Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টু লিভ: বেঁচে থাকার গল্প

আমাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্পই একেকটি বেঁচে থাকার গল্প। দিন শেষে আমরা বেঁচে থাকার জন্যই লড়াই করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। এরই মাঝে মিশে আছে আমাদের সুখ- দুঃখ, আনন্দ-বেদনা। ‘টু লিভ’ চলচ্চিত্রটি যেন তেমনই একটি বেঁচে থাকার গল্প বলে, যেখানে আছে এক দম্পতির বেঁচে থাকার এক হাসি-কান্নার গল্প।

‘টু লিভ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে পরিচালক তখনকার সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থার নীরবে সমালোচনা করে গিয়েছেন। মাও সে তুং এর সময়ে চীনে যে অনিশ্চয়তা এবং স্বৈরতন্ত্র বিরাজ করছিল, তা তুলে ধরেছেন ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণের জীবনের মধ্য দিয়ে। জুয়া খেলার ভয়াবহ পরিণাম থেকে শুরু করে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উগ্রতার শিকার হওয়া সাধারণ এক দম্পতির বেঁচে থাকার গল্প এই ‘টু লিভ’।

ছবিটির পোস্টার; Image source: IMDb

সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে, যা সেই সময়ের জন্য ছিল অত্যন্ত সাহসী একটি পদক্ষেপ। চলচ্চিত্রে সাম্যবাদ (কমিউনিজম) তুলে ধরায় এর ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছিল। যার জন্য চলচ্চিত্রটি প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং এরই সাথে পরিচালক এবং অভিনেতার ওপর দুই বছর সিনেমা তৈরি এবং অভিনয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। চীনা এই সিনেমাটি একই নামের একটি উপন্যাস (Yo Hua, ১৯৯৩) অবলম্বনে নির্মিত। তবে সিনেমাটি চিত্রায়নের খাতিরে উপন্যাসের দৃশ্য হুবহু তুলে ধরেনি। কিছুটা পার্থক্য আনা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল-কলেজগুলোতে এই সিনেমাটিকে দেখানো হতো চীনা ইতিহাসের পাঠ্য হিসেবে। কান চলচ্চিত্র উৎসব ছাড়াও সেরা বিদেশী চলচ্চিত্র হিসেবে বহু পুরস্কার জিতে নিয়েছে ‘টু লিভ’। 

সিনেমাটির নির্মাতা; Image source: IMDb

গল্পটি মূলত ১৯৪০ থেকে ১৯৭০ সালের চীনের সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে। মাও সে তুং-এর কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আরোহণ এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ের সাধারণ মানুষগুলোর চালচিত্রগুলো এখানে অত্যন্ত তীক্ষ্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা দর্শকের সামনে যেন সেই সময়ের বাস্তব পরিস্থিতি ফুটিয়ে তুলে।

সিনেমার প্রথমে দেখা যায়, নায়ক ফুগুইয়ের ভুলের কারণে মাশুল দিতে হয় তার পুরো পরিবারকে। জুয়ার নেশা তাকে গৃহহীন করে দেয়। একপর্যায়ে সে রাস্তায় সুতা বিক্রি শুরু করে। এরপর থেকে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবন চলছিল। কিন্তু ১৯৪৯ সালে চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং চীনে কমিউনিস্ট শাসনের ঘোষণা দিলে তাদের জীবনে একে একে নেমে আসতে থাকে দুঃখ-দুর্দশা।

লিবারেশন আর্মি যখন ধরে নিয়ে যায় ফুগুইকে; Image source: IMDb

বিপ্লবের জন্য তখন লিবেরাশন আর্মি বা রেড আর্মি গ্রাম থেকে পুরুষদের ধরে ধরে নিয়ে যেত। এভাবে গল্পের নায়ক ফুগুইকে একদিন ধরে নিয়ে যায় এবং সেখানে সে লিবারেশন আর্মিতে অবদান রাখে। এরপর বাড়িতে ফিরে এলে জানতে পারে, তার মা মারা গেছেন এবং তা মেয়ে ফেঙ্গজিয়া প্রবল জ্বরে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। এছাড়াও সরকার থেকেই তার স্ত্রীকে বাসায় বাসায় পানি বিতরণের কাজ দেয়া হয়েছে।

ফুগুই ফিরে এসে দেখে তার স্ত্রী পানি বিতরণের কাজ করছে; Image source: IMDb

যেহেতু মাও সে তুং চীনে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তাই তিনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠায় চীনের তরুণ যুবকদের টার্গেট করেন। তরুণ প্রজন্ম গ্রেট লিপের ব্যর্থতা বুঝতে পারবে না। তাদের এই বিশ্বাসকে মাও কাজে লাগান। তিনি পুরোনো প্রথা ভেঙে দিতে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ঘোষণা দেন। এতে বিপুল সাড়া দেয় তরুণ সমাজ, যাদের নিয়ে তৈরি হয় ‘লাল বাহিনী বা রেড গার্ড’।

সিনেমায় ফেঙ্গজিয়ার স্বামী ওয়্যানকে দেখা যায় এই লাল বাহিনীর নেতা হিসেবে। তখনকার সময়ে লাল-বাহিনীকে সম্মানের চোখে দেখা হতো। যার কারণে ওয়্যানকে তারা নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে বরণ করে নেয়। শুধু তা-ই নয়, তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান আচার-ব্যবস্থা সবকিছুতে রাজনৈতিক আদর্শকে মেনে চলা হতো। মাও সে তুং যে তখন চীনের জনগণের কাছে ঈশ্বরের মতোই, তার প্রতিচ্ছায়া দেখা যায় ফেঙ্গজিয়ার বিয়ের সময়। কিন্তু  মাও বিপ্লবী নেতা হিসেবে যতটা সফল ছিলেন, একজন শাসক হিসেবে তা ছিলেন না। তার গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব এতটাই ব্যর্থ হয়েছিল যে তার পরিণাম ভুগতে হয়েছে যথাক্রমে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এবং সাধারণের দুর্গতির মধ্য দিয়ে।

বিয়ের দৃশ্য; Image source: IMDb

কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য মাও এর লাল বাহিনী তখন প্রাচীন শিল্পকর্ম, ছবি, লেখা ধ্বংস করছে। কেউ পুঁজিবাদী মনোভাব দেখালেই তাকে হত্যা বা অপমান করা হতো। সিনেমাটিতে লঙেরকে (যার কাছে ফুগুই জুয়া খেলায় হেরে গিয়ে বাড়ি দিয়ে দেয়) ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যার দৃশ্য তখনকার সমাজে পুঁজিবাদীদের অবস্থান প্রকাশ করে। এরপরের দৃশ্যতেই দেখা যায়, ফুগুই ভয়ে দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটছে। বাড়িতে ঢুকেই তারা কোন শ্রেণীর জনগণ তা জানতে চায় স্ত্রীর কাছে। কারণ সে সময়ে ভালো শ্রেণী বলতে শ্রমিক শ্রেণী এবং খারাপ শ্রেণী বলতে পুঁজিপতিদের বোঝানো হতো।

সিনেমাটিকে যদি একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে একে একজন নারীর হার না মানার গল্পও বলা যায়। গতানুগতিক চলচ্চিত্রের মতো নারীকে কোমলমতী হিসেবে তুলে না ধরে এখানে তাকে তুলে ধরা হয়েছে শক্ত ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের পরিচয়ে। যে হাজারো বিপদ, কষ্টেও ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করে গেছে। সয়ে গেছে সব বাধা-বিপত্তি। ধন-সম্পদ, সামাজিক অবস্থান ও সন্তান হারানোর কষ্ট কোনো কিছুই তাকে পরাজয় এনে দিতে পারেনি। বরং জীবনের সাথে  প্রতিটি লড়াই যেন তার সাহসিকতা আর নির্ভীকতারই পরিচয় দিয়েছে ক্রমাগত।

গল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীর এই দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে প্রকটভাবে। সিনেমায় স্ত্রীর চরিত্রটি এমন একটি চরিত্র যে সবসময় অন্ধভাবে মাওকে  ঈশ্বর হিসেবে না নিয়ে বরং তারা যে মাও এর ব্যর্থতার শিকার হচ্ছেন কখনো কখনো তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যেমনটা আমরা দেখি ছেলেটির মৃত্যুর সময়। এমনকি শেষদিকে দেখা যায় ফুগুই তার নাতিকে কমিউনিজমের বুলি আওড়িয়ে নয়, বরং স্বপ্ন দেখাচ্ছে এই বলে- “লাইফ উইল গেট বেটার এন্ড বেটার”।

আরেকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়, তা হলো- প্রথমদিকে ফুগুইকে যেরকম দায়িত্বহীন এবং স্বার্থপর হিসেবে দেখা যায়, তার এই চরিত্রটি ধীরে ধীরে ক্ষীণ থাকে। সে পরিবারের জন্য ভাবতে শুরু করে। লিবারেশন আর্মি যখন ধরে নিয়ে যায় তখন সে বারবারই তার পরিবার, সন্তান, মা ও স্ত্রীর কথা ভাবছিল। সিনেমার শেষ প্রান্তে তাকে নায়ক রূপে নয়, বরঞ্চ একজন ভালো মানুষ হিসেবে দেখা যায়।

সিনেমার এই দম্পতিকে নির্মম ভাগ্যের কাছে বলি হতে হয়েছে বারবার। কিন্তু প্রতিবারই তারা ভেঙে না পড়ে একে অপরকে আগলে রেখে লড়াই করে গেছে। লড়াই করে গেছে শুধু একসাথে একটু বেঁচে থাকার জন্য। প্রতিবার ভাগ্যের করুণ চেহারা দেখেও একটিবারের জন্যও আশা ছাড়েনি এই দম্পতি। সিনেমার শেষ প্রান্তে এসেও দেখা যায় দুই সন্তানকে হারিয়ে এই যুগলের নতুন পরিবার গড়ে উঠেছে, যেখানে তারা বেঁচে আছে তাদের নাতি আর মেয়ের জামাইকে নিয়ে। বেঁচে আছে সুন্দর, সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি জীবনের আশায়। যে আশায় নিজেদের বেধে রাখতো সেই সময়ের চীনের প্রতিটি সাধারণ পরিবার।

দুই সন্তান হারিয়ে জামাই আর নাতি নিয়েই দম্পতির নতুন পরিবার; Image source: IMDb

টু লিভ, যার অর্থ ‘বেঁচে থাকার জন্য’; শব্দ দুটি খুব ছোট এবং সাধারণ মনে হলেও এর গভীরতা কিন্তু অনেক। চীনা এই চলচ্চিত্রটি যেন জীবনের গভীর বাস্তবতারই প্রতিফলন। পুরো সিনেমাটি একইসাথে সুখ ও দুঃখের স্বাদ দিবে দর্শককে। সিনেমাটোগ্রাফার এত সূক্ষ্মতার সাথে কাহিনীগুলো তুলে ধরেছেন যে দর্শকের কাছে তা বাস্তব কোনো কাহিনী ব্যতীত অন্য কিছু মনে হবে না। এছাড়া সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবহারেও দর্শকের মন আন্দোলিত হবেই।

চীনা বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং-এর শাসনামলের একটি বাস্তবিক চিত্রের খণ্ড যেন এই ‘টু লিভ’। আর যা-ই হোক, দর্শককে সব কষ্ট ভুলিয়ে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগাবে এই সিনেমাটি। দেবে সাহস, শক্তি ও ধৈর্য।

This Bengali article is a movie review. 'To live' is a movie from 1994. It is based on the novel of the same name by Yu Hua.

 Feature Image: IMDb

Related Articles