সংস্কৃতি সংঘবদ্ধ মানুষের চিন্তাধারার অগ্রগতির সাক্ষ্য। তবে সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা সবসময় একই হারে হবে, এমন কোনো কথা নেই। সংস্কৃতির বহমান জলস্রোতও প্রতিকূল সময়ে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হতে পারে। এজন্য সচেতন মানুষ পরিচর্যার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক উত্তরণকে সমাজের প্রগতির অন্যতম নির্ধারক মনে করেন। আবার পরিচর্যার অভাবে সংস্কৃতির প্রবাহ শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে তা মানবতাবিরোধী স্বার্থপর মতবাদ হয়ে যেতে পারে। কখনও তা হয় রাজনীতির নামে, কখনও হয় ধর্মীয় উগ্রতার নামে। যে নামেই হোক, তা মানুষের জন্য অকল্যাণকর।
যে জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যত প্রাচীন, তার সামনে এগোনোর বাধা তত বেশি। ভারতবর্ষের সভ্যতা বহু প্রাচীন। এর সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি সন্দেহাতীত। পাশাপাশি বহুমুখী বৈচিত্র্যের কারণে এখানে বিভেদ কম দেখা যায়নি। তদুপরি নিষ্ঠুর ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব ও সাম্রাজ্যবাদী মনোবৃত্তি প্রবল হয়েছে। ফলে তীব্র হয়েছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। এভাবেই আজকের আরএসএস, শিবসেনা, বজরং দল ও বিজেপির রাজনীতি ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে মহীরুহ হয়েছে। এই ধারার সাম্প্রদায়িক ও উগ্রতার রাজনীতির পেছনে ধর্মীয় মতবাদ যতটা না কাজ করে, তার বেশি কাজ করে বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্ব। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এ ধরনের উগ্রতাকে সমর্থন করার মতো লেখকেরও অভাব নেই। ভারতীয় সাংবাদিক গিরিলাল জৈন এমনই একজন লেখক।
গিরিলাল জৈন (১৯২৪-১৯৯৩) একজন বিখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ দীর্ঘ দশ বছর খ্যাতনামা দৈনিক ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’র প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্মজীবনের শেষ দিকে তিনি ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন। তার লেখা সম্পাদকীয়তে শিখ, খ্রিস্টান ও মুসলিমবিরোধী ঝোঁক তৈরি হয়েছিলো। এই ঝোঁক পরবর্তীতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মৌলবাদ প্রশ্নে তার অবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯৪ সালের ১ ডিসেম্বর তার লেখা বই ‘দ্য হিন্দু ফেনোমেনোন’ প্রকাশিত হয়। যে প্রকারের চিন্তাধারা তার এই বইতে ফুটে উঠেছে, তা সাংস্কৃতিকভাবে ডানপন্থী মতের অনুসারী।
বইটি সম্পাদনা করেছেন গিরিলাল জৈনের কন্যা মীনাক্ষী জৈন। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন,
ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের যে সংখ্যালঘু অংশ হিন্দু পুনরুজ্জীবন ও আত্মশক্তি বৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে রাম মন্দির আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, গিরিলাল জৈন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বলেছেন, ২০০ বছর আগে উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতাগ্রহণ ও স্থানীয় রাজন্যের ক্ষমতাহ্রাস এই হিন্দু জাগরণের সূচনা করে। এর ফলে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ক্ষমতা ভারসাম্যের বহু-আকাঙ্ক্ষিত এক পরিবর্তন ঘটে, যদিও তা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে রামজন্মভূমি আন্দোলন রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ভারতীয় সভ্যতা সংক্রান্ত অমীমাংসিত প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসছে।
মীনাক্ষী আরো লিখেছেন, গিরিলালের মতে, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজবাদী এবং জোটনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করা হয়েছিলো, সভ্যতার প্রশ্নটি না থাকায় তা একসময় তা বিবর্ণ হতে হতে ক্ষীণতর হয়েছে।
বইটি ছয় অধ্যায়ে বিভক্ত। ‘দ্য সিভিলাইজেশন পার্সপেক্টিভ’, ‘এ ইউনিক ফেনোমেনোন’, ‘হিন্দু ন্যাশনালিজম: দ্য ফার্স্ট ফেজ’, ‘রিট্রিট এন্ড রেজ’, ‘দ্য নেহেরুভিয়ান ফ্রেমওয়ার্ক’ ও ‘অযোদ্ধা: এ হিস্ট্রিকাল ওয়াটারশেড।’ গিরিয়াল জৈন একজন আকর্ষণীয় সুলেখক, তার লেখনির প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা বেশ উচ্চাঙ্গের।
প্রথম অধ্যায় ‘দ্য সিভিলাইজেশন পার্সপেক্টিভ’ এ লেখক ভারতীয় সভ্যতা ও তার সাংস্কৃতিক উত্থান-পতনের ঐতিহাসিক বাঁক পরিবর্তনের দিকগুলোর প্রভাব দেখিয়েছেন। এখানে তার সচেতন সংকীর্ণতা চোখে পড়ার মতো। মৌর্য, গুপ্ত, কুষাণসহ অন্য প্রাচীন সাম্রাজ্যকে তাদের নিজস্ব নামেই ডাকা হয়, আধুনিক ইংরেজ আমলকেও তাই। কিন্তু আরব ও তুর্কী আক্রমণকে ‘মুসলিম আক্রমণ’ বলা হয়। কোনো বিশেষ শাসনকে ধর্ম দিয়ে চিহ্নিত করার প্রবণতা ঔপনিবেশিক মনস্তত্ত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার এই যে, লেখক তার ঔপনিবেশিক ঝোঁক লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি, বরং ধর্মাবলম্বী হিসেবে হিন্দুদের শিক্ষিত অংশকে ঐতিহ্যসচেতন করায় এক অর্থে কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছেন। তার মতে,
পশ্চিমের প্রাচ্যতাত্ত্বিক শিক্ষিত সমাজ, যাদের মধ্যে আছেন উইলিয়াম জোনসের মতো পন্ডিত। তারা ভাষাতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, পশ্চিম ইউরোপ ভারতীয় হিন্দি ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে কী গভীর সম্পর্কে জড়িত! তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় হিন্দুরা তাদের হৃত ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। (জৈন ১৯৯৪: ৭)।
ঔপনিবেশিক ভারতে সাম্প্রদায়িকতা, মুসলিম লিগের কার্যকলাপ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাজনৈতিক অবস্থান ও তার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি দেশভাগ নিজের ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন। ফলে আলোচনার ধারাবাহিকতায় চলে আসে স্বাধীন ভারত, হিন্দু জাতীয়তা ও তার সাংস্কৃতিক উত্থানের প্রসঙ্গ।
দ্বিতীয় অধ্যায় ‘এ ইউনিক ফেনোমেনোন’ শুরু হয়েছে জাতীয়তাবাদের পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পরিচয়ের অভিনব দিকটি তুলে ধরার মাধ্যমে। তার মতে, ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের সাথে শুধু বৈশিষ্ট্য ছাড়াও অন্য এক দিক থেকে হিন্দু সভ্যতার বেশ গুরুতর পার্থক্য আছে। সেটি হলো অনেক ভিন্ন ও বিরোধী মতের সমন্বয়ে এর বিকাশ হবার ফলে অভিন্ন সংস্কৃতির আলোকে এর অনুসারীদের একত্রিত করা যায়নি। এছাড়া সাংস্কৃতিক পার্থক্য, যা সভ্যতার দিশা নির্ধারিত করে দেয়, এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন।
সেমেটিক ধর্মের মতো হিন্দু সভ্যতায় প্রেরিত পুরুষের কথা নেই, নেই শেষতম গ্রন্থের কথা। অবতার ও প্রেরিত পুরুষের ধারণা সম্পূর্ণ আলাদা। মৃতকে কবরস্থ না করে চিতায় দাহ করা এই সভ্যতার দেহ-আত্মা সম্পর্কের অনন্যতার উদাহরণ। কারণ হিন্দু সভ্যতা সর্বদা নবায়নে বিশ্বাসী। (জৈন ১৯৯৪: ১৬)
এই বক্তব্যে একটু একপেশে ঝোঁক আছে। চিতায় দাহ করা সাধারণ মানুষের রীতি, অনেক জায়গায় সন্ন্যাসীদের সমাধিস্থ করা হয়। যে ধরনের পরস্পরবিরোধী ঐতিহ্যের কথা বলা হয়েছে, কমবেশি সব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে তা আছে। এজন্য অর্থোডক্স ইহুদীরা আজও কট্টর ইসরায়েল বিরোধী। কারণ সংস্কৃতির ইতিহাস হচ্ছে সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের ইতিহাস। হিন্দু সংস্কৃতি তার থেকে আলাদা নয়। জোর করে আলাদা করতে গেলেই তৈরি হয় মৌলবাদ। অধ্যায়টিতে ধর্মের ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ভারতে হিন্দুত্বের রাজনীতির বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
‘দ্য হিন্দু ন্যাশনালিজম: দ্য ফার্স্ট ফেজ’, ‘রিট্রিট এন্ড রেজ’, ‘দ্য নেহেরুভিয়ান ফ্রেমওয়ার্ক’ অধ্যায়গুলো হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহাসিক উত্থান, স্বাধীন ভারতে সেক্যুলার ও সমাজবাদী নীতির ব্যর্থতা, হিন্দুত্বের চড়াই-উৎরাই ও বাহ্যিক আর অন্তর্গত সংঘাত বেশ অন্তর্দৃষ্টির সাথে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অন্তর্দৃষ্টি মোহমুক্ত না রাখলে তা অকালে সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। এর ফলে জন্ম নেওয়া দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পটভূমি।
ইদানিংকালের ভারতীয় অ্যাকটিভিস্ট ও বক্তা রাম পুন্নিয়ানি ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ভাষ্যের পেছনে দৃষ্টির উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংকীর্ণতা ও তার রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির যোগসাজশ স্পষ্ট ভাষায় বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, প্রাচীন হতে মধ্যযুগ পর্যন্ত ভারতের সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের প্রক্রিয়া ঠেকাতে ঔপনিবেশিক শাসক ও তাদের গুণমুগ্ধ ব্যাখ্যাকারীরা অনেকাংশে সফল।
বইটির শেষ অধ্যায় ‘অযোধ্যা: এ হিস্ট্রিকাল ওয়াটারশেড’ এক হিসেবে বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর পূর্বের অধ্যায়গুলোতে বিশেষ সাংস্কৃতিক দৃষ্টিতে অতীত ও বর্তমান বিশ্লেষিত হয়েছে। কিন্তু এই অধ্যায়ে দেওয়া হয়েছে বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দিরের প্রেক্ষিতে ভবিতব্য সাম্প্রদায়িক ভারতের রূপরেখা। অধ্যায়ের শুরু বেশ আকর্ষণীয়।
ধার করা ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের জন্য অপ্রয়োজনীয়। এর অস্তিত্ব ছাড়াই হিন্দুরা অন্য বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দিয়েছে। খ্রিস্টান ধর্মের ‘এপোস্টেসি’ বা ইসলামের ‘কুফর’ হিন্দু ধর্মে নেই। (জৈন ১৯৯৪: ১১৫)
বক্তব্য হিসেবে শুধু একদেশদর্শী নয়, বেশ অজ্ঞতাপ্রসূত। হিন্দু শাস্ত্রে বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাককে অবৈদিক ও অসুর নীতি বলা হয়। এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ধর্মানন্দ কোশাম্বী ও আম্বেদকারের ঘটনাও। তবুও লেখকের দূরদৃষ্টি বেশ প্রশংসনীয়।
পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক নীতির ব্যর্থতা ও রামজন্মভূমি আন্দোলন একসূত্রে গাঁথা। সমসাময়িক দুটি ঘটনাই ভারতে নেহেরুর সমাজবাদী সেক্যুলার রাষ্ট্রনীতির মরণ মুহূর্তের আভাস। (জৈন ১৯৯৪: ১১৮)
লেখকের মতে, শক্তিমত্ত জাতি হিসেবে আবির্ভূত হতে হলে যে সাংস্কৃতিক প্রতীক প্রয়োজন, পৌরাণিক ‘রাম’ নামে চরিত্রটিই পারে তার জায়গা নিতে। প্রতীক নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ, নাৎসি জার্মানীর শক্তিমত্তা যেমন স্বস্তিকা প্রতীকে প্রকাশিত হতো। লেখকের মতে,
অযোধ্যার ঘটনা থেকে একটি ব্যাপার পরিষ্কার বোঝা যায়। তা হলো, রামজন্মভূমি নিয়ে হিন্দু মানসের আবেগ যত গভীর, অন্য কোনো কিছু নিয়ে তা এত গভীর নয়। তাই বাবরি মসজিদের ঘটনায় প্রশাসন নীরবতা পালনকেই যথার্থ মনে করেছে। ভারত রাষ্ট্র তার সভ্যতার স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হচ্ছে, এই ঘটনা তার সাক্ষী। (জৈন ১৯৯৪: ১৩৫)।
সভ্যতা বিশ্লেষণের এ পদ্ধতি গিরিলাল জৈন একা অবলম্বন করেননি। হিন্দু মহাসভা নেতা বিনায়ক সাভারকর ভারতের মুসলিম ও জার্মানির ইহুদী- এই দুই গোষ্ঠীকে সভ্যতার আবর্জনা বলেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার হিংসাত্মক পরিণতি দেখা গেছে ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকান্ডে। এরপর থেকে ভারতে সাম্প্রদায়িকতা কখনও স্তিমিত হলেও নির্মূল হয়নি। বরং ১৯৯০-এর দশকে আরো শক্তিশালী হয়েছে, এর তাত্ত্বিক ভিত্তি মজবুত হয়েছে। গিরিলাল জৈনের ‘দ্য হিন্দু ফেনোমেনোন’ বইটি তার অগ্রগণ্য উদাহরণ। বইটি আজ অবধি বিজেপির বুদ্ধিবৃত্তিক মেনিফেস্টো হিসেবে মর্যাদা পেয়ে থাকে।
This Bangla article is about the book 'The Hindu Phenomenon' written by Girilal Jain. This book is considered as the bible of BJP.
References:
01. Jain, Girilal, 1994, The Hindu Phenomenon, USB publishers, ISBN: 8186112324