Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তিথিডোর: নিঃসঙ্গতার কাব্যিক অনুভূতিময় এক আখ্যান

বাংলা সাহিত্যে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জয়জয়কার, যারাই কিছু সৃষ্টি করতে চাইছেন, রবীন্দ্রবলয় থেকে বের হয়ে তাদের পক্ষে নতুন কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। ঠিক তেমনই এক সময়ে তিরিশের দশকে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধূমকেতুর মতো আগমন ঘটল পাঁচজন নতুন কবির। তাঁরা জন্ম দিলেন বাংলা আধুনিক কবিতার।

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁরা ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তাঁর প্রভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করার দুঃসাহস দেখানো সেই পাঁচজন কবির একজন বুদ্ধদেব বসু।

সাহিত্যজীবনের শুরু থেকেই তিনি সাহিত্যের প্রচলিত ধারাগুলোকে নানাভাবে ভাঙতে চেয়েছেন, সৃষ্টি করতে চেয়েছেন নতুন কিছু। তাই তাঁর নিরীক্ষাধর্মী অনিসন্ধিৎসু মনের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সমগ্র সৃষ্টিতে।

বুদ্ধদেব বসু; Image Source: alchetron.com

নাগরিক মধ্যবিত্ত মানুষের পরিবার জীবনের স্নিগ্ধতা, ব্যক্তিজীবনের হাহাকার ও নিঃসঙ্গতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর বিপন্ন সময় দ্বারা প্রভাবিত মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে কেন্দ্র করে লিখিত একটি অত্যন্ত কোমল ও কাব্যিক উপন্যাস বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’। এ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।

উপন্যাসটির সূচনা হয়েছে রাজেনবাবুকে কেন্দ্র করে এবং মূলগল্প বিকশিত হয়েছে তাঁর কন্যা স্বাতী এবং প্রফেসর সত্যেনের স্নিগ্ধ প্রেম আখ্যান নিয়ে। পাশাপাশি পুরো উপন্যাস জুড়ে চল্লিশের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের বহুমাত্রিক চিত্র অত্যন্ত মমতার সাথে উঠে এসেছে। সময়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া বাঙালি জীবনের মাধুর্যময় এক অংশকে চিত্রিত করে এ উপন্যাসটি বিশেষ মাহাত্ম্য অর্জন করেছে।

এ প্রসঙ্গে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত, “কলকাতার ছা-পোষা মধ্যবিত্ত জীবনের যা কিছু গৌরব, তার যা কিছু সততা-সমস্তের আশ্চর্য পরিবারকেন্দ্রিক চিত্র ‘তিথিডোর’। এই উপন্যাসকে যে স্নিগ্ধ দিনগুলি আর একটু পরেই বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলল, তার শেষ অকৃত্রিম চিহ্ন হিসেবে আমরা মনে রাখব।”

“তিথিডোর” বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: নিউ এজ পাবলিশার্স

তিনটি ভাগে ভাগ করে লেখক এ উপন্যাসের পুরো গল্পটি বলেছেন- ‘প্রথম শাড়ি: প্রথম শ্রাবণ’, ‘করুণ রঙিন পথ’ এবং ‘যবনিকা কম্পমান’।

রাজেনবাবু ও শিশিরকণার সংসারে ধীরে ধীরে জন্ম নিল পাঁচ কন্যা ও এক পুত্র। মেয়েরা হলো শ্বেতা, মহেশ্বেতা, সরস্বতী, শাশ্বতী ও স্বাতী এবং একমাত্র ছেলে বিজন। বড় তিন মেয়ের সময়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেল আর অসুস্থ শিশিরকণা একসময় পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। রাজেন বাবুর স্নেহে বাকি তিন পুত্র-কন্যা বড় হতে লাগল। বড় তিন কন্যা তাদের স্বামীদের, শ্বেতা ও প্রথমেশ, মহাশ্বেতা ও হেমাঙ্গ এবং সরস্বতী ও অরুণ, সাথে শ্বশুরবাড়িতে দিন কাটাতে থাকল।

রাজেনবাবুর সবচেয়ে ছোট মেয়ে ছিল স্বাতী এবং স্বাতীর চিন্তাজগতের বিবর্তন ও ভালবাসা নিয়ে এ উপন্যাসের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। কন্যা শাশ্বতীরও একসময় বিয়ে হয় রাজনীতি সচেতন কমিউনিস্ট হারীতবাবুর সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ উপন্যাসের বড় একটি অংশ আবর্তিত হলেও বিশ্বযুদ্ধ এ উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে স্পর্শ করতে পারেনি। শাশ্বতীর স্বামী হারীতবাবুর কথার ঝনঝনানিতে হিটলার, জাপানের আক্রমণ, বার্মা দখল এই শব্দগুলো শোনা গেছে বারবার। স্থান-কাল-পাত্র চিন্তা না করে সবার সাথে রসহীন রাজনৈতিক আলোচনা এবং সাংসারিক মানুষের রাজনৈতিক জ্ঞানহীনতার জন্য তাদের প্রতি অবজ্ঞা- হারীতবাবুর এসব বৈশিষ্ট্য হাস্যকর এবং তার প্রতি করুণার জন্ম দেয়। হারীতের খেয়ালীপনার জন্য ধীরে ধীরে তাদের মাঝে বিচ্ছিন্নতার দেয়াল গড়ে উঠেছে। নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে তাদের দাম্পত্য এ উপন্যাসের অন্যতম প্রধান অংশ হয়ে উঠেছে।

আজকাল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত “তিথিডোর” বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: রকমারি

রাজেনবাবুর একমাত্র পুত্র অবাধ্য বিজনের বহু চেষ্টাতেও ম্যাট্রিকটা পর্যন্ত পাস হল না। মা মরা পরিবারে স্বাতীর বেড়ে ওঠা, রাজেনবাবুর স্নেহের ছায়া, বিজনের খামখেয়ালীপনা ও অবাধ্যতা, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অভিমান-ভালবাসার মধুর বর্ণনাতে উপন্যাসটি এগিয়ে যেতে থাকে। পিতা ও কন্যার সম্পর্কটা কতটা স্নেহময় ও গভীর হতে পারে, তা স্বাতী ও রাজেনবাবু চরিত্র দুটির মধ্য দিয়ে লেখক অঙ্কিত করেছেন।

কলেজে পড়ার সময় স্বাতীর পরিচয় হয় তরুণ প্রফেসর সত্যেনের সাথে। পারিবারিক বন্ধনহীন নিঃসঙ্গ সত্যেন ও স্বাতীর মধ্যে ধীরে ধীরে বন্ধন গড়ে ওঠে, নিজেদের জীবনের ভালোলাগা ও নিঃসঙ্গতার বর্ণনা দিয়ে তাদের মধ্যে পত্রবিনিময় চলতে থাকে। তাদের কোমল অনুভূতির প্রতিফলন ঘটে প্রতিটি চিঠিতে।

“তিথিডোর” বইয়ের পেছনের কভার; Image Source: নিউ এজ পাবলিশার্স

এক চিঠিতে স্বাতী সত্যেনকে লেখে,

মন খারাপ মানুষের কখন লাগে আর কেন লাগে- তার কি কোনো নিয়ম আছে? কিছুর মধ্যে কিছু না- সব ঠিক- সব ভাল… হঠাৎ শ্রীযুক্ত মন খারাপ এসে হাজির হলেন, যেন আর নড়বেন না এখান থেকে। তা লোক কিন্তু উনি তত খারাপ নন, মানে- মন খারাপ হওয়াটাই যে খারাপ তা কিন্তু ঠিক না- আমার তো বেশ ভালই লাগে একেক সময়।

… আর মন খারাপের ভাল লাগাটা বলতে হয়- মানে, বলতে চায় মানুষ, কিন্তু বলতে পারে না। আর পারে না বলেই কি গান বানায়, কবিতা লেখে?”

মানুষের হৃদয়ের গহীন অনুভূতির কী সাবলীল আর প্রাণবন্ত স্ফূরণ!

Image Source: tarunyo.com

বিশ্বযুদ্ধকালীন মানুষের অসহায়ত্বকে কেন্দ্র করে বিজন ব্যবসা শুরু করে এবং বিজনের মাধ্যমে স্বাতীর সংস্পর্শে আসে বিজনের বন্ধু ও ব্যবসায়ের গুরু প্রবীর মজুমদার। প্রবীর মজুমদার স্বাতীকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার চেষ্টা করলেও সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এমন সময় রাজেনবাবুর বড় কন্যা শ্বেতা স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হয়ে সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে আসে।

উপন্যাসের নায়িকা স্বাতীর মধ্যে একধরনের নিঃসঙ্গতা বর্তমান। এই নিঃসঙ্গতা সে নিজেই আপন চিত্তলোকে সৃষ্টি করেছে। নিজের চারদিকে সৃষ্ট আত্মময়তার দেয়ালকে সে নিজেও ভালবাসে এবং এই বিচ্ছিন্নতাকেও সে উপভোগ করে। অন্যদিকে পারিবারিক-সামাজিক সকল বন্ধনমুক্ত সত্যেন নিজের স্বাধীনতাকে প্রচণ্ড ভালবাসে এবং স্বাতীর মতো একপ্রকার আত্মকেন্দ্রিকতা ও নিঃসঙ্গতা তার মধ্যেও কাজ করে। মানবিক সম্পর্কের জালে না জড়াতে চাইলেও অবশেষে স্বাতীর সান্নিধ্যে এসে সে বাধা পড়ে যায় এবং দুই নিঃসঙ্গ মানব-মানবী একত্রিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

পরিবারের সকলের একত্রে মিলিত হয়ে মহা ধুমধামে স্বাতী ও সত্যেনের বিয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে এ উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটেছে। হিন্দু বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতা ও মাধুর্য অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে উপন্যাসের শেষে বর্ণিত হয়েছে।

তিন শতাধিক পৃষ্ঠার এ উপন্যাসে কোনো আকস্মিক চমক নেই, শ্বাসরুদ্ধকর কোনো উত্তেজনা নেই- কিন্তু প্রতিটি চরিত্রকে গভীর মমতায় উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রত্যেকের মনস্তত্ত্ব, অনুভূতি, চিন্তার ক্ষেত্র অত্যন্ত প্রাণবন্ত ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে। আড়ম্বরহীন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, কর্মব্যস্ত দিন থেকে শুরু করে ঘুম না আসা নিঃসঙ্গ রাতের সময়টুকুও যে কতটা কাব্যিক ও অনুভূতিময় হতে পারে তা উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায় খুঁজে পাওয়া যায়।

পুরো উপন্যাসে কারও প্রতি রাগ বা নেতিবাচক অনুভূতি তৈরি হয় না, বরং সময়ের প্রয়োজনে প্রতিটি নেতিবাচক আচরণ তাদেরকে বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে বলে মনে হয়। সবার প্রতি একটা মমতাবোধ পুরো সময় ধরে কাজ করে। এছাড়া ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলতে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণে পুরো কলকাতা জুড়ে থমথমে শোকাবহ পরিবেশ এবং জোড়াসাঁকোয় মানুষের ভিড় থেকে মৃতদেহ সৎকার পর্যন্ত অত্যন্ত নিপুণভাবে বর্ণিত হয়েছে।

বুদ্ধদেব বসু; Image Source: anandabazar.com

এ উপন্যাসের পাতায় পাতায় কাব্যিক সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। গদ্যের মাঝেও যে কাব্যিক কোমলতা লুকিয়ে থাকতে পারে, তা নতুন করে অনুভব হয়। নিজের ভেতরের লুকিয়ে থাকা নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্নতা, যার বর্ণনা কোনোদিন কাউকে দেওয়া সম্ভব হয়নি, তার অনুভূতিময় প্রতিফলন এ উপন্যাসে দেখে প্রতিটি পাঠক বিশেষ পুলক অনুভব করবে। সব মিলিয়ে একটি বিশেষ কালকে ধারণ করে ‘তিথিডোর’ এক মহাকাব্যিক এবং অপূর্ব কোমল এক উপন্যাস।

This is a Bangla article on Buddadev Basu's romantic novel 'Tithidore'.

Feature Image Source: New Age Publishers, Kolkata.

Related Articles