এমন একটি সিনেমার কথা ভাবুন তো, যেখানে উত্তেজনায় ভরপুর কোনো দৃশ্য নেই, কাহিনীতে আহামরি কোনো নাটকীয়তা নেই, সাসপেন্স নেই, থ্রিল নেই, তেমন কোনো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নেই, সমাপ্তিতে কোন বিদুরতা কিংবা প্রসন্নতা নেই। তবুও এক অজানা মুগ্ধতায় আপনার চোখ পর্দায় আটকে আছে, আপনি অপলক চেয়ে আছেন। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য জীবন্ত হয়ে আপনার মানসপটে রেখা এঁকে যাচ্ছে। খুব স্বাভাবিক ব্যাপারটিও আপনি অসাধারণভাবে উপলব্ধি করছেন, আশপাশের খুব ছোটখাটো আচরণগুলো নিয়েও আপনি নতুনভাবে সব ভাবছেন। শেষ মিনিটটিতে পর্যন্ত আপনি উঠতে পারছেন না।
যারা ইরানি চলচ্চিত্র নিয়মিত দেখেন, তারা বুঝতে পারবেন, সিনেমার প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে অত্যন্ত খুঁটিনাটি বিষয়- যেমন, এক জোড়া জুতা, কিছু মাছ বা একটি পাখি, একজন বধির বালক কিংবা একটি উটপাখি নিয়েও কীসব অনবদ্য সিনেমা তৈরি করা যায়। প্রচলিত সিনেমা ধারার বাইরে এ ধরনের জীবনঘনিষ্ঠ কিন্তু চিত্তাকর্ষক চলচ্চিত্র তৈরি করতে সিদ্ধহস্ত ইরানি পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম হলেন মাজিদ মাজিদী। সিনেমাপ্রেমীদের কাছে নামটি খুব অপরিচিত নয়। 'বারান', 'কালার অভ প্যারাডাইস', 'দ্য সান', 'দ্য উইলো ট্রি'-এর মতো হৃদয়গ্রাহী সিনেমাগুলোর স্রষ্টাও তিনি। আজকের লেখার আলোচ্য সিনেমা 'দ্য সং অভ স্প্যারোস'ও এ পরিচালকের একটি অনবদ্য সৃষ্টি। এটি যেন এক সিনেম্যাটিক মহাকাব্য।
২০০৮ সালে এটি মুক্তি পায় পার্সি 'Avaze gonjeshk-ha' নামে। ক্রিপ্ট লিখেছেন পরিচালক মাজিদ মাজিদী নিজে এবং মেহরান কাসানি। এ সিনেমায় করিম নামে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাজিদীর সিনেমার বহুল পরিচিত মুখ- রেজা নাজি।
প্রধান চরিত্র করিম (রেজা নাজি) বসবাস করেন তেহরানের অদূরে একটি গ্রামে। একটি উটপাখির খামার দেখাশোনা করে তিনি যে আয় করেন, তা দিয়ে কোনোভাবে চালিয়ে নেন পরিবারের খরচ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে খামার থেকে একটি উটপাখি পালিয়ে গেলে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে চাকরি হারান তিনি। বেকার, তবুও মেয়ের হিয়ারিং ডিভাইসটি ঠিক করা চাই। সে উদ্দেশ্যে জরাজীর্ণ মোটর সাইকেলটি চালিয়ে তেহরান শহরে গিয়ে করিম আবিষ্কার করেন উপার্জনের নতুন পথ। শুরু করেন মোটর সাইকেলে যাত্রী পরিবহন। নিতান্ত গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা সহজ-সরল করিমকে গ্রাস করতে থাকে শহরের কৃত্রিমতা। স্বার্থপরতার করাল গ্রাসে করিম হয়ে পড়েন এক যান্ত্রিক মানব।
অকেজো পড়ে থাকা একটি দরজা করিমের স্ত্রী প্রতিবেশীকে দিয়ে দিয়েছিল। সেটি ফেরত নিয়ে আসতেও করিম দ্বিধা করেন না। পরিত্যক্ত কূপে ছেলের মাছ পোষার মতো ছোটখাটো আবদারও তার কাছে গুরুত্ব পায় না৷ বরং শহরের পরিত্যক্ত জঞ্জালই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এসবে কোনো অলৌকিকত্ব আছে ভেবে করিম নিজের গ্রামের বাড়ির পরিচ্ছন্ন আঙ্গিনাকে ভরিয়ে তোলেন সেসব জঞ্জাল দিয়ে। ঠিক যেমনটি করিমের ব্যক্তিত্বের সাদাসিধে দিকটি চাপা পড়ে যায় নাগরিক কৃত্রিমতা আর স্বার্থবাদী চিন্তার নিচে।
কিন্তু একটি দুর্ঘটনায় আঙ্গিনার সে জঞ্জালের নিচেই চাপা পড়েন করিম এবং মারাত্মক আহত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যান। এরপর শুরু হয় তার শারীরিক সুস্থতা অর্জনের প্রক্রিয়া। ফাঁকে ফাঁকে হয়তো শহুরে জড়বাদে চাপা পড়া করিমের সহজ-সরল মনটিও পুনর্বাসিত হতে শুরু করে।
করিম কি পারবেন পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে? কূপে মাছ চাষ করে মিলিওনিয়ার হতে চাওয়া করিমপুত্রের স্বপ্নের শেষটা কেমন হবে? করিমের মেয়েটি কি একটি নতুন হেয়ারিং ডিভাইস পাবে? প্রতিবেশিরা কি বুকে টেনে নেবে অসুস্থ করিমকে, কিংবা হারিয়ে যাওয়া সে উটপাখিটি কি ফিরে আসবে কখনো? করিমের সহজ-সরল মনটিও কি ফিরবে আর সেই চেনা নীড়ে?
এরকম খুব ছোটখাটো, কিন্তু সিনেমার প্রেক্ষাপটে বিশাল হয়ে ওঠা প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়ে এগোতে থাকে 'দ্য সং অভ স্প্যারোস' সিনেমার কাহিনী।
পুরো সিনেমা জুড়ে ছিল করিমের দু'টি বিপরীতমুখী সত্তা। মানবিকতা এবং আধুনিকতা। পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যারা বিচরণ করেছে সিনেমার কাহিনী জুড়ে। প্রচলিত সিনেমায় নাটকীয়তা-সাসপেন্স-থ্রিল বলতে যা বোঝায়, তেমন কিছুই এতে নেই। তবুও কাহিনীর একটি যাদুকরী প্রবাহমানতা দর্শককে আটকে রাখবে শেষ অবধি। এ যেন একটি অখণ্ড জীবনকাব্য।
কাহিনীর সাথে সাথে চিত্রায়নে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। ছোট ছোট পাহাড়, পাহাড়ের গা ঘেঁষে নকশিকাঁথার মতো দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা পিচঢালা পথ, পথের দু'ধারে গাছের তোরণ, করিমের ছায়াঘেরা গ্রামের বাড়ি, বাড়ির চারপাশের ফসলের মাঠ, মাঠের মাঝে সেই ছোট্ট কূপ, যাকে ঘিরে করিমের ছেলে মিলিওনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন বুনেছিল। কিংবা যেখানে করিমে বধির মেয়েটির হিয়ারিং ডিভাইসটি পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এই সবকিছুই যেন সিনেমাটিতে একটি স্বপ্নিল আবহ সৃষ্টি করেছে, যার তালে তালে দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো আন্দোলিত হবেন। মাজিদ মাজিদির স্বভাবজাত সিনেম্যাটোগ্রাফিক দক্ষতায় তা আরো মোহময় হয়ে উঠেছে।
সিনেমাটি দেখে দর্শকের মনে হতে পারে, এটি অনেকটা আধুনিকতা বিরোধী। কিন্তু আসলে কি তা-ই? এক্ষেত্রে স্বয়ং পরিচালকের ভাষ্যটি এরকম,
"সিনেমাটি দ্বারা আমি আধুনিকতার বিরোধিতা করিনি। মানুষের কল্যাণের জন্য আধুনিকতা অপরিহার্য। কিন্তু মানুষ প্রায়ই এই আধুনিকতার কাছে পরাজিত হয়। বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা, ভালোবাসা, নৈতিকতার মতো মৌলিক মানবিক গুণগুলো তার কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সিনেমাটির মাধ্যমে আমি এই বার্তাটি দিতে চেয়েছি যে, দিনশেষে অবশ্যই আমাদেরকে আমাদের মৌলিক মানবিক গুণাবলির কাছেই ফিরে যেতে হবে।"
সিনেমার এই আদর্শিক দিকটি পরিচালক যেমন ধারণ করেছেন, ঠিক তেমনি দুর্দান্ত অভিনয়শৈলীর মাধ্যমে এ আদর্শকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে অভিনেতাদের কৃতিত্ব কোনো অংশে কম নয়। বিশেষত করিম চরিত্রটিকে রেজা নাজি অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মুভিতে করিমের বধির মেয়ে হানিয়ের চরিত্রটিতে শবনম আখলাগির অভিনয় দেখে মেয়েটির প্রতি দর্শক একটি পবিত্র স্নেহে আবিষ্ট হবেন। এছাড়া করিমের স্বপ্নবিলাসী ছেলে হোসেনের চরিত্রে হামেদ আগাজি নামক ছোট্ট বালকটির অভিনয় দেখে খুব কম দর্শকই হয়তো অশ্রু সংবরণ করতে পারবেন।
এছাড়া নিখুঁত সম্পাদনা, অর্থবহ উক্তি, প্রশান্ত সুরসংযোগ- সবমিলিয়ে সিনেমাটি একটি চিরন্তন জীবনদর্শনের প্রতিচিত্রে রূপ নিয়েছে। শেষের দিকে করিমের বেসুরো গানটিতেও যেন সে দর্শনের কথাই ঠিকরে পড়ে,
"আমাদের ফুলগুলো বিবর্ণ হয়েছে,
আমাদের চোখগুলো অশ্রুসিক্ত,
বিশাল আকাশের লাঠির আঘাতে আমাদের হৃদয় জর্জরিত।
তাই আমরা অতীতের সুন্দর দিনগুলোর কথা ভাবি।
এই পৃথিবী একটি প্রপঞ্চ, এ পৃথিবী একটি স্বপ্ন।"
This article is in Bangla. It is a movie review of 'The Song of Sparrows' directed by Majid Majidi.
Necessary references have been hyperlinked inside the article.
Featured Image: Reading Films