
বইকে একটি হাতিয়ার রূপে কল্পনা করে নিন। বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে কালির আঁচড়ে আঁকা প্রাণবন্ত অক্ষরের শক্তিকে অনুভব করুন। এই সেই হাতিয়ার, যা দিয়ে যুগের পর যুগ ধরে লেখকগণ বধ করে আসছেন সমাজের ভণ্ডামিকে, অন্ধবিশ্বাসকে এবং নির্বুদ্ধিতার ধোয়াটে আঁধারকে। কেউ একে ব্যবহার করেন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে, কেউ এর মাধ্যমে বিতরণ করেন নির্জলা সত্য, কেউ বা আবার দুঃখ ভালোবাসার গল্প বলে যান এর আশ্রয়ে।
ইতিহাসের আনন্দ-বেদনাও অঙ্কিত হয় বই নামক দুই মলাটে ঠাসা পৃষ্ঠাগুলোর মাঝে। মহৎপ্রাণ মহামানবের গল্প যেমন ব্যাপ্ত হয় এই বই জুড়ে, তেমনি সমাজের নিকৃষ্টজনের অব্যক্ত কথামালাও এতে স্থান পায়। সেরকমই অবাঞ্ছিত একজন মানুষের ব্যর্থতার, অনুভূতির, স্বপ্নের গল্প পাওয়া যায় তরুণ লেখক ওবায়েদ হক রচিত ‘তেইল্যা চোরা’ নামক বইটির পরতে পরতে।
কাইল্যা চোরা’র ছেলে তেইল্যা চোরা বলেই চেনে সবাই। কসর আলীর ছেলে ফজর আলী বললে চিনতে গিয়ে কিছুটা চিন্তাভাবনা করতে হয় গ্রামের মানুষদের। থাক সে কথা। বাপের কর্মফল আর পেশার ভাগ নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে ফজর চেষ্টার ত্রুটি করেনি। ফলস্বরূপ, সমাজের ভদ্র ব্যক্তিদের ঔদাসিন্যে মিথ্যে চুরির আসামী হয়ে জেলে যেতে হলো। ব্যর্থতার হিসেব মেলাতে গিয়েও সে স্বপ্ন দেখে নতুন জীবনের, মুক্ত আঙিনার। জেলখানার নির্মম বাস্তবতার মাঝে আপনজনদের সাথে সৎ উপার্জনে বেঁচে থাকার সুখ স্বপ্নকে বুকে নিয়ে তার দিন কাটতে থাকে ধীরে, খুব ধীরে।
ফজর আলী টের পায়, জেলখানা আর বাইরের পৃথিবীর জীবনে বিস্তর ব্যবধান। তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ফজরের জানা নেই, তার স্ত্রী-পুত্র কী করছে, কীভাবে বেঁচে আছে। আমেনা ও মজিদের বিশৃঙ্খল সংগ্রামে সামিল হয় নতুন মুখ, রোশনী; সম্পর্কে আমেনার ভ্রাতৃবধূ। সাথে আরও যোগ হয় চোখে রাজ্যের সারল্য মাখা এক মাঝির; নাম নসু। শুরু হয় তাদের নতুন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা। তাদের কষ্টের আঁচ জেলের পাষাণ দেয়াল ভেদ করে কখনো ফজরের কাছে পৌঁছায়নি, আর ফজরের হাজতবাসের কাঠিন্যও বাইরের কোমল অনুভূতিগুলোতে কখনো আঘাত হানেনি।
জেলের দুর্বিষহ পরিবেশের মধ্যে ফজর কয়েকজনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। ইউসুফ মুন্সি, বাচ্চু, সুজন মাস্টার, পাগলা প্রফেসর - এরাই তার জেলজীবনের স্বস্তি। নাদের গুন্ডাও ফাঁকতালে এসে গভীর বন্ধুত্ব পাতিয়ে যায়। জেলের ভেতরে যুদ্ধের উত্তাপ সরাসরি ঢুকতে না পারলেও ধোঁয়া ঠিকই প্রবেশপথ করে নিয়েছিল। সেই ডামাডোলের সুযোগে সমাজের চোখে অপরাধীগুলো জেল থেকে পালিয়ে নিজেদের খুঁজে পায় অন্য রূপে। জেলখানার নিষ্ঠুরতা আর লাশের পর লাশ দেখে ভীতসন্ত্রস্ত সেই মানুষগুলোই গর্জে উঠে বাইরের পথে ঘাঠে ছিটকে পড়ে থাকা অসহায়ত্বের নীরব ক্রন্দনে।
ফজরের জীবনের মোড় ঘুরতে থাকে, ঘুরতে থাকে দেশের পরিস্থিতিও। পাকিস্তানের সর্বগ্রাসী রসনার বাঁধন ভেঙ্গে তিলে তিলে একটি নতুন দেশের অবয়ব স্পষ্ট হতে থাকে বিশ্বের মানচিত্রে। পরাধীনতার শেকল ভেঙে জেগে উঠছে সে দেশ; বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সেই স্রোতে গা মিলিয়ে তেইল্যা চোরা’র খ্যাতি থেকে অখ্যাত ফজর আলীকেও বের হয়ে আসতে দেখা যায় আরো অনেকের ভিড়ে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইটি উৎসর্গীকৃত নাদের গুণ্ডা ও তার মতো আরো বহু অবাধ্য সন্তানদের স্মৃতির প্রতি। এই সেই নাদের গুন্ডা, যার ত্রাসে বংশাল এলাকার ভদ্র সমাজ সদা তটস্থ থাকতো। ঢাকার অলিতে-গলিতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর উন্মাদনা শুরু হতে এই পাজি নচ্ছার গুণ্ডাই বন্দুক হাতে তার চ্যালাপ্যালাদের নিয়ে প্রতিরোধে এগিয়ে গিয়েছিল, আর সমাজের সেই ভদ্রজনেরা লুকিয়েছিল ঘরের নিরাপদ আড়ালে। সবার আতঙ্ক সেই গুন্ডা নবজন্ম নেয় হানাদার বাহিনীর মৃত্যু তাণ্ডবের মাঝে এলাকাবাসীর ত্রাণকর্তারূপে। ‘তেইল্যা চোরা’ বইয়ের উৎসর্গপত্রে সেই স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসার জন্য লেখক ওবায়েদ হকের প্রতি ভালোবাসা।
যুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবতা ও এর তীব্রতা কারো কাছে কম, কারো কাছে বেশি। এর প্রকাশভঙ্গীও সবার এক নয়। একচোখা ইতিহাসের কানা ঘুপচিগুলি চিনে নিতে আমাদের দরকার পড়ে গল্প-উপন্যাসের। সমাজের সচরাচর দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে এক চোর ও কতিপয় নিম্নবিত্তের মানুষের যুদ্ধকালীন অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ এই 'তেইল্যা চোরা'। তথাকথিত ভদ্র সমাজের কাছে যারা অশুচি, জীবনযুদ্ধে যারা পরাজিত, সেইসব মানুষের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার এক অবলম্বন রূপে দেখা দেয় দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই বই সেই অস্পৃশ্যদের কেন্দ্র করে রচিত।
ছোট কলেবরের বলিষ্ঠ একটি বই ‘তেইল্যা চোরা’। নিম্নশ্রেণির অপরাধীদেরও যে অনুভূতি প্রকাশে থাকতে পারে শৈল্পিকতার ছোঁয়া, দেশপ্রেম যে তাদের প্রাণেও দোলা দেয়, তা আমরা অনেকেই জানি না, ভাবি না। হয়তো বা ভাবতেও পছন্দ করি না। তাদের চিন্তাভাবনা, তাদের অনুভূতি, তাদের দুর্বলতা, মহিমা, লোভ, লালসা, হিংসা সব কিছুর প্রকাশ আর দশটা সাধারন মানুষের মতোই। তবু কী এক ভিন্নতা যেন তাদেরকে আমাদের থেকে আলাদা করে রাখে। সেটা কি দেশপ্রেম, নাকি দরিদ্রতা? হয়তো তুচ্ছ হয়ে থাকার যাতনাই তাদের ক্ষোভ প্রকাশের কারণ।
গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্রের সযত্ন উপস্থাপনা লেখকের দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। গ্রাম্য ভাষার যথোপযোগী ব্যবহারে চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে প্রাণবন্ত ও বাস্তবমুখী। প্রতিটি চরিত্রের ধীরস্থির আত্মপ্রকাশের যে ভঙ্গি, সেটাও এক কথায় অপূর্ব। বাচ্চু চরিত্রটিকে প্রথম দিকে উর্দু প্রেমের ত্রুটিপূর্ণ দেশিয় সংস্করণ হিসেবে তুলে ধরা হলেও তার রক্তে যে বাঙালি বারুদ ঠাসা, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার অন্তিম উক্তিতে।
ইউসুফ মুন্সির পাকিস্তান-আসক্তিও দূর হয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিজের স্ত্রী-কন্যাকে লাঞ্ছিত হতে দেখে। নিরীহ সুজন মাস্টারকেও দেখা যায় নিজের দুর্বলতা অস্বীকার করে প্রত্যয়ী কন্ঠে কথা বলতে। বিগত জীবনের অভিশাপ কাটিয়ে ফজর আলী নিজেকে ফিরে পাওয়ার নতুন সম্ভাবনা খুঁজে পায় পাগলা প্রফেসরের সাহায্যে। আমেনা, রোশনী, নসু মাঝিও নতুন পরিস্থিতিতে ক্রমশ মানিয়ে নেয় নিজেদের। এদের মাঝে একমাত্র ব্যতিক্রম পাগলা প্রফেসর। শান্ত স্বভাবের এই উচ্চশিক্ষিত খুনীকে বোঝা সহজ নয়। আগাগোড়া নির্লিপ্ততায় ঢাকা এই আসামী ফজর আলীর কাছে নিজের গল্প বললেও অন্যদের থেকে আড়ালেই থেকে যায়।
মেজর এমরানের অলংকরণে অনবদ্য একটি প্রচ্ছদ পেয়েছে 'তেইল্যা চোরা' বইটি। মেজর এমরান প্রশংসার দাবিদার তার কাজের জন্য। নিজ পদচিহ্ন পেছনে রেখে এগিয়ে চলা নগ্ন পদযুগল যেন গল্পেরই একটি শৈল্পিক বিবৃতি। বর্ণ অলঙ্করণে সজল চৌধুরীও তার দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। ধন্যবাদ তাদের দু'জনকে। বিদ্যানন্দ প্রকাশনীর প্রশংসা না করলে লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে। বইয়ের সুলভ মূল্য নির্ধারণ, কাগজের উন্নত মান, প্রিন্টিং ও বাইন্ডিংয়ের উচ্চ গুণগত মান, দক্ষ প্রুফরিডিং নিশ্চিতকরণসহ প্রতিটি কাজে এত যত্নের ছোঁয়া সত্যিই অভিভূত করে দেবার মতো।
২০১৭ সালের মে মাসে প্রকাশিত বইটার ১১১ পৃষ্ঠার উন্নতমানের কাগজের বিপরীতে মূল্য বেশ কমই মনে হয়েছে। এত বাস্তবধর্মী গল্পের সুন্দর উপস্থাপনা, আন্তরিক সব আবেগের সমাবেশে ততোধিক সুখপাঠ্যের উপকরণ খুব সস্তাতেই পাঠকসমাজ পেয়ে গিয়েছে।
বইটির নাজুক কোনো দিক চোখে পড়েনি তেমন। বানানে ছোটখাটো ভুল চোখে না পড়ার মতোই। মাঝে মধ্যে বাপ ফজর আর বেটা মজিদের নাম গুলিয়ে গিয়েছে, তবে পিতা-পুত্রের অপত্য স্নেহের টানেই যে এমনটা ঘটেছে, তা ধরে নিতে পাঠকের আপত্তি থাকার কথা নয়।
আরেকটা ব্যাপার ঝাপসাভাবে চোখে বেঁধেছে। তা হলো, গল্পের মূল চরিত্রগুলি দরিদ্র ও নিম্ন শ্রেণির হওয়ায় সেই শ্রেণির প্রাধান্য বেশি থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে পাশাপাশি সমাজের অন্য স্তরের বাসিন্দারাও কিছুটা বিস্তৃত আলোকপাতে আসতে পারতো। সেই সাথে নাদের গুন্ডার ভূমিকা কাহিনীর মধ্যে আরো ব্যাপৃত হলে অনেক পাঠকেরই তৃপ্তির ঢেঁকুর আরেকটু দীর্ঘ হতো। বইটির লেখনিতে দূর্বলতা খুঁজতে যাওয়া সমালোচকবৃন্দ হতাশ হবেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঝরঝরে সাবলীল লেখা বুঝি একেই বলে। নিভৃতচারী এই লেখকের দু'টি কথার মধ্য দিয়ে বয়ান শেষ করছি,
'অক্ষরগুলো একটাও মরা দাগ নয়, লেখকের প্রাণ আছে তাতে। সেই প্রাণ খুঁজে পেলে লেখকের সফলতা, খুঁজে না পেলে পাঠকের ব্যর্থতা!'
This article is in Bangla language. It is a review of a book namely 'Teilla Chora' written by Obayed Haq. This was a well-written piece based on a timeframe back to 1971, published by Bidyananda Prokashoni.
Featured Image: Boi Pathok