Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দ্য লুমিং টাওয়ার: ৯/১১ এর পেছনের অজানা গল্প

১৯৯৮ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের কথা। আল-ক্বায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের আমন্ত্রণে তার এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার নিতে আফগানিস্তানে ছুটে এসেছেন এবিসি নিউজের সাংবাদিক জন মিলার। চোখ বাঁধা অবস্থায় উঁচুনিচু দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার পর তাকে বহনকারী জিপটি এসে পৌঁছলো আল-ক্বায়েদার গোপন ঘাঁটিতে। একে-৪৭ হাতে আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তাকে স্বাগত জানালো আল-ক্বায়েদার যোদ্ধারা। বিন লাদেন ছাড়াও ঐ ঘাঁটিতে সেদিন উপস্থিত ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী আইমান আল-জাওয়াহিরিসহ আল-ক্কায়েদার অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।

ওসামা বিন লাদেন এর আগেও একাধিকবার বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ভিডিও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি সরাসরি মার্কিন জনগণের উদ্দেশ্যে শেষবারের মতো হুঁশিয়ারি বার্তা উচ্চারণ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি আরব উপদ্বীপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার না করে, তাহলে আল-ক্বায়েদার যুদ্ধ গিয়ে পৌঁছবে আমেরিকার মাটিতে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেরকম মুসলমানদের উপর হামলার সময় নারী-পুরুষ, সামরিক-বেসামরিক লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্য করে না, সেরকম তাদের হামলায়ও যদি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, তাতে তাদের কিছু করার থাকবে না।

জন মিলারের সাথে বিন লাদেনের সাক্ষাৎকারের এই দৃশ্যের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছে বহুল আলোচিত এবং প্রশংসিত ১০ পর্বের লিমিটেড ড্রামা সিরিজ ‘দ্য লুমিং টাওয়ার’ (The Looming Tower), যার কাহিনী শেষ হয়েছে ঠিক ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলা দেখানোর মধ্য দিয়ে। ধারাবাহিকটিতে উঠে এসেছে বিশ্বরাজনীতির গতিপথ বদলে দেওয়া টুইট টাওয়ার হামলার ঘটনার পেছনের গল্প, যার অনেকটাই সাধারণ দর্শকদের কাছে অজানা। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ধারাবাহিকটির কাহিনী রচিত হয়েছে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক লরেন্স রাইটের একই নামের (The Looming Tower: Al Qaeda and the Road to 9/11) বইয়ের উপর ভিত্তি করে, যে বইটিকে আল-ক্বায়েদা এবং ৯/১১ এর উপর লেখা শ্রেষ্ঠ বইগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

দ্য লুমিং টাওয়ারের একটি দৃশ্যে আলবেনিয়াতে আল-ক্বায়েদা সদস্যকে তাড়া করছেন এজেন্ট সুফান; Source: Hulu

দ্য লুমিং টাওয়ার ধারাবাহিকের নায়ক মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এর মুসলিম অফিসার আলি সুফান (Ali Soufan)। লেবানিজ-আমেরিকান অফিসার আলি সুফান ছিলেন আল-ক্বায়েদার একাধিক হামলার প্রধান তদন্তকারী অফিসার। জন মিলারের সাথে সাক্ষাৎকারের কয়েক মাস পরেই যখন আল-ক্বায়েদা পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া এবং তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা করে, তখনই তাকে এফবিআই এর ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। কারণ সেসময় তিনিই ছিলেন সমগ্র নিউইয়র্কে এফবিআই এর আরবি জানা একমাত্র অফিসার। তার আরবি ভাষার উপর দক্ষতা এবং ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে তার সম্যক জ্ঞান ব্যবহার করে তিনি খুব দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন। তিনিই প্রথম দূতাবাস হামলার পেছনে আল-ক্বায়েদার সম্পৃক্ততার প্রমাণ খুঁজে বের করেন।

লরেন্স রাইটের বইয়েরও একটি বড় অংশ জুড়ে বর্ণিত হয়েছে আলি সুফানের কথা। বাস্তব জীবনে আলি সুফান সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন ২০০৫ সালে, যখন তিনি ৯/১১ এর হামলা সম্পর্কে অগ্রীম তথ্য পাওয়ার ব্যর্থতার জন্য সরাসরি সিআইএকে অভিযুক্ত করে এফবিআই থেকে পদত্যাগ করেন। মার্কিন সিনেটে দেওয়া তার স্বীকারোক্তি এবং লরেন্স রাইটের অনুসন্ধান অনুযায়ী, তিনি ৯/১১ এর হামলা ঠেকিয়ে দেওয়ার খুবই কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু শুধুমাত্র সিআইএ আমেরিকায় অবস্থানকারী আল-ক্বায়েদার সদস্যদের তথ্য তার কাছ থেকে গোপন করার কারণেই তার পক্ষে বিমান ছিনতাইকারীদেরকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

দ্য লুমিং টাওয়ারের একটি দৃশ্যে সিআইএ এজেন্ট ডায়ান মার্শ; Source: Hulu

দ্য লুমিং টাওয়ার ধারাবাহিকটি তাই যুক্তরাষ্ট্রের উপর সন্ত্রাসী হামলা এবং সেই হামলার বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর তৎপরতা, বীরত্ব নিয়ে নির্মিত আর দশটি হলিউড অ্যাকশন চলচ্চিত্রের মতো না। এতে প্রচুর অ্যাকশন দৃশ্য আছে সত্য, কিন্তু এটি মূলত মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর ব্যর্থতা এবং সেই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানের একটি প্রচেষ্টা। ধারাবাহিকটির জঁনরা তাই অ্যাকশন বা থ্রিলার নয়, বরং ড্রামা। এটি যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং এফবিআই এর মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনীতিরও একটি বাস্তব চিত্র, যেখানে পরিষ্কারভাবেই সিআইএর রহস্যময় ভূমিকাকে দোষারোপ করা হয়েছে।

দ্য লুমিং টাওয়ারে বিভিন্ন দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে ৯/১১ এর ঘটনার তদন্তের জন্য আয়োজিত মার্কিন সিনেটের শুনানীও উঠে এসেছে। সিনেটের ঐ শুনানীতে আলি সুফান স্বীকার করেছিলেন, হামলার পরবর্তী তদন্তে তিনি প্রমাণ পেয়েছিলেন যে, প্লেন ছিনতাইয়ে জড়িত বেশ কয়েকজন আল-ক্বায়েদা সদস্যের উপর সিআইএ দীর্ঘদিন ধরে নজরদারি করছিল। তারা যে আমেরিকায় অবস্থান করছিল এবং আমেরিকায় বসেই আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে ফোনে আল-ক্বায়েদার অন্যান্য নেতার সাথে যোগাযোগ করছিল, সেটাও সিআইএ জানত। কিন্তু তারা নিজেরাও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বা এফবিআইকেও তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেনি।

দ্য লুমিং টাওয়ারের একটি দৃশ্যে আফগানিস্তানের আল-ক্বায়েদা ঘাঁটিতে দুই সৌদি বিমান ছিনতাইকারী; Source: Hulu

সিআইএ এমনকি মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে সে দেশে ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত আল-ক্বায়েদার গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মেলনের অনেকগুলো ছবিও তুলিয়েছিল, যে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আল-ক্বায়েদার অন্তত দুজন সৌদি সদস্য পরবর্তীতে বিমান ছিনতাইয়ে জড়িত ছিল বলে ভিডিও ফুটেজ থেকে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। আলি সুফানের অভিযোগ, ঐ ছবি এবং তথ্যগুলো যদি সিআইএ গোপন না করে এফবিআই এর সাথে শেয়ার করত, তাহলে ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলা কখনোই আলোর মুখ দেখতে পেত না। সিআইএ’র এই রহস্যজনক ভূমিকার কারণও অবশ্য উঠে এসেছে দ্য লুমিং টাওয়ারে, তবে সেটা আপনি জানতে পারবেন ধারাবাহিকটি দেখার পর।

দ্য লুমিং টাওয়ার ধারাবাহিকটিতে কেনিয়া-তাঞ্জানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে হামলা ও ইয়েমেনে ইউএসএস কোল হামলা দুটো এবং হামলায় জড়িত আল-ক্বায়েদা সদস্যদের পেছনের গল্প বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে কেনিয়ার হামলার দৃশ্যায়নটি ছিল চমৎকার। ওসামা বিন লাদেনকে সরাসরি দেখানো না হলেও সিরিজটির বিশাল অংশ জুড়ে দেখানো হয়েছে আল-ক্বায়েদার উপপ্রধান এবং বর্তমান প্রধান আইমান আল-জাওয়াহিরিকে। জাওয়াহিরি চরিত্রে অভিনয় করা মিসরীয়-আমেরিকান অভিনেতা নাসের ফারিস এর মেকআপ এমনভাবে করা হয়েছে, যার সাথে আসল জাওয়াহিরির চেহারার পার্থক্য খুবই কম।

দ্য লুমিং টাওয়ারের একটি দৃশ্যে আফগানিস্তানের আল-ক্বায়েদা ঘাঁটিতে আইমান আল-জাওয়াহিরি; Source: Hulu

সিরিজটিতে বিভিন্ন আরবীয় চরিত্রের জন্য সত্যি সত্যিই আরব বংশোদ্ভূত অভিনেতাদেরকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের ভাষাও চয়ন করা হয়েছে বাস্তবের সাথে মিল রেখেই, যার ফলে ধারাবাহিকটি অনেক বেশি বাস্তবসম্মত হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি হাইজ্যাকারদের সবাই এখানে উপসাগরীয় (খালিজী) উচ্চারণে আরবি বলে। বিন লাদেনের ইয়েমেনি বডিগার্ড নাসের আল-বাহরি তথা আবু জান্দাল ইয়েমেনি উচ্চারণে আরবি বলে। জাওয়াহিরি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয় শুদ্ধ আরবিতে, কিন্তু আবার যখন ঘনিষ্ঠদের সাথে কথা বলে তখন মিসরীয় উচ্চারণে আরবি বলে।

আলি সুফান (অভিনয়ে তাহার রাহিম) এবং আইমান আল-জাওয়াহিরি ছাড়াও দ্য লুমিং টাওয়ারে উঠে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর মধ্যে একটি হলো সুফানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এফবিআই এর ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান এবং কাউন্টার টেরোরিজম বিশেষজ্ঞ জন ও’নীল, যিনি ৯/১১ হামলায় নিহত হয়েছিলেন। চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন খ্যাতিমান অভিনেতা জেফ ড্যানিয়েলস। অন্যান্য বিখ্যাত চরিত্রের মধ্যে আছে সিআইএ’র পরিচালক জর্জ টেনেট (অভিনয়ে অ্যালেক বাল্ডউইন), ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রধান কাউন্টার টেরোরিজম উপদেষ্টা রিচার্ড ক্লার্ক (অভিনয়ে মাইকেল স্টালবার্গ), মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎসা রাইস (অভিনয়ে এইসা ডেভিস)।

দ্য লুমিং টাওয়ারের একটি দৃশ্যে সিনেট শুনানিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিসা রাইস; Source: Hulu

আল-ক্বায়েদার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্যে উঠে এসছে মিসরীয় হাইজ্যাকার মোহাম্মদ আতা, সৌদি হাইজ্যাকার খালিদ আল-মেহধার ও নাওয়াফ আল-হাজমি, ৯/১১ এর মূল পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মোহাম্মদ, বিন লাদেনের বডিগার্ড এবং একাধিক হামলার সমন্বয়ক ওয়ালিদ বিন আত্তাশ (খালাদ), দূতাবাস বম্বিং এর হোতা আবু আনাস আল-লিবীসহ আরো অনেকে। এছাড়াও ধারাবাহিকটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি চরিত্র সিআইএ’র অ্যালেক স্টেশনের (বিন লাদেন ইউনিট) মার্টিন শ্মিট (পিটার সার্সগার্ড) এবং ডায়ান মার্শ (রেন শ্মিডট)। বাস্তবে অবশ্য এই দুই নামে কেউ ছিল না। এই চরিত্র দুটো সিআইএ’র একাধিক এজেন্টের চরিত্রের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে।

আফগানিস্তান, ইয়েমেন, কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশের জায়গাগুলোকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য দ্য লুমিং টাওয়ারের শ্যুটিং করা হয়েছে বিশ্বের তিনটি মহাদেশের ছয়টি দেশ জুড়ে। আফগানিস্তানের দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে পাকিস্তানে, ইয়েমেনেরগুলো মরক্কোতে এবং কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ারগুলো দক্ষিণ আফ্রিকায়। এছাড়াও দৃশ্যগুলোকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য শ্যুটিংয়ে ধারণকৃত দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে অরিজিনাল ভিডিও ফুটেজ, যার ফলে ধারাবাহিকটি দেখার সময় অনেক সময়ই প্রামাণ্যচিত্র দেখার অভিজ্ঞতা তৈরি হতে পারে।

দ্য লুমিং টাওয়ারের একটি দৃশ্যে এডেন বন্দরে মার্কিন যুদ্ধে জাহাজে হামলার উদ্দেশ্যে যাচ্ছে আল-ক্বায়েদার আত্মঘাতী সদস্যরা; Source: Hulu

দ্য লুমিং টাওয়ারের একটাই ত্রুটি চোখে পড়ে, এখানে কয়েক মাসব্যাপী সংঘটিত তদন্ত কার্যক্রমকে সংক্ষেপে মাত্র কয়েক মিনিটে দেখানোর চেষ্টা করার ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। তবে তা সত্ত্বেও দ্য লুমিং টাওয়ার ধারাবাহিকটি সমালোচকদের বেশ প্রশংসা অর্জন করেছে। আইএমডিবিতে এর রেটিং ৭.৯। রটেন টমাটোজ ওয়েবসাইটে ৪৭ জন সমালোচকদের ভোটে এটি ৯৬% ফ্রেশহুলু নেটওয়ার্কে প্রচারিত সিরিজটির দ্বিতীয় সিজন মুক্তি পাবে কিনা, তা অবশ্য এখনও নিশ্চিত করা হয়নি। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান নিয়ে পরবর্তী সিজন নির্মাণের ব্যাপারে নির্মাতারা এর মধ্যেই আলোচনা শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।

ফিচার ইমেজ- pinoyexchange.com

Related Articles