Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

‘অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ জালিয়াতি অভিযোগের আদ্যোপান্ত

“বস্তুবাদী জগতে বিবর্তনের দ্বন্দ্বে যেভাবে প্রকাশ ঘটে সুন্দর ও সত্যের, তেমনিভাবে সুন্দরকে মানবতার দর্শনে পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে কিশোরী নিজেকে উৎসর্গ করেছিল, আধুনিক বিশ্বে শুধু নয় সুদূর অতীতকালেও তার জুড়ি পাওয়া ভার। জার্মানির হিটলারের লোভ ও নিষ্ঠুরতার শিকার সদ্য বাল্যকাল উত্তীর্ণ তের বছরের কিশোরীর লোমহর্ষক ঘটনা তেমনই বেদনা ও যাতনার ইতিহাসে ভরা”

এমনই কিছু কথা লেখা আছে বইটির ফ্ল্যাপে। বইপোকাদের কাছে যদি সেরা পঞ্চাশটি বইয়ের নাম জানতে চাওয়া হয়, তবে ‘অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ নামটি অবশ্যই সেখানে আসবে। ফ্ল্যাপে উল্লিখিত তের বছরের সেই কিশোরীর জন্য পাঠকহৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠতে বাধ্য। কিন্তু সত্যিই কি অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক বলে কেউ ছিল? তার ডায়েরিতে উল্লিখিত ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতাই বা কতটুকু? আজ এত বছর পরও হলোকাস্টকে যারা অস্বীকার করে তারা এই ডায়েরিটি নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ তুলছে।

এত নির্মমতার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও হলোকাস্টকে কেউ কীভাবে অস্বীকার করে? Source: mlive.com

 

ইউরোপ ও আমেরিকার স্কুলগুলোতে পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় ‘অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ নামটি প্রায় সব সময়ই দেখা যায়। ডায়েরিটি সর্বপ্রথম জনসমক্ষে আনেন অ্যানালিস মারি অ্যানা ফ্রাঙ্কের বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। বিশ্বব্যাপী অ্যানাকে হলোকাস্টের শিকার সবচেয়ে আলোচিত ইহুদি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার মানসম্পন্ন লেখনী তাকে পৌঁছে দিয়েছে পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাঠকদের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা এই ডায়েরি, যা পরবর্তীতে বই হিসেবে মুদ্রিত হয়, এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। অনেক নাটক বা চলচ্চিত্রের মূল নির্যাস নেয়া হয়েছে অ্যানা ফ্রাঙ্কের লেখা ডায়েরিটি থেকে।

দ্য ডায়েরি অফ অ্যা ইয়াং গার্ল; Source: collider.com

১৯৪২ সালের ১২ জুন তেরতম জন্মদিনে ডায়েরিটি উপহার পায় অ্যানা। তার জীবনের ১২ জুন, ১৯৪২ থেকে ১ আগস্ট, ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সময়কার ঘটনাগুলো এখানে লিপিবদ্ধ করেছে সে। অ্যানার ডায়েরি নিয়ে কিছু লেখার আগে জেনে আসা যাক ব্যক্তি অ্যানা সম্পর্কে। অ্যানার জন্ম জার্মানির ফ্র্যাংকফুর্ট শহরে হলেও তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে। ‘অ্যানা’, ‘আনা’, ‘অ্যানী’- দেশভেদে বিভিন্ন নামে পরিচিত সে। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত জাতীয়তায় সে ছিল জার্মান। পরবর্তীতে নাৎসি জার্মানির সেমিটিক বিদ্বেষী নীতির কারণে সে জার্মান নাগরিকত্ব হারায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নেদারল্যান্ডে অবস্থানরত কিশোরী অ্যানা তার অভিজ্ঞতাগুলো লিপিবদ্ধ করে একটি ডায়েরিতে। ১৯৩৩ সালে অ্যানার পরিবার আমস্টারডামে চলে যায়, আর ঠিক সে বছরই নাৎসিরা জার্মানির ক্ষমতায় আসে। নাৎসিরা আমস্টারডাম দখল করে নিলে সেখানে আটকা পড়ে অ্যানা ও তার পরিবার। ১৯৪২ সালের দিকে ইহুদি নিধন আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকায় তারা সবাই অটো ফ্রাঙ্কের গুপ্ত কক্ষে পালিয়ে থাকে।

এভাবে লুকোচুরি খেলতে খেলতে চলে যায় আরও দু’বছর। ১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট সকালে জার্মান নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে সপরিবারে ধরা পড়ে তারা। তাদের এই গুপ্তস্থানের কথা জার্মানরা কীভাবে জানল, তা আজও এক রহস্য! তাদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে সোজা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে চালান দিয়ে দেয়া হয়। অ্যানা ফ্রাঙ্ক ও তার বোন মার্গটকে পাঠানো হয় বার্গেন-বেলজান ক্যাম্পে। সেখানেই টাইফাসে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৫ সালে মারা যায় দু’ বোন। যুদ্ধ শেষে পরিবারের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, অ্যানার বাবা অটো ফ্রাঙ্ক, আমস্টারডামে ফিরে এসে এই ডায়েরিটি খুঁজে পান। তার ইচ্ছাতেই ১৯৪৭ সালে প্রথমবারের মতো এটি বই হিসেবে মুদ্রিত হয়। ওলন্দাজ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় ১৯৫২ সালে, বইটির নাম দেয়া হয় ‘দ্য ডায়েরি অফ অ্যা ইয়াং গার্ল’। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় বইটি অসংখ্যবার অনূদিত হয়েছে।

কিশোরী অ্যানা ফ্রাঙ্ক; Source: emmajaneexplores.com

অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি নিয়ে ইন্টারনেট দুনিয়া কিংবা ছাপার কাগজে আলোচনার কোনো অভাব নেই, অভাব নেই বিভ্রান্তিকর তথ্যেরও। বেশ কিছু বইয়ে স্পষ্ট করে লেখা আছে, অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি আর যে-ই লিখুক, অ্যানা নিজে লেখেনি।কথিত আছে, জায়োনিস্ট অর্থাৎ ইহুদি যায়নবাদীরা বইটি প্রকাশের পরপরই তা লুফে নেয় এবং একে পাঠ্যপুস্তকে স্থান দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গোটা ইউরোপ জুড়ে মার্কিন আর রুশরা আধিপত্য বিস্তার করে। ইহুদি যায়নবাদীরা তাদের সাথে সখ্যতার সুযোগ নিয়ে গণমাধ্যমকে নিয়ে আসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে। এরপর শুরু হয়ে সত্য-মিথ্যার এক জটিল খেলা। বলা হয়, জার্মানদের দ্বারা সুপরিকল্পিতভাবে ইহুদি হত্যার খবর, যার নাম দেয়া হয় ‘হলোকাস্ট’, অনেকটাই সেই মিডিয়ারই সৃষ্টি। যুদ্ধে প্রচুর মানুষ মারা গেলেও হলোকাস্ট নামের আদৌ কিছু ছিল কিনা তার যুক্তি খণ্ডনে গবেষকরা তাদের কাজ শুরু করেন। গ্যাসচেম্বার বা গণহত্যার মতো কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল কিনা তার পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে হাজারো যুক্তি। হলোকাস্টের নাম ভাঙিয়ে সিনেমা বানিয়ে, প্রতিবেদন তৈরি করে পদক জিতে নেয়াটা নাকি এক প্রকার ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। মিডিয়াসৃষ্ট সেই হিটলার বিরোধী প্রচারণার একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কালিমা থেকে রেহাই পায়নি ‘অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ও। ষাট লাখ ইহুদি হত্যার ঘটনাকে যারা অস্বীকার করতে পারে, তার বিপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ এনে হলোকাস্টের সত্যতাকে নাকচ করতে পারে, তাদের পক্ষে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির দিকে সন্দেহের আঙুল তোলা খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার।

ফ্রাঙ্কদের পারিবারিক চিকিৎসক ড. রবার্ট ফরিসন একবার অ্যানার বাবা অটো ফ্রাঙ্কের সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ পান। প্রায় ন’ঘণ্টা ব্যাপী পরিচালিত এই সাক্ষাৎকার কার্যক্রম শেষে ড. রবার্ট ফরিসন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, মূল ডায়েরির লেখিকা ছিল খুবই শীর্ণকায় বাচ্চা একটি মেয়ে। ডায়েরিতে সে তার আবেগী দিনলিপি লিখেছিল বটে, কিন্তু পরবর্তীতে সেই লেখাগুলোর সাথে প্রচুর ঘটনা যোগ করা হয়েছে, জনমনে আবেগ সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে এবং তথ্য জালিয়াতি করা হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি কিন্তু একটি নয়, দুটি। ১৯৪২ সালের ১২ জুন যে ডায়েরিটি সে উপহার পায়, সেটির পাতা শেষ হয়ে যায় সে বছরেরই ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখে। পরবর্তীতে যুদ্ধের দিনগুলোর কথা সে লেখে স্কুলের একটি ডায়েরিতে যা শুরু হয় ১৯৪৩ সালের ২২ ডিসেম্বরে, শেষ হয় ১৯৪৪ সালের ১৭ এপ্রিলে। তার বাবা অটো ফ্রাঙ্কের সাক্ষাৎকার নেয়া ড. ফরিসনও কিন্তু এই বিষয়গুলো জানতেন না।

ডায়েরির ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণে পাওয়া গেছে হাতের লেখার ভিন্নতা; Source: biography.com

১৯৫৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘লাইফ’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ছবি ছাপানো হয়। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে তার হাতে লেখা ডায়েরির একটি পাতার ছবি ছিল। সেই লেখা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, লেখাগুলো অত্যন্ত শিশুসুলভ হাতের লেখা, একদমই বাচ্চা কারো লেখা। প্রায় একই সময়ে প্যান বুকস কোম্পানি থেকে প্রকাশিত পেপারব্যাক বইয়ে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির পাতার যে নমুনাটি ছাপানো হয়, সেখানকার হাতের লেখা ছিল একেবারেই ভিন্ন। বিতর্ক সামনে চলে আসায় হাতের লেখা নিয়ে শুরু হয় গবেষণা এবং হস্তলেখাবিদদের প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, প্রথম লেখাটির লেখকের বয়স বারো কি তের। অপরদিকে, দ্বিতীয় লেখাটির নমুনা থেকে প্রমাণিত হয় লেখকের বয়স পঞ্চাশ বা তারচেয়ে বেশি! দ্বিতীয় লেখক যদিও শিশুসুলভ ভঙ্গিতে লেখার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু গবেষকদের কাছে তা ধরা না পড়ার কোনো কারণ নেই। এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন বইয়ে নমুনা হিসেবে দু’ধরনের হাতের লেখার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে মূল ঘটনাটি অনেকটা এরকম- তিনটি প্রকাশনী থেকে বের করা হয় অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি। এমন একটি সংবেদনশীল বিষয়ে যে প্রকাশনী পাঠকের মন যত বেশি ছুঁয়ে যেতে পারবে, সেই প্রকাশনীর কাটতি তত বাড়বে। এই চিন্তা থেকেই যে যার ইচ্ছামতো বইয়ের সাথে নিজেদের হাতে লেখা ডায়েরির পাতা যুক্ত করেছে। ১৯৮৬ সাল থেকে অ্যানার বাড়িতে তার নিজ হাতে লেখা ডায়েরি প্রদর্শিত হচ্ছে সর্বসাধারণের জন্য।

১৯৮০ সালের ৯ অক্টোবর ‘নিউইয়র্ক পোস্ট’ পত্রিকায় জার্মান ফেডারেল ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত এক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির সিংহভাগ লেখাই বলপয়েন্ট কলম দিয়ে লেখা হয়েছে। অথচ বলপয়েন্ট কলম বাজারে আসে ১৯৫১ সালে! আর অ্যানা ফ্রাঙ্ক মারা যায় ১৯৪৪ সালে। কাজেই এখানে একটি জালিয়াতির প্রশ্ন ওঠে পাঠকমনে। বাজারে অ্যানার নাম হয়ে যায় ‘দ্য বলপয়েন্ট গার্ল’। আদতে কিন্তু ডায়েরিটি লেখা হয়েছিল বিভিন্ন রঙের রঙপেন্সিল আর দোয়াতের কালি দিয়ে। নেদারল্যান্ডস ইন্সটিটিউট ফর ওয়ার ডকুমেন্টেশনের ফরেনসিক রিপোর্টে উঠে এসেছে এমন তথ্য। তবে অ্যানা ফ্রাঙ্কের যে ডায়েরিটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় চলছে, তার সাথে পাঁচটি আলগা কাগজ পাওয়া গেছিল, যা লেখা হয়েছে বলপয়েন্ট কলম দিয়ে। এই পাঁচ পৃষ্ঠা অ্যানা নিজেই লিখেছে কিনা তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।

ড. ফরিসন বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত একাধিক অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরি যোগাড় করে পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, বই থেকে বইয়ে নানারকম পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। কখনো তা তথ্যগত, কখনোবা আবেগ মেশাতে গিয়ে মূল ঘটনার সাথে তাল মেলানোর ধারই ধারেননি অনুবাদক। কোনো বইয়ে নতুন তথ্য যোগ করা হয়েছে, কোনো বই থেকে পুরনো অনেক তথ্য বেমালুম বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। বইটির মেরুদণ্ড বলে ধরা হতো এমন বেশ কিছু তথ্যও পরবর্তীতে পরিবর্তন করা হয়েছে। কিছু বইয়ে রয়েছে পরস্পর বিরোধী কথাবার্তা। সব মিলিয়ে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির কয়েকটি সংস্করণ একসাথে নিয়ে বসলে পাঠকের মাথা ঘুরে যাবে!

পঞ্চাশ হাজার ডলারের বিনিময়ে মেয়ার লেভিনের বই লেখার প্রমাণ; Source: wp.com

আমেরিকার নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর্থার বাটজ হলোকাস্ট বিরোধী লেখার জন্য বেশ বিখ্যাত। তিনি ডায়েরিটি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে মাত্র তের বছর বয়সী কোনো বালিকার লেখা এটি নয়। ডায়েরিটি খুব হিসাব করে লেখা। এতে পেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তার মতে কোনো পেশাদার সাহিত্যিককে দিয়ে ডায়েরিটি বইয়ে রূপান্তর করিয়ে একেবারে সাহিত্যের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুরো ডায়েরিতে বিষয়বস্তু যেভাবে ভাগ ভাগ করে ধারাবাহিকভাবে সাজানো, তা প্রতিদিনকার নতুন ঘটনা লিপিবদ্ধ করার সাথে খাপ খায় না। তের বছর বয়সী একটি মেয়ে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা লিখে রাখলে সেখানে এরকম সাহিত্যিক ধারাবাহিকতা থাকার কোনো যুক্তি নেই। এমনকি উদাহরণস্বরূপ বাটজ বলেছেন, দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কেন তের বছর বয়সী একটি মেয়ে ডায়েরি লিখছে। এরপরই তৃতীয় পৃষ্ঠায় রয়েছে ফ্র্যাঙ্ক পরিবারের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। তারপর ১৯৪০ সালে জার্মান দখলদারির পর জার্মানদের নেওয়া ইহুদিবিরোধী পদক্ষেপগুলোর ত্বরিত বিবরণও সেখানে উঠে এসেছে। ডায়েরির বাকি অংশে ইহুদি বিদ্বেষের বিষবাস্পের পরিস্থিতি খুব গুছিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। (বাটজ, হোক্স অফ দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি, ১৯৭৭, পৃষ্ঠা-৭)

দ্বিতীয় ডায়েরিটি লেখার সময় ডায়েরি লেখার ব্যাপারে বেশ কিছুটা অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে অ্যানা।  কাজেই এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। ১৯৮০ সালের ১৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করা অটো ফ্রাঙ্কের পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া তো আর সম্ভব নয়। তবে মারা যাওয়ার আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, অ্যানার ডায়েরিটি শুধুমাত্র ডাচ জনগণের সম্পত্তি বলে বিবেচিত হবে। ডাচদের ঐ ডায়েরি অনুবাদ করার কোনো প্রয়োজন পড়বে না। তারাই হয়তো ঠিকমতো বুঝতে পারবে ছোট মেয়েটি কী বুঝাতে চেয়েছিল।

মেয়ের আবেগ নিয়ে খেলার দায়ে অভিযুক্ত পিতা অটো ফ্রাঙ্ক; Source: twimg.com

একজন প্রখ্যাত যায়নবিরোধী ইহুদি লেখক ড. আলফ্রেড লিলিয়েন্থাল তার ‘দ্য জিওনিস্ট কানেকশন’ বইটিতে লিখেছেন, “অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির উপর বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষা চালালে দেখা যাবে যে এটা কোনো টিনএজারের লেখা হওয়া সম্ভব নয়। লেখক মেয়ার লেভিন নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্টে অ্যানা ফ্রাঙ্কের বাবা অটো ফ্রাঙ্কের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ডায়েরি লেখার কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে প্রতিশ্রুত পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার দাবি করে মামলাটি করেন লেভিন।” (দ্য জিওনিস্ট কানেকশন, পৃষ্ঠা-৮১৯)

পরবর্তীতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে টের পেয়ে কোর্টের বাইরে লেভিনকে টাকা পরিশোধ করেন অটো ফ্রাঙ্ক, এমনটাই জানা গেছে। বহু বছর আগে এই মামলাটির নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা মিডিয়ার সিংহভাগ এই খবর প্রচার করা থেকে বিরত থেকেছে। আর এদিকে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি সমান তালে পুনর্মুদ্রিত হয়েই চলেছে, চলছে প্রকাশনার কাজও। বিশ্বজুড়ে যায়নবাদী ইহুদিদের ভিত্তি দৃঢ় করতে সাহায্য করে চলেছে কাল্পনিক এই সাহিত্য- এই বক্তব্যগুলো যাদের পক্ষ থেকে এসেছে, খোঁজ নিলে দেখা যায় তারা সবাই হলোকাস্ট ডিনায়াল বা হলোকাস্টকে অস্বীকার করার পক্ষপাতি। লেভিনের সাথে ব্যক্তিগত কিছু বিরোধের জের ধরে সম্পর্ক খারাপ ছিল অটো ফ্র্যাঙ্কের। কাজেই এমন একটি সুযোগ কোনোমতে হাতছাড়া করতে চায়নি লেভিন, সোজা আদালতে গিয়ে জোচ্চুরির মামলা ঠুকে দিয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৯৫৯ এবং ১৯৭৬ সালে দুটো মামলা করেন অটো ফ্রাঙ্ক।

এই দৃশ্যকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য যথাযথ প্রমাণ এই প্রমাণ এই পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি; Source: ytimg.com

“সত্য কখনো চাপা থাকে না”- এই প্রবাদবাক্যটি আরেকবার সত্য প্রমাণিত করে এই বইটি। অথবা সত্যিই হয়তো অ্যানা নামের সেই মেয়েটি খুব গুছিয়েই লিখেছিল তার জীবনের চরম সংকটের কথা। কে জানে সত্যিটা আসলে কী! হলোকাস্ট অস্বীকারের পক্ষে শক্ত কোনো যুক্তি নেই। এই সংক্রান্ত লেখাগুলো কোনোভাবেই নিরপেক্ষ না। হলোকাস্ট বলে কিছু ছিলো না এই মতবাদ ধরেই লেখা হয়েছে বইগুলো। তথ্যসূত্র ছাড়া গল্পের মতো করে লিখে দেয়া কিছু আর্টিকেল থেকে হলোকাস্ট বলতে কিছুই ছিল না এই যুক্তি মেনে নেয়া যায় না, অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির পুরোটাই ভুয়া এই কথাও বিশ্বাস করা যায় না।

তথ্যসূত্রঃ শরীফ, শাহরীয়ার, হলোকস্টের ইতিবৃত্ত, বর্ষাদুপুর (২০১৫), পৃষ্ঠা- ১৩-১৫

ফিচার ইমেজ- netdna-ssl.com

Related Articles