Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ: সভ্যতার আড়ালে মানুষের চিরায়ত বর্বরতার আখ্যান

“এই খেলনাটি আমার”– এটি বলতে একটি শিশুর কত বছর সময় লাগে? কয়েকজন শিশুকে কিছু খেলনা দিয়ে বসিয়ে দিলে দেখা যায়, কিছু সময়ের মধ্যেই তাদের মধ্যে খেলনাগুলো নিজের করে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা নিজের খেলনা বা বই অন্যকে দিতে চায় না, কিন্তু অন্যের খেলনা নিতে চাওয়ার দাবি করতে দেরি করে না। মানবশিশুর মধ্যে নিজের খেলনাটি অধিকারে রাখার সাথে সাথে অন্যের খেলনা দাবি করার যে প্রবৃত্তি- এটা কি কাউকে শিখিয়ে দিতে হয়? নিজের প্রিয় বস্তুুটি অন্যের হাতে বা বাবা-মায়ের কোলে অন্য শিশুকে দেখলে প্রায় সব সময়ই তারা যে ঈর্ষামূলক প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা তো তাদের মাঝে থাকে প্রকৃতিগতভাবে।

দুই বা তিন বছর বয়সী শিশুরাও যে কখনো সমবয়সীদের সাথে খেলার সময় অন্যদের ধাক্কা দিয়ে বসে, কখনো আঘাত করে- তা তো তাদেরকে শেখানো হয় না, বরং শেখানো হয় মিলেমিশে খেলতে, শেখানো হয় অন্যদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে। মিথ্যা বললে শিশুকে শেখাতে হয় সর্বদা সত্য কথা বলো, তাকে জানানো হয়- যতই ভালো লাগুক না কেন, অন্যের খেলনা তুমি নিতে পারবে না, তাকে বলে দিতে হয় অন্যকে আঘাত করা কত ঘৃণ্য কাজ!

এক চিরাচরিত বাস্তবতার আখ্যান, ‘লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ’; Image source: murcurytheatre.co.uk

বইয়ের পাতায় সে পড়ে- “গুরুজনকে সম্মান করো” বা “চুরি করা মহাপাপ” এর মতো নীতিবাক্য। স্কুলে সে শেখে নিয়ম-শৃঙ্খলা। এছাড়া পারিবারিক শিক্ষা তো আছেই। ভিন্ন স্থান ও ভিন্ন সময়ে হলেও এসকল ক্ষেত্রেই একটি ব্যাপার একই, আর তা হলো- ভালো বা গুণবাচক যা কিছু আছে, তা তাকে শেখাতে হচ্ছে, জানাতে হচ্ছে। কিন্তু, ঈর্ষা করতে, মিথ্যা বলতে বা খেলনা কেড়ে নিতে কাউকে শেখাতে হয় না। এই ঘটনা মোটামুটি সকল মানবশিশুর ক্ষেত্রেই এক।

তবে কি বলা যায়- মানুষ প্রকৃতিগত ও প্রবৃত্তিগতভাবেই মন্দের দিকে আগ্রহী হয় বা খারাপের দিকে ঝুঁকে পড়ে? তবে কি ভালো ও গুণবাচক দিকটি বা প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের মাঝে আসে প্রাপ্ত শিক্ষা থেকে? প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ থেকে? হ্যাঁ, এটাই বাস্তব, এটাই সত্য।

চিরকালই মানুষের প্রবৃত্তি থেকেছে ভোগ, দখল আর উচ্চাকাঙ্ক্ষায়, চিরকালই মানুষের প্রকৃতিতে থেকেছে হিংসা ও অহংকার। আমরা যে সমাজকে মন্দ বলি, সে সমাজ আমাদের বাইরের কিছু না। সমাজের মন্দটা আসলে আমাদের নিজেদের মধ্যকার মন্দেরই প্রতিচ্ছবি। ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম সেরা সাহিত্যিক উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের প্রথম উপন্যাস ‘লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ’ মানুষের প্রকৃতি, প্রবৃত্তি ও সমাজের এই চরম বাস্তবতার কথাই বলে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে।

সাহিত্যের অন্যান্য বই যেখানে সমাজকে দোষারোপ করে, অন্যান্য চরিত্রায়ন যখন সমাজকে মন্দ বলে নিজেদের থেকে আলাদা করে ফেলে, সেখানে এই বই শিশুদের রূপক চরিত্রায়নের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝেই সমাজের আসল ছবি আঁকে। আর এখানেই এই উপন্যাসটি আর সব উপন্যাস থেকে আলাদা, অনন্য এবং নিঃসন্দেহে অতুলনীয়।

উইলিয়াম গোল্ডিং; Image source: get247news.com

ইংরেজি সাহিত্য শুরু থেকেই অগণিত লেখক-সাহিত্যিকদের পদাচারণায় মুখর থেকেছে সব সময়। কিন্তু তার মধ্যে উইলিয়াম গোল্ডিং নিজের স্বল্প সংখ্যক লেখনী নিয়েই খুব কম সময়ের মধ্যে নিজের জন্য স্থায়ীভাবে প্রশংসিত একটি স্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হন। প্রকৃতপক্ষেই যে নিপুণতার সাথে তিনি মানবপ্রবৃত্তির বাস্তব রূপটি তুলে ধরেছেন তা নিজের স্থানে অনন্য।

‘লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ’ ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত গোল্ডিংয়ের প্রথম উপন্যাস। প্রকাশের পর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বইটি অন্যান্য সাহিত্যিক ও সমালোচকের কাছে ভূয়সী প্রশংসিত হয় এবং চিরকালের মতো বিশ্বসাহিত্যে নিজের স্থান করে নেয়। অন্যান্য সাহিত্যসৃষ্টির পাঠ্যবইয়ের পাতায় সংযুক্ত হতে যখন বছরের পর বছর পার হয়ে গেছে, তখন প্রকাশের কিছুকাল পরই এই বইটি আমেরিকার প্রায় শতাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায় সংযুক্ত হয়। এ থেকেই বোঝা যায় কী ব্যাপক জনপ্রিয়তা আর প্রশংসার সাথে সাহিত্যে অভিষেক ঘটে ‘লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ’ এর।

প্রধান দুই চরিত্র, র‍্যালফ ও সাইমন; Image source: independent.co.uk

কাহিনী শুরু হলে দেখা যায়, নিকট ভবিষ্যতে ঘটতে থাকা নিউক্লিয়ার যুদ্ধ থেকে বেঁচে যাওয়া কিছু ইংরেজ স্কুলপড়ুয়া বালক তাদের বিমান যাত্রার সময় দুর্ঘটনাবশত এক জনবসতিহীন দ্বীপে এসে পৌঁছায়। আগে থেকেই নিয়ম- শৃঙ্খলায় প্রশিক্ষিত সভ্য সমাজের এই ছেলেগুলো কিছুদিন নিজেদের পূর্বের মতো চালনা করে। কিন্তু দ্রুতই বেঁচে থাকার তাড়না ও শক্তিধর হয়ে ওঠার প্রবণতা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে থাকে প্রাচীনকালের বর্বরতা ও আদিমতা।

লেখক বালকদের মধ্যকার মানবপ্রবৃত্তিতে স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, ক্ষমতার লড়াইয়ে মানুষ কতটা অদম্য, বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় কতটা স্বার্থপর, আত্মগরিমায় সে হয়ে উঠতে পারে কতখানি নিষ্ঠুর। বারো বছরের ছেলে রালফ সৎ ও যৌক্তিক বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন এবং সঙ্গীদের নিজেদের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে সচেষ্ট। সে নির্বাচিত হয় ছেলেদের দলনেতা হিসেবে, কিন্তু তাতে শীঘ্রই সে বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়। অহংকারী, আত্মকেন্দ্রিক জ্যাক হয়ে ওঠে রালফের চেয়ে অধিক জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী।

গল্পের শেষপর্যন্ত দেখা যায় রালফ জ্যাকের আক্রমণ থেকে প্রাণে বাঁচলেও হয়ে ওঠে বিপর্যস্ত ও নাজেহাল। পিগির সততা ও সহানুভূতিশীলতা তাকে সকলের কাছে দুর্বল করে তোলে। রোজারের মতো উচ্ছৃঙ্খল ও নিষ্ঠুর বালক হয়ে ওঠে সাধারণ ও নিরীহ বালকদের নিয়ন্ত্রণকারী ও একপর্যায়ে তাদের ওপর অত্যাচারী। গল্পের এই চরিত্রগুলো কি নিছকই চরিত্র, নাকি সভ্যতার আড়ালে মানুষের আসল প্রকৃতি আর সমাজের বাস্তব চিত্রই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে রূপকভাবে? গল্পের সাথে সাথে তা স্পষ্ট হতে থাকে পাঠকের কাছে।

মানুষের মাঝে চিরকালই ভালোর চেয়ে মন্দের প্রভাব বেশি হতে দেখা যায়, এ যেন প্রকৃতিরই নিয়ম। তাই তো সাদার ওপর কালো রঙ প্রকট হয় সহজেই। এজন্য মানব সমাজ চিরকাল দেখে এসেছে, পরোপকারের চেয়ে আত্মকেন্দ্রিকতার, বিনয়ের চেয়ে অহংকারের এবং সমবেদনার চেয়ে নিষ্ঠুরতার বিস্তার বেশি। শেষপর্যন্ত মানুষের ভালো গুণাবলি অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারলেও খারাপ প্রবৃত্তির প্রভাব থেকে সে মুক্ত হতে পারে না কখনো।

প্রবৃত্তিগত নিষ্ঠুরতা মানুষকে গ্রাস করেই ফেলে; Image source: wiegle.com

এ উপন্যাসটি অন্যদিকে প্রকৃতির ওপর আধুনিকতার ধ্বংসের লীলাও ফুটিয়ে তুলেছে রূপকভাবে। বালক সাইমন ভালোবাসে সাথীদের, পশুপাখি, উদ্ভিদ, প্রকৃতি সবাইকে। সে যেন পৃথিবীর মাতৃরূপের মতোই সকল প্রাণকে অন্তরে ধারণ করে পরম মমতায়, কিন্তু সেই সাথীরাই তাকে হত্যা করে নিষ্পাপ সেই সরলতার জন্য। এ তো আধুনিকতার হাতে, মানুষের অহংকার আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাজে প্রকৃতির নির্মম খুন ছাড়া আর কিছু নয়। এ উপন্যাসটিকে রাজনৈতিকভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় এবং সেই ব্যাখ্যা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের রাজনীতির কথা বলে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, প্রবৃত্তির কাছে বিবেকের হারই তো মানবজাতির গল্পের সবচেয়ে চরম সত্য।

হয়তো…; Image source: officialdress.club

আধুনিকতা ও শেখানো সভ্যতার মোড়ক খুলে মানুষের লুকানো বর্বরতা বের করে আনে উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের অনবদ্য সৃষ্টি ‘লর্ড অফ দ্য ফ্লাইজ’। এটি এমন একটি বই যা প্রত্যেক পাঠক ব্যাখ্যা করতে পারে তার নিজের মতো করে, এটা এমনই এক রূপক উপন্যাস যা রূপ ধরে প্রত্যেক পাঠক দাঁড় করিয়ে দিতে পারে তার নিজের মতো অর্থ।

This is a Bengali review of the book 'Lord of the Flies'  by William Golding. This book deals with the hidden cruelty and barbarism of human nature.

Feature Image: spyurk.am

Related Articles