দেশের জন্য কাজ করা আর ক্ষমতাসীন দলের তাঁবেদারি করা কি একই জিনিস? পার্ক যখন এই প্রশ্ন করে, তখন গোয়েন্দাগিরির জটিল খেলায় সে সিদ্ধহস্ত হয়ে গেছে। বুঝতে পেরেছে এখানে নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করা যায় না। সবাই মুখে দেশপ্রেমের বুলি আওড়ালেও অন্তরে থাকে নিজের আখের গোছানোর খায়েশ। সাউথ কোরিয়ান স্পাই ফিল্মে আমরা একচেটিয়াভাবে অ্যাকশনের রাজত্ব দেখে অভ্যস্ত। গল্পের ক্ষেত্রে সাধারণত কোনো সাউথ কোরিয়ান আন্ডারকাভার এজেন্টকে নর্থ কোরিয়ায় আটকা পড়তে দেখি। অথবা দেখা যায় কোনো নর্থ কোরিয়ান স্পাই সাউথ কোরিয়ায় মিশনে এসেছে। আবার দুই দেশের স্পাইরা মিলে কোনো আশু বিশালাকার গোলযোগ ঠেকিয়ে দিচ্ছে, এমনটাও চোখে পড়ে।
এগুলোতে থাকে বৃহদাকার অ্যাকশন সেট পিস, হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট, অস্ত্র আর গোলাবারুদের ঝনঝনানি। এদিক থেকে দেখতে গেলে ইউন জং-বিনের দ্য স্পাই গন নর্থ স্পাই জনরায় মৌলিক একটি প্রচেষ্টা। ২০১৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমার গল্প অনুপ্রাণিত হয়েছে সাউথ কোরিয়ার ইতিহাসের অন্যতম সেরা কোভার্ট বা গুপ্ত অপারেশন থেকে। যা ক্লিশে হওয়ার সম্ভাবনা দূর করে সুগম করেছে এটির বাস্তবিক এসপিওনাজ থ্রিলার হবার পথ।
১৯৯৩ সালে সংবাদ মাধ্যমের বরাতে জানা যায় এক ভয়াবহ খবর। উত্তর কোরিয়া প্রতিষ্ঠা করেছে এমন এক রিয়্যাক্টর প্ল্যান্ট, যার মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন করা সম্ভব। এই খবরে নড়েচড়ে বসে দক্ষিণের রাষ্ট্রযন্ত্রের কর্তাব্যক্তিরা; ভয়, শঙ্কা আর উৎকণ্ঠার মেঘ আবারও ঘিরে ধরে কোরীয় উপদ্বীপকে। সংবাদমাধ্যমের খবর যদি সত্যি হয়, তাহলে এই উপদ্বীপে আরো একবার পালাবদল হবে কর্তৃত্বের ব্যাটন; পরিবর্তন হবে ক্ষমতার শ্রেণীবিন্যাস।
নর্থের কাছে আসলেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে কিনা, থাকলেও তা কোন পর্যায়ে— এসবের সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে একটি ফন্দি আঁটেন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রধান, চোই হাক-সাং (চো জিন-উং)। ফলে দৃশ্যপটে আসেন সিনেমার মূল চরিত্র পার্ক সুক-ইয়ং (হোয়াং জাং-মিন)। ডিফেন্সিভ ফোর্সেসের প্রাক্তন সদস্য পার্কের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারি না আমরা। তার মিশন উত্তর কোরীয় শহর ইয়ংবাইঅন থেকে গোপনে সংবাদ সংগ্রহ এবং তা নিজ দেশে পাচার করা। ঐ শহরেই খবরে কথিত নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের অবস্থান।
পার্ককে কোডনেম দেওয়া হয় ব্ল্যাক ভেনাস। কেবল নিজের স্বার্থ দেখা ব্যবসায়ীর বেশ ধরে সে চলে যায় বেইজিং। কেননা, সেখানে উত্তর কোরীয়দের উপস্থিতি রয়েছে। প্রেসিডেন্ট কিম জং-ইলের অনুমতিপ্রাপ্ত এসব উত্তর কোরীয়দের দায়িত্ব— অর্থ এবং বাণিজ্যের সংস্থানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। বেইজিংয়ে গিয়ে পার্ক চেষ্টা করে রি মাইয়ং-উন এবং চীফ জং-এর সান্নিধ্যে আসতে। এরা উভয়ে যথাক্রমে উত্তরের ইকোনমিক কাউন্সিল এবং স্টেট সিকিউরিটির প্রধান। কিমের দলেও এদের প্রভাব বেশ জোরালো। এরা হতে পারে তার উত্তর কোরিয়া যাওয়ার টিকেট। পার্কের ছদ্মবেশ প্রতিস্থাপন করতে বেশ খানিকটা সময় কেটে যায়। তার কানের সাথে যেন ফোনের রিসিভার জোড়া লেগে যায়। আসে কলের পর কল। নিজের হোটেলে চুল স্থাপন করতে দেখা যায় তাকে, এমনকি আখরোট নিয়ে আন্তর্জাতিক এক ঝামেলাও পাকিয়ে বসে সে।
বারবার নির্জনতাপ্রিয় প্রতিবেশী দেশে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে চায় পার্ক। তাই সে প্রস্তাব করে একটি অ্যাডভার্টাইজিং ক্যাম্পেইনের। যার মাধ্যমে দক্ষিণের পণ্যের বিজ্ঞাপন ধারণ করা হবে উত্তরে। এই ক্যাম্পেইনের বাড়তি সুবিধাও রয়েছে। এতে করে একদিকে যেমন উত্তরের অর্থনীতির উন্নতি হবে, তেমনিভাবে উভয় দেশের মাঝে বিরাজমান শত্রুতার বরফও গলবে। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর নিজেকে উত্তর কোরিয়ার বিশ্বস্ত গন্ডিতে স্থাপন করতে সমর্থ হয়। এরপর ধীরে ধীরে বাইতে শুরু করে সেখানকার রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মই। কিন্তু এতকিছুর পরও পূর্ণ শান্তি সে পায় না। নিজ দেশের, বিশেষ করে নিজের সংস্থার কর্তাব্যক্তিতের মূল লক্ষ্যের ব্যাপারে তাকে সন্দিহান হতে দেখা যায়। এরপর কী হয় তা জানতে হলে দেখতে হবে ১৩৭ মিনিট দৈর্ঘ্যের সিনেমাটি।
অন্যান্য কোরিয়ান স্পাই থ্রিলারগুলোকে যদি এক্সট্রিম আউটডোর স্পোর্টসের সাথে তুলনা করা হয়; তাহলে এটিকে তুলনা করা যায় সাসপেন্সে ভরপুর দাবা খেলার সাথে। যেখানে একটি ভুল চালে শুরু হয়ে যেতে পারে ৩য় বিশ্বযুদ্ধের মতো মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। টিপিক্যাল কোরিয়ান স্পাই থ্রিলারের ভক্ত হলে হয়তো কিছুটা নিরাশ হতে হবে। কারণ ফুল স্কেলের অ্যাকশন সিকোয়েন্স এখানে অনুপস্থিত। তবে অ্যাকশনের জায়গায় এখানে রয়েছে চরম উৎকণ্ঠা আর অস্থিরতায় ভরা কনভারসেশন বেইজড সিকোয়েন্স। এদিক থেকে প্রখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক জন লা ক্যারের গ্রন্থের মত মনে হয় এটিকে।
যেসব দৃশ্যাবলীতে কিং জং-ইল উপস্থিত, সেগুলো নেইল বাইটিং সাসপেন্সের অনুভূতি দেবে দর্শককে। উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশের পূর্বে পার্ককে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। চলচ্চিত্রটিকে কোনোভাবে ধীর গতির বলার অবকাশ রাখেননি পরিচালক। তার গল্প বলায় আর্জেন্সি ছিল পুরোটা সময়, প্লটও এগিয়েছে দ্রুতলয়ে। ইউনের গল্প বলার গতিকে ত্বরান্বিত করতে আর দর্শকের হৃদপিণ্ডের গতিকে বাড়িয়ে দিতে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছে চো ইয়ং-উক রচিত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। ওল্ডবয় (২০০৮) এর সংগীতায়োজনেও তিনি ছিলেন। একটি স্পাই থ্রিলারের জন্য যেরকম প্রয়োজন; ঠিক সেরকম আবহ বিনির্মাণে সহায়তা করেছেন তিনি।
ইয়ুনের আগের কাজগুলোতে প্রেক্ষাপট ছিলে পূর্ববর্তী দশকের। তাতে তিনি উৎরেছেন সাফল্যের সাথে। এবারের প্রোজেক্টেও তিনি সাফল্যের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। সিজিআই-এর ব্যবহারে দক্ষিণ এবং উত্তর কোরিয়া ও চীনের নব্বইয়ের দশকের বাস্তবিক প্রতিরূপ ফুটে উঠেছে পর্দায়। এক্ষেত্রে সিংহভাগ কৃতিত্বের দাবিদার চোই চ্যান-মিনের সিনেম্যাটোগ্রাফি। বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার সুপ্রশস্ত রাস্তা আর বিরান মাঠঘাটের যে ধরনের ধূসর চিত্র আমরা টিভির পর্দায় দেখি; ঠিক সেরকম চিত্রই ফুটে উঠেছে মুভিতে। এছাড়া দুই দেশের সম্পর্ক আর পুনর্মিলনী সংক্রান্ত যেসকল বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে, তা পরিচালকের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সহমর্মি মনোভাবের পরিচয় বহন করে।
ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির তুরুপের তাস যেমন পার্ক, তেমনি দ্য স্পাই গন নর্থের তুরুপের তাস এর কাস্টিং। হোয়াং জাং-মিন দক্ষিণ কোরীয় বক্স অফিসের হটকেক৷ সেদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসা-সফল পাঁচটি সিনেমার দুটিতে তাকে দেখা গেছে। স্টারডমের পাশাপাশি অভিনয় শৈলীতেও তিনি অসাধারণ। যার প্রমাণ এই সিনেমায় তার পারফরম্যান্স। অকুতোভয় দেশপ্রেমিক, মুখরা ব্যবসায়ী বা নৈতিকতা আর রাজনীতির টানাপোড়েনে আটকে পড়া ব্যক্তি; পার্কের চরিত্রের তিনটি দিকেই তিনি সমানতালে সাবলীল। মিন যোগ্য সহায়তা পেয়েছেন চো জিন-উক আর জু জিন-হুনের কাছ থেকে। দক্ষিণ কোরীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আর উত্তর কোরীয় স্টেট সিকিউরিটির প্রধানরূপে— দুজনে দেখিয়েছেন নিজেদের মুন্সিয়ানা। যখন খোলস সরে যায়, তখনও তাদের অভিনয় একদম পিন পয়েন্ট অ্যাকুরেট।
তবে সিনেমায় সম্ভবত নিজের ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম্যান্স দিয়েছেন লী সাং-মিন। এতকাল ধরে কেবল সহযোগী চরিত্র রূপায়ন করা অভিনেতা ২০১৮ সালে প্রকাশ করেন নিজের স্বরূপ। হোয়াংয়ের মত ক্যালিবারের অভিনেতার সাথে টেক্কা দিয়েছে তার রি মাইয়ং-উক। ক্যাপিটালিস্টদের অর্থনীতি পড়া বিচক্ষণ, সাহসী ইকোনমিক কাউন্সিলের প্রধানরূপে সকল দৃশ্যে লাইম লাইটের আলো টেনে নিয়েছেন নিজের দিকে।
নিজের সিনেমার মুক্তি দেওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় বেছে নিয়েছিলেন ইয়ুন। দ্য স্পাই গন নর্থ মুক্তির একমাস আগে দক্ষিণ আর উত্তর কোরীয় কর্তা-ব্যক্তিরা একটি বৈঠকে মিলিত হন। উদ্দেশ্য ছিল— দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারকরণ। যা প্রতিধ্বনিত হয়েছে সিনেমার মূল বক্তব্যে। আমরা যারা কোরিয়ান উপদ্বীপের রাজনৈতিক প্রবাহের ব্যাপারে অবগত নই, তারা হয়তো শুরুতে একটু ধন্দে পড়তে পারি। তবে একবার কে কোন দলে এবং কী চায় বুঝে গেলে; ইয়ুনের স্ক্রিপ্টই সিনেমার ভেতরে টেনে নিয়ে যাবে। তাই ক্লিশে কোরীয় স্পাই থ্রিলার দেখে খানিকটা বিরক্তি চলে আসলে, এটি হতে পারে ক্লান্তি হারী। যে সিনেমার মাধ্যমে পরিচালক স্মরণ করেছেন সেসকল নামবিহীন, কোডনেমধারী হিরো বা ভিলেনদের। যাদের অবদানে দুই কোরিয়ার সম্পর্কে এসেছে ইতিবাচক মোড়।
The article is in Bangla. It is a review of the South Korean film The Spy Gone North (2018).
References:
1. The Spy Gone North | Wikipedia
2. The Spy Gone North (2018) | IMDb
3. The Spy Gone North | Rotten Tomatoes
Featured Image: eontalk.com