Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য এঞ্জেল: মিসর-ইসরায়েলের এসপিওনাজ যুদ্ধ নিয়ে নেটফ্লিক্সের স্পাই থ্রিলার

১৯৬৭ সাল সংঘটিত ৬ দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ ছিল মিসরের জন্য ভয়াবহ এক বিপর্যয়মূলক ঘটনা। মিসরীয় সেনাবাহিনী ছিল সমগ্র আরব বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। কিন্তু ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর আচমকা আক্রমণে মিসরের সবগুলো যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়ে গেলে সেই শক্তিশালী বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে মাত্র ছয় দিনের মধ্যেই পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয় মিসরকে। একইসাথে মিসর, সিরিয়া এবং জর্ডানকে পরাজিত করে বিস্তীর্ণ নতুন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ইসরায়েল। মিসরের হাতছাড়া হয়ে যায় সুবিশাল সিনাই উপদ্বীপ।

মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের জন্য এটা ছিল চরম অবমাননাকর। তিনি সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে সংগঠিত করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ইসরায়েলকে সম্পূর্ণ পরাজিত করা সম্ভব না হলেও অন্তত সিনাই থেকে ইসরায়েলি বাহিনীকে বিতাড়িত করা তার নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করার জন্যও জরুরি ছিল। আর এ উদ্দেশ্যে তিনি সামরিক এবং আর্থিক সহযোগিতার জন্য নির্ভর করছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর। কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও তার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তিও তার এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন তার মেয়ের জামাতা, আশরাফ মারোয়ান।

আশরাফ মারোয়ানের যুক্তি ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য অপ্রতুল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেও বেশি দিন টিকতে পারবে না। এরকম পরিস্থিতিতে সিনাই উদ্ধার করতে গেলে পুনরায় দীর্ঘকালীন যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাবে। মিসরের বরং সিনাই উদ্ধার করার আশা বাদ দিয়ে আমেরিকার সাথে চুক্তি করা উচিত যে, মিসর ইসরায়েল আক্রমণ করবে না, বিনিময়ে আমেরিকা মিসরকে আর্থিক সাহায্য দিবে। তার দৃষ্টিতে হারানো ভূমি উদ্ধারের চেয়ে ভবিষ্যতের যুদ্ধ এবং প্রাণহানি এড়ানোই অধিকতর লাভজনক। বলাই বাহুল্য, গামাল আবদেল নাসেরের কাছে আশরাফের এ বক্তব্য মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। আগে থেকেই তিনি আশরাফকে খুব একটা পছন্দ করতেন না, এ সময় তিনি তার মেয়েকে চাপ দিতে থাকেন আশরাফকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য।

দ্য এঞ্জেল মুভির পোস্টার; Image Source: Netflix

শ্বশুরের উপর ক্ষিপ্ত হয়েই হোক, কিংবা তার দৃষ্টিতে মিসরের বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই হোক, আশরাফ মারোয়ান নিজ থেকে যোগাযোগ শুরু করেন ইসরায়েলের সাথে। একপর্যায়ে তিনি যোগ দেন ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদে। শুরু হয় তার রহস্যজনক এসপিওনাজ ক্যারিয়ার। কালক্রমে তিনি হয়ে ওঠেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট, যাকে পরবর্তীতে এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হিসেবে অভিহিত করেন। নাসেরের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত যখন ক্ষমতায়, তখন মারোয়ান একাধিকবার ইসরায়েলকে রক্ষা করেছিলেন। একবার লিবিয়ার আক্রমণ থেকে, আরেকবার মিসরের আক্রমণ থেকে।

আশরাফ মারোয়ানের এসপিওনাজ জীবনের সত্য ঘটনা নিয়েই নির্মিত হয়েছে গত ১৪ই সেপ্টেম্বর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র দ্য এঞ্জেল (The Angel)। চলচ্চিত্রের কাহিনী গড়ে উঠেছে ইসরায়েলি গবেষক ইউরি বার জোসেফের লেখা একই নামের একটি বই অবলম্বনে। এঞ্জেল নামটি এসেছে মোসাদের অভ্যন্তরে আশরাফ মারোয়ানের ছদ্মনাম থেকে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাকে স্বর্গীয় দূতের মতোই বিবেচনা করেছিলেন, যিনি স্বেচ্ছায় মিসরের যুদ্ধ পরিকল্পনা সংক্রান্ত গোপন সব তথ্য নিয়ে তাদের কাছে এসে হাজির হয়েছিলেন। স্পাই থ্রিলার ধর্মী এ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন ইসরায়েলি পরিচালক এরিয়েল ভোরম্যান

দ্য এঞ্জেল চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে লন্ডনের রাস্তায় আশরাফ মারোয়ান; Image Source: Netflix

চলচ্চিত্রটি শুরু হয় ১৯৭৩ সালের একটি অপারেশনের অংশবিশেষ দেখানোর মাধ্যমে, যার পুরোটা দেখানো হয় পরবর্তীতে চলচ্চিত্রের মাঝামাঝিতে গিয়ে। শুরুর ঐ দৃশ্যের পরপরই কাহিনী চলে যায় পরবর্তী যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে মারোয়ানের উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট নাসেরের সাথে ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতসহ অন্যান্যদের মন্ত্রীদের বৈঠকের একটি দৃশ্যে। এরপর ধীরে ধীরে উঠে আসে মারোয়ানের মোসাদে যোগ দেওয়ার কাহিনী। তার দীর্ঘ এসপিওনাজ জীবনে কীভাবে তিনি একের পর এক গোপন তথ্য দিয়ে ইসরায়েলকে সাহায্য করেছেন, এবং সেটা করার মধ্য দিয়ে কীভাবে তিনি একইসাথে মিসরের স্বার্থও রক্ষা করেছেন, সেগুলোই পুরো মুভি জুড়ে দেখানো হয়।

ইউরি বার জোসেফের উপন্যাসটিতে আশরাফ মারোয়ানের এসপিওনাজ জীবনের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে। সেখান থেকে দুটি ঘটনা এবং আশরাফ মারোয়ানের রহস্যজনক ভূমিকার পর্যালোচনা নিয়ে রোর বাংলায়তিন পর্বের একটি সিরিজ লেখা আছে। কিন্তু মাত্র দুই ঘন্টার চলচ্চিত্রে এতো বিস্তারিত অপারেশন তুলে ধরা সম্ভব না। ফলে উপন্যাসে প্রতিটি ঘটনার যে বাস্তবসম্মত বিস্তারিত বর্ণনা, চলচ্চিত্রে তার কিছুটা অভাব পরিলক্ষিত হয়। মূল কাহিনী অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং শ্বাসরুদ্ধকর হলেও চলচ্চিত্রটি ঠিক সেই অর্থে ‘বর্ন সিরিজ’ এর মতো অ্যাকশনভিত্তিক হয়ে উঠেনি, বরং কিছুটা টিংকার টেইলর সোলজার স্পাইয়ের মতো ড্রামাপ্রধান হয়ে উঠেছে।

দ্য এঞ্জেল মুভির একটি দৃশ্যে আশরাফ মারোয়ান; Image Source: Netflix

দ্য এঞ্জেল-এ এঞ্জেল চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিউনিসিয়ান-ডাচ অভিনেতা মারোয়ান কেনজারি। গামাল আবদেল নাসের ছাড়াও মুভিতে অন্যান্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্রকে দেখানো হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন নাসেরের মেয়ে মুনা নাসের, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, কর্নেল গাদ্দাফী এবং মোসাদের তৎকালীন পরিচালক জাভি জামির। চমৎকার মেকআপের ফলে আনোয়ার সাদাত চরিত্রে অভিনয় করা ইরাকী অভিনেতা স্যাসন গাবাই এর চেহারা অনেকটা আসল আনোয়ার সাদাতের মতোই ফুটে উঠেছে। কিন্তু এর বাইরে অন্যান্য চরিত্রের অভিনেতাদের চেহারার সাথে বাস্তবের ব্যক্তিদের খুব একটা মিল নেই।

দ্য এঞ্জেল চলচ্চিত্রের একটি বড় ত্রুটি হলো এর ভাষার ব্যবহার। চরিত্রগুলো অধিকাংশই আরব হলেও আন্তর্জাতিক দর্শকদের কথা মাথায় রেখে তাদেরকে দিয়ে অধিকাংশ সময়ই ইংরেজিতে কথা বলানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন উপলক্ষ্য সৃষ্টি করে তাদের কথপোকথনকে আরবি থেকে ইংরেজিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরোপিত এবং দৃষ্টিকটু বলে মনে হয়েছে। এছাড়াও যখন চরিত্রগুলো আরবিতে কথা বলেছে, তখন ফিলিস্তিনী, লিবিয়ানসহ অন্যান্য দেশিরাও মিসরীয় উচ্চারণে কথা বলেছে, যা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়।

দ্য এঞ্জেল মুভির একটি দৃশ্যে যুদ্ধ পরিকল্পনা করছেন আনোয়ার সাদাত; Image Source: Netflix
দ্য এঞ্জেল মুভির একটি দৃশ্যে এক মোসাদ এজেন্টের সাথে মোসাদ প্রধান জাভি জামির; Image Source: Netflix

চলচ্চিত্রটি ইসরায়েলিদের দ্বারা নির্মিত হওয়ায় এখানে ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে। মূল বইয়ের বাইরে গিয়ে এখানে আশরাফ মারোয়ানের মূল ভূমিকাকেও কিছুটা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আশরাফ মারোয়ান আসলে ইসরায়েলের এজেন্ট ছিলেন, নাকি পুরো সময় ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন, এ ব্যাপারে বইয়ের বাইরে গিয়ে চলচ্চিত্রে ভিন্ন সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে।

গাদ্দাফীকে চিত্রায়ন করার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্রে বাস্তবতার বাইরে গিয়ে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী জীবনে গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে পশ্চিমা পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন অভিযোগ উঠলেও সত্তরের দশকের শুরুর দিকে গাদ্দাফী সরল জীবন-যাপনের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে তাকে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সব মিলিয়ে চলচ্চিত্রটি বেশ উপভোগ্য। কিন্তু এর কাহিনীটি যেরকম অসাধারণ, তাতে আরো ভালো নির্মাণ হওয়া সম্ভব ছিল। দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, নেটফ্লিক্স যদি এটিকে একটি চলচ্চিত্র হিসেবে না বানিয়ে কয়েক পর্বের লিমিটেড সিরিজ হিসেবে বানাতো, তাহলে হয়তো আরো ভালো কিছু হতে পারতো। বর্তমানে এর IMDB রেটিং ৬.৪।  রটেন টমাটোজে এটি সমালোচকদের কাছ থেকে ৮৮% ফ্রেশ এবং ১০ এ ৭.৬ রেটিং অর্জন করেছে। কিন্তু দর্শকদের কাছ থেকে পেয়েছে ৭৩% ফ্রেশ এবং ৫ এ ৩.৬ রেটিং। অন্তত একটি ঐতিহাসিক ঘটনা জানার জন্যও চলচ্চিত্রটি দেখা যেতে পারে। 

ফিচার ইমেজ- Netflix

Related Articles