Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শাটিকাপ: বাংলা নার্কো-থ্রিলার ঘরনার নতুন বিস্ময়

গত ১৩ জানুয়ারি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে মুক্তি পেল স্টারকাস্টবিহীন ওয়েব সিরিজ শাটিকাপ। আট পর্বের নার্কো-থ্রিলার এই সিরিজটি নির্মিত হয়েছে মাদক, কিশোর গ্যাং, ও সীমান্ত অপরাধের চিত্র নিয়ে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে বাংলার ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, যার নির্মাতা তরুণ পরিচালক মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম। চলচ্চিত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছেন দিল্লির এশিয়ান স্কুল অব মিডিয়া স্টাডিজে ‘সিনেমাটোগ্রাফির’ ওপর। ফলে স্বভাবতই তার নির্মাণে ঘুরে-ফিরে চিত্রগ্রহণের মুনশিয়ানাই নজরে এসেছে প্রতিটি পর্বে। গঠনের দিক থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকিংয়ের প্রয়াস সুস্পষ্ট এই নির্মাণে। এতে অভিনয়ে যারা ছিলেন তারা সবাই উত্তরাঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দা; কেউই মিডিয়ার নামকরা চেনাজানা মুখ নন। এর চিত্রধারণও করা হয়েছে রাজশাহীতে। ছোট ছোট আটটি পর্বে বিভক্ত শাটিকাপে ক্যামেরা নিয়ে দারুণ সব নিরীক্ষণ রয়েছে। সিনেমাটিক ট্রিটমেন্টের জায়গা থেকে যা শুধু মুগ্ধতাই ছড়ায়। পাশাপাশি শট ডিভিশনের নিপুণতা শাটিকাপকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ফলশ্রুতিতে সিরিজটিই প্রশ্নাতীতভাবে নির্মাণশৈলীর অনন্য বৈশিষ্ট্যে আলোচনাযোগ্য সিরিজ হয়ে উঠেছে।

হেরোইন বিক্রেতা ফাজু তার অভিনয় ও এক্সপ্রেশনে যুগিয়েছে হাস্যরস; Image Source: Chorki 

শাটিকাপের সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর ব্যাপার এর ভাষা। ডায়ালেক্টের স্বাচ্ছন্দ্য এবং নান্দনিক প্রয়োগে ওয়েবসিরিজটি হয়েছে সম্পূর্ণ কৃত্রিমতা বর্জিত। আট পর্বের নামগুলোও সেরকম কৌতূহল উদ্দীপক। পাপের শুরু, খিদিরবিদির, ভ্যাটাম, ভ্যানতারা, হাঁসের প্যাঁচ, ভেলকি, লে ঘিরে লে, মাথার উপর সাপ বাপরে বাপ। এক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা বোধগম্যতায় তেমন সমস্যায় ফেলেনি। পারিপার্শ্বিকতা ও দক্ষ অভিনয়ের সমন্বয়ে সংলাপ সহজেই বোধগম্য হয়। ‘শাটিকাপ’ রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষা। যার অর্থ ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিংবা লুকিয়ে থাকা। সিরিজের কাহিনীও অগ্রসর হয় নামকরণের সার্থকতা প্রমাণের নিমিত্তে। মাদক চোরাকারবারি বনাম কল্পিত এক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যকার দ্বৈরথের গল্প শাটিকাপ। সাপলুডুর মতো অদ্ভুত কাটাকুটি খেলায় যার যাত্রারম্ভ। আইনি জটিলতা এড়াতে বিশেষ কোনো বাহিনীর নাম না ব্যবহার করে নির্মাতা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। ‘বিডিআই’ তথা ব্যুরো অফ ড্রাগ ইনভেস্টিগেশন নামের বিশেষ ফোর্সটি শাটিকাপের প্রাণ। নেপথ্যে সদস্যদের অভিনয়ে নির্মাতা বের করে এনেছেন হিউমার মিশ্রিত থ্রিলারের রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা। অবশ্য বিডিআইর অফিসের দৃশ্যায়নে সিরিজের বাজেট স্বল্পতার ব্যাপারটি পরিলক্ষিত হয়েছে। তদুপরি বিশেষ ফোর্সের লোগো নানাভাবে দেখিয়ে জোরপূর্বক বিশ্বাসযোগ্যতা আনয়নের প্রচেষ্টা বলে মনে হয়েছে। তবে অফিসার উত্তম এবং লিয়াকতের অভিনয়ের নান্দনিকতা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

ভাই, বন্ধু, স্বামী এবং গুপ্তচরের বহুমুখী ভূমিকায় বাবুকে দেখা গেছে স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বতঃস্ফূর্ত; Image Source: Chorki 

সিনেমাটোগ্রাফিতে তাওকীর দেখিয়েছেন তার অভিনব ম্যাজিক। চেয়ার সমেত গরু ব্যবসায়ীকে নৌকায় তুলে দেয়ার দৃশ্য, নগরবাড়িতে ভিলেনের চরিত্রকে লোয়ার পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখিয়ে অফিসার উত্তমের মনস্তত্ত্ব বর্ণনা ও ক্ষমতার অবস্থানের মেটাফরিক বয়ান হয়ে উঠেছে। তেমনি সরু গলিতে অফিসার লিয়াকতের বাইক চালানোর দৃশ্যধারণে অপ্রচলিত এঙ্গেল বেছে নেয়ায় চিত্রগ্রাহকের সৃজনশীলতা রয়েছে। অনুরূপভাবে ফাজুকে ধাওয়া করার সিনে কুকুরের উপর দিয়ে লাফিয়ে যাওয়া কিংবা পাঁচিল টপকানোর সিনেও একরাশ মুগ্ধতা ধরা দেয়। অতঃপর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে শাটিকাপ মারার সেলফি শটকেও দুর্দান্ত বলতে হয়। এছাড়া মাদক কারবারি রসুর সাথে অফিসারের কাদামাটিতে হাতাহাতিতে ক্যামেরার সূক্ষ্ম কারিকুরি যথোপযুক্ত সিনেমাটিক আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছে। ড্রোনশটে দৃষ্টিনন্দন বিষয়বস্তু আর কম্পোজিশন চোখের স্বস্তি দিয়েছে। বিশেষ করে, গরুর পালের দিগ্বিদিক ছোটাছুটির দৃশ্য আকস্মিকতায় হতবিহবলতা উপহার দেয়।

শাটিকাপের নিত্যদিনের অপরিহার্য সেন্সরবিহীন ধুন্ধুমার স্ল্যাংয়ের ব্যবহার নিঃসন্দেহে যেকোনো দর্শককে একদম ‘র’ ফ্লেভার দিতে সমর্থ। লক্ষণীয় বিষয় এই যে, সিরিজে ভাষার আঞ্চলিকতা নিয়ে অহেতুক ভাঁড়ামো কিংবা আদিখ্যেতার আশ্রয় নেয়া হয়নি। বিকৃত উচ্চারণে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর অপচেষ্টা থেকে পুরোপুরি মুক্ত শাটিকাপ। বরং সংলাপ হাস্যরস যুগিয়েছে গল্প বলার বিচক্ষণতায় এবং অখ্যাত প্রতিভাবান শিল্পীদের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ের কারিশমায়। গল্পের প্রধান চরিত্ররা বেশ সাফল্যের সাথেই নিজেদেরকে প্রমাণ করেছেন।

মেকআপ এবং কস্টিউমে শাটিকাপ থেকেছে সীমিত পরিসরে। সেখানে অহেতুক বাড়াবাড়ি চোখে পড়েনি। ড্রাগডিলার জয়নালের ন্যাড়া মাথার দাগগুলো বেশ বাস্তবিকভাবে ফ্রেমে ধরা পড়েছে। ফাজুর হাড্ডিসার শরীর, বাবুর লম্বা চুল, চরিত্রগুলোর লুঙ্গি পরার ধরন গল্পের সাথে খুব মানিয়ে গেছে। কিছু কিছু দৃশ্য চোখ ধাঁধিয়েছে, যেমন— শহর ছেড়ে পালিয়ে রেললাইনের ওপর জয়নালের পাগলপ্রায় অবস্থা, অফিসার কর্তৃক নিগৃহীত হবার পরে বাবুর ফুটওভারব্রিজে গড়িয়ে কাঁদতে থাকা যার অন্যতম। মাত্র দুই দৃশ্যের অভিনয়ে জয়নালের মামা চরিত্রটিও বাজিমাত করেছে। এরূপ হান্নান চরিত্রের বরফ-শীতল ফ্ল্যাট এক্সপ্রেশন ঠাণ্ডা মাথার চরিত্রটিকে দারুণভাবে প্রকাশ করেছে। তদ্রূপ মলত্যাগের বিপত্তি নিয়ে চরিত্রসমূহের সাথে ঘটা বিপত্তিগুলো পুনঃপুনঃ যথেষ্ট ধারাবাহিকতায় দেখানো হয় বলে অন্যায্য মনে হয়নি। উপরন্তু জয়নালের বোরকা পরে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা, গরুর পাকস্থলী এবং কুমড়ার ভেতরে ঢুকিয়ে হেরোইন পাচার থ্রিলারের সাথে হিউমারকে ব্যালেন্স করেছে।

সংলাপ এবং গানের লিরিকেও চাঁচাছোলা ভাষার অস্তিত্ব জানান দেয় শাটিকাপ; Image Source: Chorki 

ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং ফলি সাউন্ডের ব্যবহারেও দুর্দান্ত বিস্ময় উপহার দিয়েছে শাটিকাপ। থ্রিলার আবহের সাথে মানিয়ে নেয়ার প্রয়োজনে যৎসামান্য বিজিএম রেখে এসএফএক্সে অপেক্ষাকৃত বেশি জোর দেয়া হয়েছে। গডফাদারের গালিগালাজ হজম করার দৃশ্যে উত্তমের অসহায়ত্বে সাঁটলি গরুর হাম্বা ডাকের এসএফএক্স হাস্যরসের সঞ্চার করে। প্লটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে র‍্যাপ গানের তালে তালে গতিময়তা পেয়েছে কাহিনীর। লিরিকে প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে চরিত্রগুলোর অস্বস্তিদায়ক বিচরণ। উল্লেখ্য যে, কাহিনীবিন্যাসে গ্যাংস অব ওয়াসিপুরের (২০১২) সাথে কিছু সাদৃশ্য পাওয়া যায় শাটিকাপের। তাইতো টাইটেল কার্ডে অনুরাগ কাশ্যপের কথা স্মরণ করতে ভোলেননি নির্মাতা। তেমনি সাউন্ড ইফেক্টসের ক্ষেত্রে কানস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আরেক চলচ্চিত্র তিতলির (২০১৪) কথা মনে করিয়ে দেয় এই সিরিজ। হয়তো অবচেতনেই নির্মাতার কাজ বেশ প্রভাবিত এ দুটি ফিল্ম দ্বারা।

লোকাল এই ওয়েবসিরিজে স্থানীয় মোট ১৩৭ জন অভিনয় করেন; Image Source: Chorki 

ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকি শাটিকাপকে বলছে শতভাগ লোকাল সিরিজ; শাটিকাপ আদতে তা-ই। নির্মাতা এবং তার পুরো টিমের আন্তরিকতা উপলব্ধি করা গেছে স্বল্প বাজেটের কাজটির ফ্রেমে ফ্রেমে। ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ তাওকীর বড় স্কেলে প্রথমবারের প্রচেষ্টাতেই দেখিয়েছেন নিজের নানাবিধ পরীক্ষণের নৈপুণ্য। গল্প বলার ধরন এবং কারিগরি উভয় দিক থেকেই সবমিলিয়ে দারুণ উপভোগ্য এক ওয়েব সিরিজ এটি। তাই বলা বাহুল্য হবে না যে, দৃশ্যচিত্রে ভিন্নস্বাদের শাটিকাপ বাংলা ভাষায় নার্কো-থ্রিলারে নতুন এক মাইলফলক। পাশাপাশি তরুণ নির্মাতাদের জন্য আগামী দিনের অনুপ্রেরণাও হয়ে থাকবে তাওকীরের কাজটি।

Language: Bangla

Topic: Shaaticup is a Bangladeshi thriller streaming television series directed by Mohammad Touqir Islam. The eight-episode series was released on 13 January 2022 on Chorki.

Featured Image:  Chorki

Related Articles