চলচ্চিত্র নিয়ে সারা বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট অন্যতম। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ২০০২ সালে ‘A Guide to South Asian Cinema’ নামে একটি গবেষণা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো যার উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা) এবং দক্ষিণ এশিয়ার বংশোদ্ভূত পরিচালক বা এই অঞ্চলের কাহিনী নিয়ে নির্মিত সেরা ১০টি করে সর্বমোট ৫০টি সিনেমা বাছাই করা। প্রাথমিক তালিকা প্রস্তত করার সময় তারা ২০০১ সাল পর্যন্ত নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার ৪৫০টি চলচ্চিত্রকে বেছে নিয়েছিলো।
চলুন জেনে নেওয়া যাক ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের চলচ্চিত্রবোদ্ধা-সমালোচকদের দৃষ্টিতে ২০০১ সাল পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের নাম।
১০. আওয়ারা (১৯৫১)
তালিকার দশ নম্বরে রয়েছে বলিউডের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রাজ কাপুর পরিচালিত-অভিনীত ১৯৫১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘আওয়ারা’। সিনেমাতে রাজ কাপুরের বিপরীতে অভিনয় করেছেন আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী নার্গিস। উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রগুলোর একটি কমন ট্রেন্ড হলো নায়ক থাকবে গরীব আর নায়িকা হবে ধনী পরিবারের। আওয়ারাকে এই ধরনের গল্পের সিনেমার পথিকৃৎ বলা যায়। এই সিনেমাতে রাজ কাপুরের অভিনয় টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা ১০ পারফরমেন্সের ১টি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মুক্তির পরপরই সিনেমাটি ভারতের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনসহ অন্যান্য দেশেও তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাছাড়া সিনেমার ‘আওয়ারা হুঁ’ গানটি সোভিয়েত ইউনিয়নে ‘টপ হিটস’ ছিলো। আর চীনের চেয়ারম্যান মাও সে-তুং তো একবার বলেছিলেন যে, আওয়ারা তার প্রিয় সিনেমা।
৯. আম্মা আরিয়ান (১৯৮৬)
জন আব্রাহাম পরিচালিত ‘আম্মা আরিয়ান’ সরাসরি জনগণের টাকায় নির্মিত সিনেমা, যাকে ‘ক্রাউড ফান্ডিং’ বা ‘গণঅর্থায়নের’ সিনেমা বলা হয়। সারাবিশ্বে অনেক আগে থেকেই এর প্রচলন থাকলেও ভারতে এই ধরনের বিকল্প ধারার সিনেমা নির্মাণের শুরু করেছিলেন শ্যাম বেনেগাল, জন আব্রাহামরা। এই জন আব্রাহাম কিন্তু বলিউডের নায়ক নন, ইনি মালয়ালম ভাষার বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা। এই সিনেমাটি দক্ষিণ ভারতের একমাত্র সিনেমা যেটা সেরা দশ চলচ্চিত্রের এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। পরিচালক সিনেমাটিকে তথ্যচিত্রের মতো করে সাজিয়েছেন যেখানে কেরালার সেসময়ের বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মসূচীর বিভিন্ন দৃশ্য বাস্তবে ধারণ করা হয়েছিলো।
৮. মুঘল-ই-আজম (১৯৬০)
কে আসিফ পরিচালিত দিলীপ কুমার-মধুবালা জুটির এই সিনেমার কাহিনী এগিয়েছে মুঘল-সম্রাট আকবরের পুত্র সেলিম জাহাঙ্গীরের সাথে মহলের নর্তকী আনারকলির প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পরিচালক আসিফ মুঘল-ই-আজম নির্মাণের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সম্রাট আকবরের সময়ে লিখিত একটি নাটক থেকে। সেসময়ের বলিউডের অন্যান্য সিনেমার চেয়ে মুঘল-ই-আজমের নির্মাণ ব্যয় ছিলো কয়েকগুন বেশি। এই সিনেমা যে হলেই দেখানো হতো সবখানেই দর্শকদের লাইন লেগে যেতো। সিনেমার গানগুলোও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। এই সিনেমার সংলাপ থেকে শুরু করে সংগীত, অভিনয়, সেট, রূপসজ্জা সবকিছুর মধ্যেই নতুনত্ব লক্ষ্য করা যায়। যদিও এই সিনেমায় সেলিম-আনারকলির প্রেমকাহিনীর যে ইতিহাস দেখানো হয়েছে তার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
৭. সুবর্ণরেখা (১৯৬২)
বিশ্বচলচ্চিত্রে নামকরা দুই ভারতীয় চলচ্চিত্রকারের একজন ঋত্বিক ঘটক। দেশ ভাগের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু জীবনের দুর্দশা ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে সবসময় জোরালোভাবে হাজির হয়েছে। ঋত্বিক কখনও দেশভাগকে মেনে নিতে পারেননি, কারণ তিনি নিজে এর ভুক্তভোগী ছিলেন। ফলে এই বিষয়ে তিনি সারাজীবন প্রায় আচ্ছন্ন থেকেছেন বলা যায়। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সুবর্ণরেখা বেশ গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা। দেশভাগ নিয়ে তিনি ৩টি সিনেমা নির্মাণ করেছেন যাকে দেশভাগ ত্রয়ী (পার্টিশন ট্রিলজি) বলা হয়। সুবর্ণরেখা এই ত্রয়ীর শেষ সিনেমা, আর এর আগের দুটি হচ্ছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’(১৯৬০) এবং ‘কোমল গান্ধার’(১৯৬১)। এই সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন মাধবী মুখার্জী, বিজন ভট্টাচার্য, গীতা দে, জহর রায়দের মতো নামকরা সব মঞ্চাভিনেতা।
৬. চারুলতা (১৯৬৪)
বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ গল্প থেকে ১৯৬৪ সালে ‘চারুলতা’ নামে সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। তবে সত্যজিৎ রায় চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে গল্পের কাহিনী খানিকটা পরিবর্তন করেছিলেন। চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাধবী মুখার্জী, সৌমিত্র চ্যাটার্জী আর শৈলেন মুখার্জী। সিনেমাতে বিচ্ছেদকে অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে গল্পের সাথে মিশে যাওয়ার মতো আবহ খুব সহজেই তৈরি হয়ে যায়। সত্যজিৎ বরাবরই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সিনেমা বানান, চারুলতাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
৫. মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০)
এই তালিকায় স্থান পাওয়া ঋত্বিক ঘটকের আরেকটি কালজয়ী চলচ্চিত্রের নাম ‘মেঘে ঢাকা তারা’। পার্টিশন ট্রিলজির ২য় সিনেমা মেঘে ঢাকা তারার মূল কাহিনী গড়ে উঠেছে পঞ্চাশের দশকে কলকাতার এক বাঙালী পরিবারকে কেন্দ্র করে যারা ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। এই পরিবারের বড় মেয়ে নীতার কাহিনীই সিনেমার প্রধান ট্রাজিডি। সিনেমাটিকে ঋত্বিক ঘটকের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা বলা হয়। সিনেমার শেষদিকের সংলাপ "দাদা, আমি বাঁচতে চাই" অন্য রকম এক আবেদন সৃষ্টি করে। সিনেমার প্রধান দুই চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুপ্রিয়া দেবী ও অনিল চ্যাটার্জী।
৪. পিয়াসা (১৯৫৭)
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের অস্থির সময়ের এক ব্যর্থ কবির জীবন সংগ্রামের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘পিয়াসা’। গুরু দত্ত পরিচালনার পাশাপাশি এই সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। গুরু দত্তের বিপরীতে গুলাবু নামে এক পতিতার চরিত্রে অভিনয় করে ওয়াহিদা রেহমান বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন। এই সিনেমা গানের জন্যও বিখ্যাত, যেখানে এস ডি বর্মণের সুরে কণ্ঠ দিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফি।
৩. মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭)
প্রতিকূল সমাজব্যবস্থায় ভারতের একজন দারিদ্র্যপীড়িত মা এবং তার সন্তানদের নিজের আদর্শে অবিচল থেকে লড়াইয়ে টিকে থাকার গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘মাদার ইন্ডিয়া’। আমেরিকান লেখক ক্যাথেরিন মায়োসের বই ‘মাদার ইন্ডিয়া’ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিচালক মেহবুব খান ১৯৫৭ সালে এই সিনেমাটি নির্মাণ করেন, যেখানে তিনি দেশপ্রেমকে রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে এটি ১৯৫৮ সালে ‘দ্য একাডেমি এ্যাওয়ার্ড’ এর ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ শাখায় প্রতিযোগিতা করছিলো। এপিকধর্মী এই সিনেমাতে অভিনয় করেছেন নার্গিস, রাজকুমার, সুনীল দত্ত ও রাজেন্দ্রকুমার।
২. পথের পাঁচালী (১৯৫৫)
স্বাভাবিকভাবেই অনুমান করা যায় যে, সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘পথের পাঁচালী’ ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের এই তালিকায় উপরের দিকেই থাকবে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমাটি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। এই সিনেমা দিয়েই সত্যজিৎ বিশ্ব চলচ্চিত্রে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলেছিলেন। অপু ত্রয়ী (ট্রিলজি) চলচ্চিত্র-সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীতে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের বাংলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের জীবনধারা তুলে ধরা হয়েছে। এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সত্যজিৎ কোনো চিত্রনাট্য লেখেননি, এর পরিবর্তে তিনি নিজের আঁকা ছবি ব্যবহার করেছেন। সিনেমাটিতে অপুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় আর শিশু দুর্গার চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুঙ্কি বন্দ্যোপাধ্যায়।
১. শোলে (১৯৭৫)
শোলে সিনেমার নাম শুনলেই কানে ভেসে আসে বিখ্যাত সেই সংলাপটি- ‘‘ইয়ে হাত মুঝে দেদে ঠাকুর’’। ১৯৭৫ সালে রমেশ সিপ্পি নির্মিত এই অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার সিনেমাটি ভারতের ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা। কর্ণাটকের দক্ষিণে এক পাহাড়ি পাথুরে এলাকায় প্রায় আড়াই বছর ধরে সিনেমাটির দৃশ্য ধারণ করা হয়। মুক্তির কিছুদিন পর থেকেই দর্শক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয় এই সিনেমাটি। অথচ প্রথম মুক্তির পর কিছুদিন শোলেকে নেতিবাচক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। এটি ভারতের অনেক হলে একটানা প্রদর্শনীর নতুন রেকর্ড গড়েছিলো। সিনেমাটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অমিতাভ বচ্ছন, হেমা মালিনী, ধর্মেন্দ্র, আমজাদ খান, সঞ্জীব ঠাকুর, জয়া বচ্চন প্রমুখ।
প্রথম পর্ব: ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের দৃষ্টিতে সেরা ১০ বাংলাদেশী সিনেমা
This Bangla article is about the top ten Indian films till 2002 by British Film Institute. All the required references are hyperlinked within the article.
Featured Image: bfi.org.uk