Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উত্তম কুমার: রুপালী পর্দার রোমান্টিক মহানায়ক

ও যদি বিশাল কোন ক্রাইম করে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা হাসি দেয়, তাতেই আমি ওকে ইনোসেন্ট ভাবতে বাধ্য হবো“- কথাটি বলেছিলেন সৌমিত্র‍্ চট্টোপাধ্যায়। আর যাকে নিয়ে বলেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, বাংলার বহু তরুণীর স্বপ্নের নায়ক, ভুবন ভোলানো হাসির যাদুকর, কপোত-কপোতীদের কাছে প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত অঙ্কন করে যাওয়া কিংবদন্তী এক মহানায়ক। মহানায়ক শব্দটি শুনতেই যার মুখ আমাদের সামনে ভেসে আসে, তিনি অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। কেমন বেমানান লাগলো নামটা, তাই তো? হ্যাঁ, তিনিই উত্তম কুমার, বাংলার মহানায়ক। অরুণ কুমার তারই আসল পরিচয়, বাংলা চলচ্চিত্র জগতে মহানায়কের উপাধি দেয়া হয়েছে যাকে। একজন সফল অভিনেতার সাথে সাথে তিনি চিত্র পরিচালক আর প্রযোজক হিসেবেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছেন।

মহানায়ক উত্তম কুমার; Source: wikipedia.org

১৯২৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর কলকাতার আহিরীটোলায় সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং চপলা দেবীর ছোট্ট সংসারে জন্ম নেন অরুণ। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় তিনি। কলকাতার সাউথ সাব-আর্বা‌ন স্কুল থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করে গোয়েঙ্কা কলেজে ভর্তি হন। সংসারে আর্থিক অনটনের জন্য গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করেই তাকে ছুটতে হয় চাকরির সন্ধানে। কলকাতা পোর্টে মাত্র ২৭৫ টাকা মাইনেতে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন।

ছোট্ট অরুণ কুমার; Source: swabhumi

ছোটবেলা থেকেই যাত্রা আর থিয়েটারে তার ছিল প্রচণ্ড ঝোঁক। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে ছোট গয়াসুরের ভূমিকায় অভিনয় করে রীতিমত হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। স্কুল জীবনেই পাড়ার নাট্যসংগঠন ‘লুনার ক্লাব’ এর সঙ্গে যুক্ত হন। সেখানে রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ নাটকে অভিনয় করে তিনি পাকাপাকিভাবে অভিনয়জীবন শুরু করেন।

স্ত্রী গৌরী আর পুত্র গৌতমের সাথে বাসস্থানে উত্তম কুমার।

সেই থেকে মনে লালিত হতে থাকে রূপালী পর্দায় কাজ করার স্বপ্ন। অচিরেই মিললো সেই সুযোগ। ১৯৪৭ সালে তার স্বপ্ন বাস্তব রূপ পায় ভোলানাথ আঢ্যের ‘মায়াডোর’ নামক হিন্দি সিনেমার মাধ্যমে। দৈনিক পাঁচ সিকি পারিশ্রমিকে পাঁচদিন কাজ করেন। কিন্তু বিধিবাম, মুক্তি পায়নি মায়াডোর। পরবর্তী বছর ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে ১৩ টাকা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। সেখানেও সফলতা পায়নি ছবিটি। এরপর ‘কামনা’, ‘মর্যাদা’, ‘সহযাত্রী’, ‘নষ্টনীড়’, ‘কার পাপে’ এবং ‘সঞ্জীবনী’ ছবিতে ধারাবাহিকভাবে অসফলতার পর মুষড়ে পড়েন তিনি।

ততদিনে সিনেমাপাড়ায় তার নাম হয়ে গেছে ফ্লপমাস্টার। সিনেমার রোজগারে সংসার চালানো দায়। তাই অভিনয়ের পাশাপাশি চাকরি চালিয়ে গেলেন। ১৯৪৮ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ভালবেসে বিয়ে করলেন গৌরি গাঙ্গুলিকে। ১৯৫০ সালে জন্ম হয় তার একমাত্র পুত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায়। সব ছেড়ে সিনেমায় মন দেবেন বলে মনস্থির করেন। জনপ্রিয়তার খাতিরে পাহাড়ী স্যান্নাল তার নাম বদলে রাখেন উত্তম কুমার। অবশেষে ১৯৫২ সালে ‘বসু পরিবার’ ছবিতে কাজ করে আশাতীত সাফল্য পেলেন তিনি। সেই সাথে বাংলা চলচ্চিত্র পেল এক নতুন নক্ষত্র।

রুপালী পর্দায় বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক জুটি উত্তম-সুচিত্রা; Source: eibela.com

পরের বছর মুক্তি পেল ‘সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩)’, ছবির নায়িকা সুচিত্রা সেন। এখান থেকেই ইতিহাস রচনার শুরু। কিংবদন্তী এই জুটির একসাথে পথ চলা, সাথে নায়ক থেকে মহানায়ক হওয়ার অধ্যায়। ষাটের দশক পুরোপুরিভাবে মাতিয়েছেন উত্তম-সুচিত্রা তাদের অসাধারণ কিছু প্রশংসিত ছবি উপহার দিয়ে। ‘হারানো সুর’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া-পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’ এবং ‘সাগরিকা’ ছবিগুলোর মনোমুগ্ধকর অভিনয় আর সাফল্য তাদেরকে ‘রোমান্টিক’ জুটির শীর্ষস্থানে নিয়ে যায়, যা আজও বাঙ্গালীর কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়।

‘চিড়িয়াখানা’ সিনেমার এক দৃশ্যে উত্তম; Source: priyo.com

রোমান্টিক ছবির ফাঁকে ফাঁকে দুই-একটা ভিন্ন ধাঁচের ছবিতেও কাজ করেন তিনি। তার প্রেমিকসুলভ আচরণের বাইরে অভিনয়ের দক্ষতা প্রমাণ করেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর ভূমিকায় ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিটিতে। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে পাড়ার অভিনেতা থেকে অরিন্দমের নায়ক হয়ে ওঠার গল্পে তিনি যেন নিজেরই প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে তার অভিনীত ‘হারানো সুর’ পেয়েছিল রাষ্ট্রপতির সার্টিফিকেট অফ মেরিট সম্মাননা।

ইংরেজি উপন্যাস ‘র‍্যানডম হারভেস্ট’ কাহিনী অবলম্বনে তিনি নিজেই প্রযোজনা করেন ছবিটি। ১৯৬৭ সালে ‘চিড়িয়াখানা’ এবং ‘এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে প্রশংসিত অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার পান তিনি, ‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে হৃদয়হরণ নামক কমেডি চরিত্রে অভিনয় করেও ব্যপকভাবে প্রশংসিত হন। তার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭)’, ‘দেশপ্রেমী (১৯৮২)’ ও ‘মেরা করম মেরা ধরম (১৯৮৭)’ উল্লেখযোগ্য। স্বল্পায়ু এই মহান অভিনেতা ২১০টিরও অধিক সফল ছবি বাংলার মানুষকে উপহার দিয়ে গেছেন।

প্রেমের এক অনন্য নিদর্শন উত্তম-সুপ্রিয়া; Source: bdnews24

কর্মজীবনে সফল এই ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন এতটা কোমল ছিল না। খ্যাতির সাথে সাথে লোকমুখে রটনাও বাড়তে থাকে উত্তম-সুচিত্রাকে নিয়ে। স্ত্রী গৌরি দেবী তার অভিনয়ে আপত্তি না করলেও তাদের মেলামেশায় আপত্তি জানান, যার ফলে বাড়তে থাকে দূরত্ব। একসময় অভিনয় ছাড়তে বলেন গৌরি, রক্তে মিশে থাকা অভিনয়ের নেশা ছাড়া সম্ভব হয়নি উত্তম কুমারের পক্ষে। ১৯৬০ সালের দিকে সাফল্য পায় উত্তম- সুপ্রিয়ার ‘শুন বনোরাণী’ সিনেমা।

সুপ্রিয়া দেবী তখন বিশ্বজিৎ চ্যাটার্জির ধর্মপত্নী, কন্যা সোমার জননী। বিয়ের পর সুপ্রিয়াকে বাধ্য করা হয় অভিনয় ছাড়ার জন্য। তিনি বেশ কিছুকাল পর্দার আড়ালেই কাটান। কিন্তু সুখ তার সংসারেও ধরা দেয়নি। স্বামীর সাথে ডিভোর্সের পর তিনি আবার রূপালী পর্দায় ফিরে আসেন। তখন থেকে উত্তম কুমারের সাথে বন্ধুত্ব। উভয়ের ব্যক্তিজীবনের শূন্যতা থেকে জন্ম নেয় প্রেম।

১৯৬৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পৈতৃক বাসভবন ছেড়ে উত্তম কুমার চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ময়রা রোডের ফ্ল্যাটে। জীবনের বাকি সময় তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সাথেই কাটান।

ছেলের জন্মদদিনে আমন্ত্রিত সুপ্রিয়া দেবী; Source: eibela.com

গৌরি দেবীর সাথে আইনত ডিভোর্স না হওয়ায় রেজিস্ট্রি করতে পারেননি সুপ্রিয়া দেবীকে। কিন্তু সুপ্রিয়া দেবীর ভাষ্যমতে, ১৯৬২ সালের ২রা ডিসেম্বর ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় বিয়ে হয় তাদের। বিয়েতে সুপ্রিয়ার পরিবার সহ উত্তম কুমারের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুর সমাগম ঘটেছিল। বিয়ের পরও জুটি বেঁধে একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন তারা।

সুপ্রিয়া দেবী উত্তম কুমারের স্মৃতিচারণে বলেন, ব্যক্তিজীবনেও উত্তম কুমার ততটাই রোমান্টিক ছিলেন যতটা ছিলেন রূপালী পর্দায় দর্শকের সামনে। সামাজিক স্বীকৃতি না পেলেও তাদের প্রেম ছিল সাধারণ মানুষ তথা বাঙালিদের জন্য এক অনন্য নজির।

ধর্মীয় মতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ উত্তম-সুপ্রিয়া; Source: notunsomoy

তিনি সর্বদা বলতেন, “আমার কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে যদি কখনও কোনো মৃত্যু সংবাদ আসে, আমি কিছুটা থমকে যাই। আবার আমি আমাকে বোঝাই, ‘মৃত্যুই তো একমাত্র সত্য’।” কাজই ছিল তার কাছে মুখ্য বিষয়। সেটা তিনি তার নিজের জীবন দিয়েই প্রমাণ দিয়ে গেছেন। মহানায়ক হয়ে অভিনয়ের মধ্য দিয়েই মৃত্যুবরণ করেন এই নক্ষত্র। ‘ওগো বধু সুন্দরী’ সিনেমাটির কাজ চলছিল তখন। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই শুটিংরত অবস্থায় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে লাখো বাঙালিকে কাঁদিয়ে শুটিং স্পটেই মারা যান তিনি।

উত্তম কুমারের শ্রদ্ধার্ঘ্যে কলকাতা মেট্রো টালিগঞ্জ অঞ্চলের স্টেশনটির নামকরণ করা হয় ‘মহানায়ক উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন

কথায় বলে, মানুষ চলে গেলেও ইতিহাস বেঁচে থাকে। তিনি যে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, সেটা অমলিন থাকবে যুগ যুগ ধরে। ইন্ডাস্ট্রিতে তার মতো হৃদয়কাড়া অভিনেতা না তার আগে ছিল, না তিনি চলে যাবার পর এসেছে। মহানায়ক একজনই, তিনি অদ্বিতীয়।

ফিচার ইমেজ- anandabazar.com

Related Articles