Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উজাক: একাকিত্বের বিষণ্ন সুন্দর আখ্যান

“একসময় খুব তো বলতি, তার্কোভস্কির মতো সিনেমা বানাবি, তাহলে এখন সেসব দিনের কথা ভুলে যেতে চাস কেন?”

বন্ধুদের আড্ডায় এই খোঁটা শুনে মেহমেতের মুখের অবস্থা যা হয়, তা সম্ভবত দুনিয়ার সমস্ত শৈল্পিক মনোবৃত্তির লোকদের অন্তর্জ্বালা ফুটিয়ে তোলে। কারণ, তারা কেউই শিল্প ছেড়ে কমার্শিয়াল গলি-ঘুপচিতে হাঁটতে চায়নি। এই পথে আসতে হয়েছে পেটের দায়ে। কিন্তু নিজের দুঃখ তো আর জনে জনে বলে বেড়ানোর ব্যাপার নয়। 

তুর্কি শব্দ ‘উজাক’ অর্থ ‘দূরবর্তী’। এটি মুক্তি পায় ২০০২ সালের ২০ জুলাই। সিনেমার নামকরণকে স্বার্থক করতে মায়েস্ত্রো নূরি বিলগে জেইলান এখানে দেখিয়েছেন দুজন মানুষের জীবনাচরণ। যারা সম্পর্কের দিক থেকে কাছাকাছি হলেও চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে দুই মেরুর বাসিন্দা। অর্থাৎ, তাদের দূরবর্তীতা যতটা না স্থানিক, তার চেয়ে বহুগুণে মানসিক। এটি জেইলানের তৃতীয় ফিচার ফিল্ম। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বাজেটের কথা বিবেচনা করে পরিবারের লোকজন আর আত্মীয়-স্বজনদের নিয়েই কাজ করতেন তিনি। শ্যুটিংও হতো এমন কোনো স্থানে, যেখানে কোনো পয়সা খরচ হবে না। এই রীতি এখানেও অনুসরণ করা হয়েছে।

পরিচালক নূরি বিলগে জেইলান; Image Credit : cineuropa.com

১১০ মিনিট দৈর্ঘ্যের উজাকের মোট ক্রু মাত্র ৫ জন। পরিচালনার পাশাপাশি স্ক্রিনপ্লে, সিনেম্যাটোগ্রাফি আর এডিটিংয়েও ছিলেন নূরি নিজে। তাই পুরো মুভিজুড়ে থেকেছে তার ছাপ।

উজাকের আগে পরিচালকের প্রথম দুই সিনেমা কাসাবা (দ্য স্মল টাউন – ১৯৯৭) এবং মেয়িস সিকিনতিসি (ক্লাউডস অভ মে – ১৯৯৯) দেখে নিতে পারেন দর্শক। গল্পের ক্ষেত্রে সরাসরি সংযুক্তি না থাকলেও, বাকি দুটি চলচ্চিত্র প্রেক্ষাপট বুঝতে সহায়তা করবে। অনেকেই তিনটি মুভিকে একত্রিত করে ট্রিলজি বলতে চান। তবে না দেখলেও ক্ষতি নেই৷ 

গল্পের প্রেক্ষাপট তুরস্কের ইস্তানবুল শহর। এটি স্থানের আবর্তে বন্দী কোনো গল্প নয়। বরং এটি সার্বজনীন, সকল সমাজে উপস্থিত। তাই গল্পের সাথে ভৌগোলিক এবং পরিবেশগত কারণে আচরণের কিছু বৈশিষ্ট্য ব্যতীত সকল দেশ বা সমাজের লোকেরাই মিল খুঁজে পাবেন— বিশেষত যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাসিন্দা, তারা। মেহমেত (মুজাফফের ওজদেমির) তার এলাকার লোকজনের জন্য একটি সাকসেস স্টোরি। গ্রাম থেকে এসে কারো সাহায্য ছাড়া স্বীয় মেধার মাধ্যমে নিজেকে ইস্তানবুল শহরে প্রতিষ্ঠিত করেছে একজন সফল ফটোগ্রাফার হিসেবে। দেশ তখন অর্থনৈতিক মন্দায় পর্যবসিত। প্রতিদিন চাকরি হারাচ্ছে অগণিত মানুষ। এমতাবস্থায় মেহমেতের বাসায় অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি হিসেবে আগমন ঘটে ইউসুফের (মেহমেত এমিন তোরপাক)। গ্রামের কারখানায় চাকরি হারানো ইউসুফ কিছুদিন এখানে থেকে কর্মের সংস্থান করতে চায়। মেহমেত তাকে থাকতে দিতে রাজি হয় মাকে কথা দিয়েছিল বলে। 

মেহমেত চরিত্রে মুজাফফের ওজদেমির; Image Credit : vuslatdk.com

বিরুপ, তুষারাবৃত রাস্তা ধরে ইউসুফ এসে পৌঁছায় মেহমেতের অ্যাপার্টমেন্টে। শুরুতেই মেহমেত তাকে বাসায় কীভাবে থাকতে হবে, কোথায় ধূমপান করা যাবে, কীভাবে টয়লেট ব্যবহার করতে হবে সেই সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা প্রদান করে। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে আমরা দেখতে থাকি- কীভাবে এই দুই পুরুষের আচার-আচরণ এবং মনস্তত্ত্ব পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত করে; উভয়ের জীবনাচরণ কীভাবে অন্যজনের কমফোর্ট জোনকে প্রভাবিত করে। ১১০ মিনিটের ড্রামা জনরার সিনেমাটি উভয় চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিগত জীবনের ওপরও সবিস্তারে আলোকপাত করে। আর বরাবরের মতোই নৈঃশব্দকে প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হতে দিয়েছেন পরিচালক; ইস্তানবুলকে দেখিয়েছেন এমনভাবে, যেভাবে এর আগে কখনো দেখানো হয়নি সুপ্রাচীন এই নগরীকে। 

মধ্যবয়সী ফটোগ্রাফার মেহমেত স্বভাবে মৃদুবাক। তার অ্যাপার্টমেন্ট ঠাসা দুনিয়ার বইপত্র, গান আর সিনেমার সিডি দিয়ে। নিজে শিল্পচর্চা ছেড়ে কমার্শিয়ালিজমের পথে যাত্রা শুরু করলেও শিল্পচর্চার মিথ্যা গরিমা তার মাঝে পরিপূর্ণভাবে উপস্থিত। স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কেন ছেড়ে চলে গেছে তা আঁচ করতেও আমাদের খুব একটা কষ্ট হয় না। মৃদুভাষী, বর্ণচোরা মেহমেত কারো সাথে মিশতে পারে না; মেশার জন্য নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বেরোতেও সে অনিচ্ছুক। স্ত্রী চলে গেলেও তার প্রতি মেহমেতের টান একটুও কমেনি। কিন্তু সে এ কথা স্বীকার করে না। সারাদিন আর্ট নিয়ে ভাবলেও দেয়ালে থরে থরে সাজানো বই পড়তে বা গান শুনতে দেখা যায় না তাকে। তার সময় কাটে টিভি দেখে আর টাইলস কোম্পানির জন্য পণ্যের বিজ্ঞাপনের ছবি তুলে। পরিবারের কারো সাথে নিজে থেকে যোগাযোগ করে না, ব্যবহার করে না মোবাইল ফোন। মা বা বোন যোগাযোগ করতে চাইলেও সে আন্সারিং মেশিনে রেকর্ড হতে দেয় তাদের কথা, নিজে কিছু বলে না। মোট কথা, সভ্যতার হৃৎপিণ্ডে বসেই সে সাজিয়ে নিয়েছে নিজের বনবাস। 

ইস্তানবুলের তুষারাবৃত পথ ধরে হেঁটে আসছে ইউসুফ; Image Credit : efsanekareler.com

অন্যদিকে, তার কাজিন ইউসুফও একাকিত্বে ভোগা একজন মানুষ। সে গ্রাম থেকে শহরে আসে কাজের খোঁজে। কিন্তু তার এই অভিপ্রয়াণ কতটা সফল হবে তা নিয়ে আমরা দর্শকরা সন্দিহান হয়ে পড়ি। কেননা, শুরুতেই আমাদের দেখানো হয় জেটিতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে থাকা একটি জাহাজ। শিপিং এজেন্সি বা জাহাজে চাকরি করা লোকজনের কাছ থেকেও শোনা যায় না কোনো আশার বাণী। শহরের উন্নত জীবনের স্বপ্নে বিভোর ইউসুফ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি এখানেও অর্থনৈতিক মন্দার প্রকোপ লাগতে পারে। তার কাছে নেই বিকল্প কোনো পরিকল্পনা। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে আসে মায়ের ফোন, যেখানে থাকে দেনা আর দৈন্যের বয়ান। বসফরাস প্রণালীর বুক চিরে চলা জাহাজের সাইরেন যেন তাকে টিটকিরি মারে। আর ইউসুফও ঘন তুষারপাতের চাদরে আবৃত ইস্তানবুলের রাস্তা আর পার্কে ঘোরাঘুরি করে উদ্দেশ্যহীনভাবে, ভেজা মোজা পরা পা এবং দস্তানাবিহীন হাতে। 

মেহমেতের মতো ইউসুফের জন্যও নারীসঙ্গ অস্বস্তির বিষয়। কাউকে পছন্দ হলেও তাকে বলতে পারে না সে। তাই সে ঐ নারীকে অনুসরণ করে এবং তাকে অন্যদের সাথে মিশতে দেখে। এটি আমাদের ভয়্যারিজম বা ঈশণকামীতার কথা মনে করিয়ে দেয়। ভয়্যারিজমের অনুভূতি উজাকে আরো বেশ কয়েকবার অনুভূত হয় আমাদের। কারণ প্রায়শই জেইলান ঘরের এক কোণে ক্যামেরা রেখে দিয়ে লং টেইক নেন। ফলে দীর্ঘক্ষণ ধরে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা উজাকের চরিত্র এবং তাদের কার্যকলাপ দেখি। মনে হয়, আমরা যেন চলচ্চিত্রের সেটের ঐ কামরার দেয়ালে বসে থাকা কোনো পতঙ্গ। 

ইউসুফ চরিত্রে মেহমেত এমিন তোরপাক; Image Credit: imdb.com

যৌনতা সম্পর্কিত কেবল একটি দৃশ্যই রয়েছে মুভিতে। যেটি অনেকটা ক্লান্তিকর এবং প্রাণহীন। এ কারণেই হয়তো এখানকার চরিত্ররা স্বস্তি খোঁজে সিগারেটে। আর যৌনতার কাছাকাছি অনুভূতি নিতে মেহমেতকে আশ্রয় নিতে হয় চাতুরীর। যেখানে আবার সে ব্যবহার করে নিজের গুরু তার্কোভস্কিকে। 

উভয় চরিত্র যে পরস্পরের সাথে একেবারেই মানিয়ে চলতে চায় না, এমন কিন্তু না। কিন্তু মানিয়ে চলার এসকল প্রচেষ্টা বুমেরাং হয়ে যায়। অনুচর ইঁদুর আর তাকে ধরার আঠাযুক্ত ফাঁদের সাবপ্লট রূপকার্থে তাদের নিজেদেরকেই যেন ফুটিয়ে তোলে।

এটি এমন একটি সিনেমা যেটি বার বার দেখা যায়। এবং প্রত্যেকবার কোনো না কোনো নতুন দিক উন্মোচিত হয় মনোযোগী দর্শকের সামনে। গতানুগতিক প্লটের অনুপস্থিতি, ধীরগতির স্টোরি টেলিং, আর লং টেইকের কারণে এটি হয়তো অনেকের ভালো না-ও লাগতে পারে। তবে এটি নূরি বিলগে জেইলানের কাজ, এবং তিনি কখনোই দর্শকপ্রিয়, মেইনস্ট্রিম সিনেমা বানাতে চাননি। সবসময় এ পথ থেকে দূরে হেঁটেছেন। যারা দেখবেন তাদের এ বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার। 

পাশাপাশি অবস্থান করেও দূরবর্তী; Image Credit : filmsinfilms.com

যারা জেইলানের ভক্ত, তাদের বিমোহিত করার সকল উপাদানই এখানে উপস্থিত। নিজের সিগনেচার আন্তন চেখভ এবং তার্কোভস্কিয় আবহ, মুখ দেখানোর আগে পেছন থেকে চরিত্রের অবয়ব প্রদর্শন, মনুষ্য-সম্পর্কের ভঙ্গুরতা এবং তার ফলাফল, অনেকের মাঝে থেকেও একা হওয়ার অনুভূতি, যাপিত জীবনের তকলিফ- এ সবকিছুর মঞ্চায়ন করেছেন অনবদ্য শৈল্পিকতার সাথে। দৈনন্দিনের জরাজীর্ণ জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া উজাক ভয়ংকর সুন্দর। এতে নিজেদের অভিনয়শৈলীর অনবদ্যতায় যুগ্মভাবে কানে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার জেতেন তোরপাক এবং ওজদেমির। 

সর্বমোট ৩১টি পুরষ্কার জেতা সিনেমাটির সাথে জড়িয়ে গেছে ব্যক্তিগত বিষাদও। এর শ্যুটিং সম্পন্ন হওয়ার কিছুদিন পর এক সড়ক দুর্ঘটনায় মাত্র ২৮ বছর বয়সে মারা যান মেহমেত এমিন তোরপাক। সম্পর্কে তিনি ছিলেন জেইলানের কাজিন। তুর্কি এই অঁতরের সৃষ্ট দুনিয়া অবলোকনের ক্ষেত্রে উজাক হতে পারে পারে উৎকৃষ্ট সূচনা বিন্দু।

Related Articles