Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পথের পাঁচালি দেখে বেশ কিছু আমেরিকান দর্শক হল ছেড়ে বেরিয়ে যায় : সত্যজিৎ রায়

সত্তর বছর বয়সী সত্যজিৎ রায়ের ফোন ক্রমাগত বেজেই চলেছে। ‘ইউএস অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার্স’ এর পক্ষ থেকে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে যখন জানানো হয়, ১৯৯২ সালের অস্কারে চলচ্চিত্র শিল্পে অবদানের জন্য ‘আজীবন সম্মাননা’ পেয়েছেন তিনি, তখন থেকে এই মহাপুরুষের সাথে সাথে তার ভক্তদের মুখ থেকেও এক মুহূর্তের জন্য হাসি যেন সরছে না। ভারতীয় সিনেমাকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করে, বিশ্বের দরবারে তার পরিচিতি বাড়াতে অনবদ্য ভূমিকা রাখার উদ্যোগই তাকে ক্যারি গ্রান্ট, সোফিয়া লরেন, স্যার চার্লি চ্যাপলিন এবং আকিরা কুরোসাওয়ার সাথে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে।

সময়টা তখন পুরোপুরি সত্যজিতের পক্ষে ছিল। হৃদযন্ত্রের জটিলতা থেকে মাত্রই সেরে উঠছেন তিনি। বিশপ লেফ্রয় রোডের ১/১ নম্বর যে তিন তলা বাড়িটিতে ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার আক্ষরিক অর্থেই এই মহামানব থাকতেন, তার প্রতিটি কোণা তখন দর্শনার্থীতে টইটুম্বুর করছে। তারা থাকুক তাদের স্বপ্নপুরুষকে নিয়ে, আমরা বরং ঘুরে আসি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই চলচ্চিত্র পরিচালক সে বছর কার্স্টিন অ্যান্ডারসনকে তার সামগ্রিক চলচ্চিত্রনির্ভর জীবন নিয়ে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তার চুম্বক অংশ থেকে।

শৈশবে সত্যজিৎ রায়; Source: twimg.com

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: আপনি কেন চলচ্চিত্র পরিচালনা জগতে এলেন? এর পিছনের গল্পটা কেমন ছিল?

সত্যজিৎ রায়: আপনারা সবাই হয়তো জানেন, আমি মূলত একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এমনকি ‘পথের পাঁচালি’ যখন বানাচ্ছিলাম, তখনও চাকরিটা আমি ছাড়িনি। আসলে কেবল মুভি বানানোই নয়, মুভি নিয়ে লেখাপড়া করা, নিয়মিত দেখা- এগুলো আমার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সিনেমা নিয়ে প্রচুর পড়তাম আমি। তাছাড়া বিজ্ঞাপনের কাজটা আমার জন্য খুব একঘেয়ে হয়ে উঠেছিল। আর খদ্দেরদের সাথে যে ভাষায় কথা বলতে হতো বা তাদেরকে যে রকম মিথ্যা প্রলোভন দেখাতে হতো, সে ব্যাপারটাও আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। কাজেই পেশা পরিবর্তনের একটা চিন্তা মাথায় ঘুরছিল বেশ কিছুদিন ধরে। কিন্তু হুট করে চাকরি ছেড়ে দেয়ার সামর্থ্যও আমার ছিল না। তাই বেতনের একটা নির্ধারিত অংশ দিয়ে চাকরির পাশাপাশি সিনেমা বানানোর কাজটা চালিয়ে যাচ্ছিলাম ছুটির দিনগুলো বেছে বেছে।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: কিন্তু মুভিই কেন? আপনি তো একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন।

সত্যজিৎ রায়: হ্যাঁ, চিত্রশিল্পী ছিলাম। কিন্তু মাধ্যম হিসেবে সিনেমা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। পেইন্টিং নয়, সিনেমাই কিন্তু আমার প্রথম ভালোবাসা। নিজেকে আমি কখনোই চিত্রশিল্পী বলে পরিচয় দেই না। এ কথা সত্য যে, শান্তিনিকেতনে আমি চারুকলায় পড়েছি, ছবি আঁকা শিখেছি। তারপর বিজ্ঞাপনী সংস্থায় গিয়ে ছবির কাজই করতাম, বইয়ের জ্যাকেট (কভার) করেছি, ফটোগ্রাফি করেছি। কিন্তু সিনেমা সবসময়ই আমার প্রথম এবং প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল।

শান্তিনিকেতনের সত্যজিৎ; Source: blogspot.com

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: আপনার শুরুর দিকের কাজগুলোতে, বিশেষ করে অপু ট্রিলজিতে বিস্তারিত বর্ণনার ব্যাপারটা বেশ দারুণ ছিল। শুধু তথ্য না, বিভিন্ন মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক, তাদের মানসিক অবস্থা, আবেগ প্রতিটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ফুটিয়ে তুলেছেন আপনি। সিনেমায় এই ভাষার ব্যবহার আপনার মতো করে আর কেউ করেছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু আপনার পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলোতে আপনিও এই ভাষা ব্যবহার করা ছেড়ে দিয়েছেন।

সত্যজিৎ রায়: আমার মনে হয়েছে, এই ট্রিলজিতে বিস্তারিত বর্ণনার খুব দরকার ছিল। আর দশটা স্ক্রিনপ্লের মতো চট করে দেখেই বুঝে ফেলা যাবে, এমন সিনেমা এগুলো নয়। কাজেই সবাই যাতে বুঝতে পারে সেজন্য কিছুটা বর্ণনা বিভূতিভূষণের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে, বাকিটা আমার পছন্দের ইউরোপিয়ান সিনেমাগুলো থেকে নিয়েছি। বিভূতিভূষণ ব্যানার্জি নিজেও বর্ণনা খুব পছন্দ করতেন, আমার বিষয়টা দারুণ লাগে। আমার পরবর্তী সিনেমাগুলোতে এতোটা বেশি নাহলেও বর্ণনা কিন্তু ঠিকই চলে এসেছে।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: ট্রিলজিতে আরেকটি বেশ মজার ব্যাপার দেখানো হয়েছে। গল্পটা সাজানোই হয়েছে এমন কিছু মানুষকে ঘিরে যারা শুরুতে গ্রামে থাকে, তারপর শহরে চলে আসে। জীবনের একটি ধারা, বেঁচে থাকার একটি অবলম্বনকে এখানে চিত্রায়িত করা হয়েছে। ব্যাপারটা যেন অনেকটা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মকে ফ্রেমে বন্দী করে দর্শকের সামনে তুলে ধরা।

সত্যজিৎ রায়: এই পুরো ব্যাপারটাই আসলে বিভূতিভূষণের ধারণা ছিল, আমি কেবল তার সাথে সহমত পোষণ করেছি। বইটির দার্শনিকতা, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই চমৎকার ছিল যে ঐ তিনটি সিনেমার জন্য এর ব্যতিক্রম কিছু করতে চাইনি আমি।

অস্কার হাতে সত্যজিৎ রায়; Source: ibnlive.in

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: বিভূতিভূষণের উপন্যাস নিয়ে ট্রিলজি বানিয়ে আপনি রবীন্দ্রনাথে হাত দেন।

সত্যজিৎ রায়: হ্যাঁ, সে বছর রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবার্ষিকী ছিল।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: কিন্তু সেটাই কি একমাত্র কারণ ছিল?

সত্যজিৎ রায়: আমাকে বলা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানাতে হবে, আর আমি চেয়েছিলাম ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাবোধটুকুও তাতে সংযুক্ত করতে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পগুলো ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ কথাটিরই বাস্তব প্রতিফলন। তাই ভাবছিলাম তার তিনটি ছোটগল্প নিয়ে একটি প্যাকেজ বানিয়ে ফেললে কেমন হয়? সেই ভাবনা থেকেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করা।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: তারপর আপনি ‘চারুলতা’ বানিয়ে ফেলেন।

সত্যজিৎ রায়: তারপর না, তার আরও তিনটি সিনেমা বানানোর পর চারুলতার কাজে হাত দিয়েছিলাম।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: কিন্তু আপনি কাজের ক্ষেত্রে কোনোভাবে কি নিজেকে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে মনে করেন?

সত্যজিৎ রায়: অবশ্যই, বেশ কিছু কাজের ক্ষেত্রে আমি তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া একজন মানুষ। সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বলেন আর গল্পকার হিসেবেই বলেন, বাঙালি জাতি তার কাছে অনেকটা ঋণী।

চিরচেনা ভঙ্গিমায় সত্যজিৎ; Source: amazon.com

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: এই প্রশ্নটি করার পেছনে প্রধান কারণ হলো, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন রেনেসাঁস ব্যক্তিত্ব। একই সঙ্গে অসংখ্য সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। আপনিও অনেকটা তেমনই একজন মানুষ। ছবি আঁকা, সিনেমা বানানো, গান লেখা, সাহিত্য প্রায় সব জায়গায় আপনার দৃপ্ত পদচারণা খুঁজে পাওয়া যায়। সেদিক থেকে কি রবীন্দ্রনাথের সাথে নিজের কোনো মিল খুঁজে পান আপনি?

সত্যজিৎ রায়: আমি ঠিক জানি না, তবে আপনি যদি বহুমুখী প্রতিভার কথা বলেন সেটা আমার রক্তেই মিশে আছে। দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, কবি, আলোকচিত্রী, বিজ্ঞানী ও জ্যোতিষী। বাবা সুকুমার রায়ও তেমনটাই ছিলেন, অবশ্য খুব কম বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় তাকে। ছোট্ট এই জীবনে তিনি লিখেছেন আর এঁকেছেন। তার বহুমুখী প্রতিভার কাছে নিজেকে তুচ্ছ মনে করি আমি। কাজেই কখনো রবীন্দ্রনাথের সাথে নিজেকে তুলনা করার কথা মাথায় আসেনি। তবে অধিকাংশ বাঙালি যেহেতু রবীন্দ্রনাথ পড়ে বড় হয়, তাদের মাথায় এই কথাটি আসা খুব স্বাভাবিক।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: ভারত তো দীর্ঘদিন যাবত ব্রিটিশ কলোনির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতীয় জনগণ এবং সংস্কৃতির উপর এর কেমন প্রভাব পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?

সত্যজিৎ রায়: ব্রিটিশরা আমাদের সংস্কৃতিতে বেশ ভালো প্রভাব রেখেছে। তাদের আমলেই প্রথম বাংলা উপন্যাস প্রকাশিত হয়। লকি, বেনথাম, মিলের মতো দার্শনিকদের পেয়েছি আমরা; ম্যাজিনির মতো দার্শনিকরা আমাদের স্বাধীনতা কী তা বুঝতে শিখিয়েছেন। ‘বাঙালি রেনেসাঁ’ নামে একটি আন্দোলনের কথা হয়তো জানেন, এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ছিল যেখানে সতীদাহ প্রথার মতো বিভিন্ন ধর্মীয় গোঁড়ামির ঘোর সমালোচনা করা হয়। তবে ঔপনিবেশিক সময়ে জমিদার বা ভূস্বামীরা দরিদ্র কৃষকদের উপর যে অত্যাচার চালাত, তা কখনোই মেনে নেয়া যায় না।

শ্যুটিংয়ের এক ফাঁকে; Source: nofilmschool.com

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: ভারত এবং পশ্চিমের মধ্যকার সম্পর্কটা এখন কেমন বলে আপনি মনে করেন?

সত্যজিৎ রায়: আইডিয়ারা খুব দ্রুত ভ্রমণ করে, সেই সূত্রে আমাদের উপর পাশ্চাত্যের প্রভাব বেশ ভালোই বিস্তার করেছে। আমরাও কিন্তু এদিক থেকে পিছিয়ে নেই, তবে আমাদের ধ্যান-ধারণাগুলো তারা মানতে ইচ্ছুক না। তাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষমতাই নেই আমাদের। এর পিছনে মূল কারণ অবশ্যই দারিদ্র্য।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: পুরোদস্তুর ভারতীয় সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছেন আপনি। কিন্তু আপনার কাজের ক্ষেত্রে ইউরোপের প্রভাব অনেক বেশি দেখা যায়।

সত্যজিৎ রায়: আমাকে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণ বলতে পারেন। ইউরোপিয়ান শিল্প এবং সাহিত্য নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছি আমি। ছোটবেলায় ক্রিসমাস ডে পালন করা, শান্তা ক্লজের সাথে খেলাধুলা করা, উপহার নেয়া সবই করেছি। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি ইউরোপ সম্পর্কে ইউরোপিয়ানদের চেয়েও ভালো জানি। এটা কিন্তু উপনিবেশবাদের জন্যই সম্ভব হয়েছিল। স্কুলে আমাদের জোর করে ইংরেজি শেখানো হতো। কাজেই শহুরে শিক্ষিত ব্যক্তিদের সাথে গ্রামের মূর্খ, পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের বেশ বড় একটা অমিল দেখা যায়। ব্যতিক্রম কেরালা, সেখানে শতকরা ৯০ ভাগ লোকই শিক্ষিত।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: ভারতে বসে আপনারা অসংখ্য পশ্চিমা চলচ্চিত্র দেখেন, কিন্তু পশ্চিমে বসে আমরা ভারতীয় সিনেমা দেখতে পাই না বললেই চলে।

সত্যজিৎ রায়: ভারতের মানুষ জানে এবং প্রতিমুহূর্তে জানতে চায় দুনিয়াজুড়ে কী ঘটছে। তারা কৌতূহলী এবং জিজ্ঞাসু। কিন্তু ভারতে কী ঘটছে সে সম্পর্কে খুব কম পশ্চিমাই জানতে ইচ্ছুক। তাদের এই উদ্ধত দৃষ্টিভঙ্গি বদলে আরও খোলা মনের অধিকারী হওয়া উচিৎ। যখন আমার ‘পথের পাঁচালি’ প্রথমবারের মতো আমেরিকায় দেখান হলো, তখন মানুষ যে হাত দিয়েও ভাত খেতে পারে এই বিরক্তিকর দৃশ্য দেখে বেশ কিছু দর্শক হল থেকে বের হয়ে যায়। পশ্চিমেও এমন কিছু মানুষ আছেন যারা বাংলা শেখেন, ভারতীয় সংস্কৃতি পড়েন, কিন্তু তাদের সংখ্যা নেহাতই কম।

শিল্পীর তুলিতে সত্যজিৎ; Source: blogspot.com

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: শুরুর দিকে, আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকগুলো অন্যান্য ভারতীয় মিউজিকের তুলনায় একেবারেই আলাদা ছিল। আপনি থিম নির্ভর এবং নাটকীয় স্কোর বা সঙ্গীত বেশ পছন্দ করতেন বলে মনে হতো। কিন্তু একটা সময় পর থিমের ব্যাপারটি আপনি প্রায় বাদই দিয়ে দিয়েছেন। এখন মাঝে মাঝে নাটকীয় কিছু সঙ্গীত আবহ শোনা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা-ও থাকে না।

সত্যজিৎ রায়: শুরুর দিকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কোনো আত্মবিশ্বাসই ছিল না আমার। চলচ্চিত্রে যে ধরনের সঙ্গীত ব্যবহার করা হয় সে সম্পর্কে জ্ঞান তো অবশ্যই ছিল। যাদের সাথে কাজ করতাম তাদের দিয়ে আলাদা আলাদা দৃশ্যের জন্য ভিন্নরকম আবহ সঙ্গীত তৈরি করিয়ে নিতাম। ‘পথের পাঁচালি’ চলচ্চিত্রে ৭-৮ বার একই স্কোর ব্যবহার করা হয়। রবি শঙ্কর সিনেমা দেখার আগেই আমার সামনে বসে গুনগুণ করে সুরটি ভাঁজতে থাকেন, সাথে সাথে তা পছন্দ হয়ে যায় আমার। সিনেমায় যেহেতু দর্শকের অংশগ্রহণের বা মনোযোগ দেয়ার ব্যাপারটা অনেক বেশি থাকে, কাজেই পুরো সিনেমায় অন্তত ৩-৪ বার একটি আবহ সঙ্গীত ব্যবহার না করলে দর্শক তা মনে রাখতে পারে না।

থিম হোক আর নাটকীয়, একটি চলচ্চিত্রের জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ত্রিশ কিংবা চল্লিশের দশকে আমেরিকার চলচ্চিত্রে যে মিউজিক ব্যবহার করা হতো, সেগুলো আমার খুব বিরক্ত লাগতো। কিন্তু ১৯৪৪/৪৫ সালের দিকে ‘সাউদার্নার’ নামে একটি চলচ্চিত্র আমাকে মুগ্ধ করে। সেখানে গানের চেয়ে সাউন্ডট্র্যাক বেশি ব্যবহার করা হয়। অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তুলতে এটি কত বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। কাজেই আমি এখনো পর্যন্ত যে ধরনের সঙ্গীত ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহার করছি, তা ঐ অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার সহায়ক বলেই করছি।

কাজ কীভাবে বুঝিয়ে দিতে হয় ভালোই জানতেন তা! Source: ozy.com

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: সঙ্গীত ভুবনে আপনার পথচলা কীভাবে শুরু হলো?

সত্যজিৎ রায়: চারপাশে একটি সঙ্গীত ভুবন দেখতে দেখতে বড় হয়েছি আমি। মায়ের পরিবারে প্রায় সবাই গান গাইতেন। আমার মা রবীন্দ্রসঙ্গীত, ব্রাক্ষ্ম সমাজ সঙ্গীত, রাগ সঙ্গীত খুব সুন্দর গাইতেন। দাদাকে আমি ভায়োলিন বাজাতে দেখিনি, কিন্তু শুনেছি তিনি দারুণ সুন্দর বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। সঙ্গীত আমি কখনো পড়িনি, কিন্তু এটি আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। স্কুলের শেষ দিকে এসে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি এক ধরনের আগ্রহ জন্মে আমার। তখন থেকে আমি স্কোর বা মিউজিকের সিডি কেনা শুরু করলাম, নীরদ চৌধুরীর মতো শিল্পীদের কনসার্টে যাওয়া শুরু করলাম। শান্তিনিকেতনে যাওয়ার সময় গ্রামোফোন রেকর্ডের সংগ্রহশালা নিজের সাথে নিয়ে নিলাম। সেখানে ড. আরোনসন নামের এক জার্মান ইহুদির কাছে এই সংক্রান্ত একটি বড় লেকচার শুনে অভিভূত হয়ে উঠি আমি। আরোনসনের সাথে বসে প্রচুর সঙ্গীত শুনতাম আমি। সে পিয়ানো বাজাত আর আমি তার হয়ে লিরিক্সের পাতা উল্টে দিতাম। শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকার পাশাপাশি সঙ্গীতের জ্ঞানটুকুও অর্জন করেছি আমি।

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: এই পুরো যাত্রায় আপনার পাশে কি কেউ ছিল?

সত্যজিৎ রায়: না, কেউ ছিল না, অন্তত প্রথম দিকে তো নয়ই। পরবর্তীতে ছিলেন কয়েকজন, কিন্তু শুরুর দিকে আমি একা একাই রেকর্ডের দোকানগুলোতে যেতাম, তাদের সংগ্রহ দেখতাম। এক সময় আমার মনে হলো, কলকাতায় রুচিসম্মত ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের কোনো রেকর্ড নেই। কাজেই গ্রামোফোন কোম্পানির ম্যানেজারকে গিয়ে বললাম কলকাতায় ক্লাসিক্যাল রেকর্ড আনার ব্যবস্থা করুন, বেশ কিছু গ্রাহক অপেক্ষা করছে এই রেকর্ডের জন্য। তারা বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠে। আসলে কিন্তু এমন কোনো গ্রাহকের কথা আমি জানতাম না। নিজের প্রয়োজনে ছোটখাটো এমন মিথ্যা কথা বলে তাদের হাতে আমার পছন্দের মিউজিকের তালিকা ধরিয়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম।

কাজের টানে লন্ডনে; Source: davidsteen.co.uk

কার্স্টিন অ্যান্ডারসন: এবার একটি অন্যরকম প্রশ্ন করে শেষ করতে চাইছি। আপনার গ্রামীণ সিনেমাগুলোতে কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধে এক ধরনের একটি সরলতা ফুটে ওঠে। কিন্তু যখনই আপনি শহরকেন্দ্রিক সিনেমা বানান তাতে এই সরলতাটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, উদাহরণস্বরূপ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা ‘জন অরণ্যে’র কথা বলা যায়। এটা কী আপনার নিজস্ব চিন্তাধারার প্রতিফলন? আপনি কী বিশ্বাস করেন গ্রামের মানুষ মাত্রই সরল আর শহুরে লোকেরা সেই সরলতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে?

সত্যজিৎ রায়: হ্যাঁ, তা কিছুটা বলতে পারেন। ‘অশনি সংকেত’ ছাড়া আমার পরিচালিত প্রতিটি গ্রামীণ চলচ্চিত্রেই কেন্দ্রীয় চরিত্রকে নিষ্পাপ দেখানো হয়েছে। আর শহরের যান্ত্রিকতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে, উচ্চ মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত যে শ্রেণীটিকে আমি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি তাদের মধ্যে এক ধরনের পঙ্কিলতা ঢুকে গেছে বলে আমি বিশ্বাস করি।

কাছের মানুষদের কাছে ‘মানিক’ নামে পরিচিত বরেণ্য এই চলচ্চিত্র পরিচালককে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকায় উপরের দিকে স্থান দেয়া হয়েছে। অস্কার গ্রহণ, এই সাক্ষাৎকার প্রদান আর তার মৃত্যু- সব একই বছর ঘটে, ১৯৯২ সালে। দেশ-বিদেশের বহু বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ এর চলচ্চিত্রশৈলীর অনুসারী। তারা বিভিন্নভাবে সত্যজিৎ রায়ের কাজ দ্বারা প্রভাবিত। এই দলে ভারতের অপর্ণা সেন, দীপা মেহতা, ঋতুপূর্ণ ঘোষ ও গৌতম ঘোষ, বাংলাদেশের তারেক মাসুদ ও তানভীর মোকাম্মেল, এমনকি ইরানের আব্বাস কিয়ারোস্তামি এবং ফ্রান্সের জঁ লুক গদারের মতো পরিচালক পর্যন্ত রয়েছেন। সত্যজিৎকে তাই চলচ্চিত্র জগতের মহীরুহ বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না।

ফিচার ইমেজ- kenfolios.com

Related Articles