিচে জড়ো হয়ে রাসেলের মেয়ের খুশিতে শামিল হচ্ছিল যে এক মুহূর্তের জন্য দর্শক ভুলে যাবেন এর আগের দৃশ্য কত রোমহষর্ক কাহিনী ঘটেছে। সত্যিই, অপূর্ব ছিল সে দৃশ্য!

তারা ছিলেন আত্মার সম্পর্কে জড়ানো দুই ভাই; Source: Irish Central

স্করসেসির বাদবাকি সব সৃষ্টিকর্মের মতো ‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমাটিও সিনেজগতে বয়ে এনেছে নতুন এক যুগান্তকারী মাত্রা। ‘দ্য শিল্ডলার্স লিস্ট’ এর মতো কালজয়ী সিনেমার জন্য সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে অস্কার পাওয়া স্টিভেন জেইলিয়ান এ সিনেমার চিত্রনাট্যের দায়িত্বে ছিলেন। আমেরিকান ইনভেস্টিগেটর, হোমিসাইড প্রসিকিউটর ও ডিফেন্স অ্যাটর্নি চার্লস ব্যান্ডিটের তদন্তমূলক বই ‘আই হার্ড ইউ পেইন্ট হাউজেজ’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই একে সিনেমায় রূপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্করসেসি। বাস্তব জীবনের জিমি হফা ও শিরানকে নিয়ে বহু ঘাঁটাঘাঁটি ও অনুসন্ধানের পরেই এ বইটি লেখেন ব্যান্ডিট। তবে যেহেতু সিনেমা, তাই এতে কিছুটা হলেও যে নিজের কল্পবিলাসী মনের মাধুরী মিশিয়েই ক্যানভাসে রংতুলির আঁচড় এঁকেছেন স্করসেসি।

চিত্রগ্রাহক রদিগ্রো প্রিয়েতোর প্রশংসা আলাদা করে না করলেই নয়। এত বিশাল ব্যাপ্তিকালের সিনেমাতে দর্শকের আগ্রহে যাতে বিন্দুমাত্র ঘাটতি না আসে এজন্য তার প্রচেষ্টা ছিল সর্বাত্মক। সিনেমার লাইটিং, ক্যামেরার কাজ, শট টেক, লং টেক প্রতিটা খুটিনাটি কারিগরি ব্যাপারে তার অবদান অসামান্য। নেটফ্লিক্সকে দেওয়া তার এক সাক্ষাৎকারে ‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমার চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করাটা কতটা চ্যালেঞ্জিং ও রোমাঞ্চকর ছিল সেসব বিস্তারিত খুলে বলেন তিনি। প্রতিটা দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণের সময় প্রোডাকশন হাউজ থেকে শুরু করে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল, ক্যামেরা সেটআপ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে স্করসেসি ও প্রিয়েতো কতটা সর্তক ছিলেন সে সাক্ষাতকার শুনলেই বোঝা যায়।

জেইলিয়ান যেমন একইসাথে নির্মম বাস্তব আবার হৃদয়স্পর্শী সংলাপে সিনেমার গল্পে আলাদা ভাব যোগ করেছিলেন, তেমনি সিনেমার ঘটনাপ্রবাহে দারুণ এক আবহ তৈরি করেছিলেন কানাডিয়ান মিউজিক কম্পোজার রবি রবার্টসন। এ সিনেমার অসাধারণ সব ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের জন্য তাকে বাহাবা দিতেই হয়।

‘দ্য আইরিশম্যান’ সিনেমা সিনে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলোর কাতারে জায়গা করে নেবে কি না এখনো জানে না কেউ। তবে এ যুগের অন্যতম সেরা মবস্টারভিত্তিক সিনেমা হিসেবে যে স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের ছিঁটেফোঁটাও নেই। এমন অভিনব সৃষ্টির মাধ্যমে সিনেপ্রেমীদের আত্মিক শান্তি দেওয়ার জন্য মার্টিন স্করসেসিকে ধন্যবাদ।

চমৎকার সব সিনেমা রিভিউ নিয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

This article is a review of a film named 'The Irishman'. It is written in bengali. This film is one of the greatest films of the year.

Feature Image: hotcorn.com

Related Articles