Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হোয়াইট সান অফ দ্য ডেজার্ট: একটি ইস্টার্ন চলচ্চিত্রের আখ্যান

১৯২০–এর দশক। রুশ গৃহযুদ্ধ ততদিনে শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় লাল ফৌজ আর ‘বাসমাচি’ দস্যুদের মধ্যে তখনো বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলছে। কাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব তীরে (বর্তমান তুর্কমেনিস্তানের ভূখণ্ডে) অবস্থিত মরুভূমির মধ্য দিয়ে ফিয়োদোর সুখোভ মধ্য রাশিয়ায় তার নিজ গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। সুখোভ লাল ফৌজের একজন অভিজ্ঞ সৈনিক, যে বেশ কয়েক বছর ধরে রুশ মধ্য এশিয়ায় ‘বাসমাচি’ দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং এখন সে তার প্রিয়তমা স্ত্রী কাতেরিনা মাৎভিয়েভনার কাছে ফিরে যেতে আগ্রহী।

মরুভূমির মধ্যে চলাকালে সুখোভ সাইদ নামক একজন মধ্য এশীয় ব্যক্তির দেখা পায়। বাসমাচি দস্যু নেতা জাভদেৎ সাইদের বাবাকে খুন করে তাদের সমস্ত সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে আর সাইদের হাত–পা বেঁধে তার গলা পর্যন্ত শরীর বালির মধ্যে ঢুকিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য রেখে গেছে। সুখোভ সাইদকে মুক্ত করে, কিন্তু তাকে ধন্যবাদ জানানোর পরিবর্তে সাইদ বলে ওঠে, ‘তুমি আমাকে এখান থেকে বের করলে কেন? যতক্ষণ না জাভদেৎ মারা যাচ্ছে, ততক্ষণ বিশ্রামের সুযোগ নেই!’ অবশ্য আনুষ্ঠানিকতা না দেখালেও সাইদ সুখোভের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করে, এবং তার পরবর্তী কার্যক্রমে সেটি প্রকাশ পায়।

সুখোভ ও সাইদ মরুভূমির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে, কিন্তু তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে লাল ফৌজের একটি ইউনিট আর বাসমাচি দস্যু নেতা আব্দুল্লাহর দলের মধ্যেকার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। লাল ফৌজ আব্দুল্লাহকে ধাওয়া করছে এবং আব্দুল্লাহ মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত তার দুর্গ থেকে পালিয়ে গেছে। পালানোর সময় তার স্ত্রীদেরকে সঙ্গে নিলে তার গতি কমে যাবে এবং লাল ফৌজের ইউনিটটি তাকে ধরে ফেলবে, এই আশঙ্কায় সে তার স্ত্রীদেরকে সঙ্গে নিয়ে যায়নি। কিন্তু তার স্ত্রীরা অন্য কারো হাতে পড়ুক, এমনটাও সে চায়নি। তাই পালানোর আগে আব্দুল্লাহ তার দুই স্ত্রীকে খুন করে রেখে গেছে, কিন্তু হারেমের বাকি মেয়েদের খুন করার সময় পায়নি। লাল ফৌজের যে ইউনিটটি আব্দুল্লাহর দুর্গ দখল করেছে, তারা এখন আব্দুল্লাহর স্ত্রীদের নিয়ে কী করবে, সেটা বুঝতে পারছে না, কারণ তাদেরকে একা ছেড়ে দিলেই আব্দুল্লাহ তাদের খুঁজে বের করে মেরে ফেলবে।

সুখোভ এবং সাইদ; Source: East European Film Bulletin

এই পরিস্থিতিতে সুখোভের সঙ্গে লাল ফৌজের ইউনিটটির দেখা হয়। ইউনিটের কমান্ডার রাখিমভ জোর করেই সুখোভের ওপর আব্দুল্লাহর স্ত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব অর্পণ করে এবং পেত্রুখা নামক একজন তরুণ সৈনিককে সুখোভের সহায়তার জন্য নিযুক্ত করে নিজের ইউনিট নিয়ে আব্দুল্লাহর পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যগ্র সুখোভ এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্বের কারণে ক্ষিপ্ত হয়, কিন্তু বাধ্য হয়ে তাকে এই দায়িত্ব নিতে হয়। সে ঠিক করে, আব্দুল্লাহর স্ত্রীদের নিকটবর্তী পেদঝেন্ত গ্রামে পৌঁছে দিয়ে সেখান থেকে সে ফিরে যাবে। সাইদ তাকে সেখানে যেতে নিষেধ করে এবং বলে যে, আব্দুল্লাহ তার স্ত্রীদের খোঁজে ঠিকই সেখানে পৌঁছে যাবে। সুখোভ সাইদকে তাদের সঙ্গে চলার জন্য অনুরোধ করে, কিন্তু সাইদ জাভদেৎ–এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়াকে নিজের প্রধান দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করে এবং তার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।

সুখোভ, পেত্রুখা ও আব্দুল্লাহর স্ত্রীরা কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী পেদঝেন্ত গ্রামে পৌঁছে। সেখানে সুখোভ স্থানীয় জাদুঘরের কিউরেটরের ওপর আব্দুল্লাহর স্ত্রীদের দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করে এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য পেত্রুখাকে সেখানে রেখে নিজের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার উপক্রম করে। কিন্তু সে জাদুঘরটি থেকে বের হওয়া মাত্রই আব্দুল্লাহর দলের দস্যুরা তাদেরকে বন্দি করে ফেলে। ঘটনার আভাস পেয়ে সুখোভ ফিরে আসে এবং আব্দুল্লাহর লোকেদের পরাস্ত করে মেয়েদেরকে মুক্ত করে। এরপর মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তাকে বাধ্য হয়েই জাদুঘরটিতে অবস্থান করতে হয়।

এদিকে সুখোভের কাছে বিশেষ অস্ত্রশস্ত্র ছিল না, তাই অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সে ও পেত্রুখা পেদঝেন্তে বসবাসরত প্রাক্তন শুল্ক কর্মকর্তা পাভেল ভেরেসচাগিনের সঙ্গে দেখা করে। ভেরেসচাগিন ও তার স্ত্রী নাস্তাসিয়া পেদঝেন্তে বসবাসকারী একমাত্র রুশ। রুশ সম্রাটের সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা ভেরেসচাগিনের কাছে মেশিনগান রয়েছে এবং সুখোভ তার কাছ থেকে সেটি সংগ্রহ করার চেষ্টা করে। কিন্তু নাস্তাসিয়া আশঙ্কা করে যে, সুখোভকে মেশিনগান দেয়া হলে আব্দুল্লাহর দলের লোকেরা তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। তার চাপে পড়ে ভেরেসচাগিন সুখোভকে মেশিনগান দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

সোভিয়েত অভিনেতা আনাতোলি কুজনেৎসভ সুখোভের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন; Source: Eric Berger/Twitter

সুখোভ আব্দুল্লাহর স্ত্রীদের আধুনিক জীবনের সঙ্গে পরিচিত করানোর চেষ্টা করে। সে তাদেরকে ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত শোনানোর ব্যবস্থা করে এবং বহুবিবাহ প্রথার নিন্দা করে। সে তাদেরকে জানায় যে, শীঘ্রই তাদের নতুন জীবন শুরু হতে যাচ্ছে এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা স্বামী থাকবে। অবশ্য আব্দুল্লাহর স্ত্রীরা এই ব্যাপারে তার মতামত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। উল্টো সুখোভ যেহেতু তাদের সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্ব নিয়েছে, সেজন্য তারা সুখোভকেই তাদের নতুন স্বামী হিসেবে ঘোষণা করে। সুখোভ তাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ও সবচেয়ে চটপটে স্বভাববিশিষ্ট গুলচাতাইকে তাদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রদান করে, কিন্তু গুলচাতাই এর ভুল অর্থ বের করে এবং আব্দুল্লাহর প্রাক্তন স্ত্রীদের কাছে ঘোষণা করে যে, তাদের নতুন স্বামী তাকে তার ‘প্রিয় স্ত্রী’ হিসেবে মনোনীত করেছেন!

এভাবেই এগিয়ে চলে সোভিয়েত চলচ্চিত্র ‘মরুভূমির শ্বেত সূর্যে’র (ইংরেজি: White Sun of the Desert; রুশ: Белое солнце пустыни, ‘বেলোয়ে সোলনৎসে পুস্তিনি’) কাহিনী। চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন সোভিয়েত বেলারুশীয় চলচ্চিত্রকার ভ্লাদিমির মোতিল। সোভিয়েত রুশ লেখক, নাট্যকার ও ‘গেরাসিমভ ইনস্টিটিউট অফ সিনেমাটোগ্রাফি’র অধ্যাপক ভালেন্তিন ইয়েঝভ এবং সোভিয়েত আজারবাইজানি নাট্যকার ও প্রযোজক রুস্তাম ইব্রাগিমবেকভ ছিলেন চলচ্চিত্রটির কাহিনীর রচয়িতা। ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এক ঘণ্টা ২৩ মিনিট দীর্ঘ এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিল ‘মসফিল্ম’–এর এক্সপেরিমেন্টাল স্টুডিও। চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য ব্যয় হয়েছিল প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ রুবল।

‘মরুভূমির শ্বেত সূর্য’ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষ এক জনরার চলচ্চিত্র, যেটিকে ইংরেজিতে ‘ইস্টার্ন’ বা ‘অস্টার্ন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ‘ওয়েস্টার্ন’ জনরার চলচ্চিত্রের সোভিয়েত প্রতিরূপ ছিল এই ইস্টার্ন/অস্টার্ন জনরার চলচ্চিত্রগুলো। উল্লেখ্য, ওয়েস্টার্ন জনরার চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনী সাধারণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ পশ্চিমাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে রচিত এবং শক্তিশালী বা দৃঢ় চরিত্রের রাখাল/বন্দুকধারী/সৈনিকদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। অনুরূপভাবে, ইস্টার্ন/অস্টার্ন জনরার চলচ্চিত্রগুলোর কাহিনী সাধারণত সোভিয়েত প্রাচ্যের (ককেশাস, কাজাখস্তান ও মধ্য এশিয়া) প্রেক্ষাপটে রচিত এবং শক্তিশালী বা দৃঢ় চরিত্রের বন্দুকধারী/সৈনিকদের কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে এই জনরার চলচ্চিত্রগুলো বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

দস্যুসর্দার আব্দুল্লাহ; Source: Azerbaycan24

‘মরুভূমির শ্বেত সূর্য’ চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ হয়েছিল মূলত বর্তমান রাশিয়ার দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের রাজধানী মাখাচকালার সন্নিকটে কাস্পিয়ান সাগরের তীরে, অবশ্য বর্তমান তুর্কমেনিস্তানেও চলচ্চিত্রটির অংশবিশেষের চিত্রগ্রহণ করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ প্রক্রিয়া ছিল সমস্যাসঙ্কুল: চিত্রগ্রহণ চলাকালে সেখানকার সেট থেকে বেশ কিছু জিনিস চুরি হয়ে গিয়েছিল; অভিনেতা–অভিনেত্রীদের মধ্যে অনেকেই পেশাদার অভিনেতা–অভিনেত্রী ছিল না; অভিনেতাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন খুবই উচ্ছৃঙ্খল এবং চিত্রগ্রহণ চলাকালে অসতর্কতার কারণে একজন স্টান্টম্যানের মৃত্যুও হয়! কিন্তু এতসব সমস্যা সত্ত্বেও ভ্লাদিমির মোতিল এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে সক্ষম হন যে, যেটি এখন পর্যন্ত রুশ বিশ্বে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এবং কার্যত একটি ‘কাল্টে’ পরিণত হয়েছে। এখনো রুশভাষী মানুষেরা চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সংলাপ ব্যবহার করে থাকে।

চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র সুখোভের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সোভিয়েত রুশ অভিনেতা আনাতোলি কুজনেৎসভ। সোভিয়েত রুশ অভিনেতা পাভেল লুস্পেকায়েভ এবং স্পার্তাক মিশুলিন যথাক্রমে জাঁদরেল ভেরেসচাগিন এবং স্বল্পভাষী সাইদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সোভিয়েত জর্জীয় অভিনেতা কাখি কাভসাদজে অভিনয় করেছিলেন দুর্ধর্ষ দস্যুসর্দার আব্দুল্লাহর চরিত্রে, আর আব্দুল্লাহর কনিষ্ঠতম স্ত্রী গুলচাতাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সোভিয়েত রুশ অভিনেত্রী তাতিয়ানা ফেদোতোভা (পরবর্তীতে তাতিয়ানা দেনিসোভা তার স্থলাভিষিক্ত হন)।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, চলচ্চিত্রটির কাহিনী বা প্লটের উৎপত্তি হয়েছিল নেহাতই ঘটনাচক্রে। লেখক ভালেন্তিন ইয়েঝভ একবার রুশ গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী লাল ফৌজের একজন সদস্যের সঙ্গে গল্প করছিলেন। সেই ব্যক্তি মধ্য এশিয়ায় লাল ফৌজের অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এবং সেসময় এক বাসমাচি নেতা লাল ফৌজের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে মরুভূমির এক দুর্গের মধ্যে তার স্ত্রীদের রেখে পালিয়ে যায়। এই গল্পের ভিত্তিতেই ইয়েঝভ ও ইব্রাগিমবেকভ ‘মরুভূমির শ্বেত সূর্য’ চলচ্চিত্রের কাহিনী গড়ে তোলেন।

সোভিয়েত অভিনেতা স্পার্তাক মিশুলিন সাইদের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন; Source: Russian Film Hub

‘মরুভূমির শ্বেত সূর্যে’র কাহিনী মধ্য এশিয়ায় লাল ফৌজ ও বাসমাচিদের মধ্যেকার লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে রচিত। তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে এটি ছিল একটি স্পর্শকাতর বিষয়, কারণ এই ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সামান্য উপস্থাপন সংক্রান্ত বা অন্য কোনো ত্রুটি থাকলেও সেটি মধ্য এশিয়ায় জাতিগত ও ধর্মীয় সমস্যার উদ্ভব ঘটাতে পারত। সোভিয়েত শাসনামলে বাসমাচিদের দস্যু হিসেবে উপস্থাপন করা হতো এবং এই চলচ্চিত্রেও বাসমাচিদেরকে ‘বর্বর দস্যু’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। কিন্তু চলচ্চিত্রটিতে অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে লাল ফৌজ–বাসমাচি লড়াইয়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে যতদূর সম্ভব অনুপস্থিত রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এবং কিছু কিছু পশ্চিমা ইতিহাসবিদ বাসমাচিদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। স্বভাবতই চলচ্চিত্রটিতে বাসমাচিদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন মধ্য এশিয়ায় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু কার্যত সেরকম কিছু হয়নি।

চলচ্চিত্রটির অন্যতম একটি উপজীব্য হচ্ছে নিজ আবাসস্থলের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক টান। সুখোভ বেশ কয়েক বছর ধরে মধ্য এশিয়ার মরুভূমিতে যুদ্ধ করে বেড়াচ্ছে, কিন্তু তার অন্তরের টান রয়ে গেছে মধ্য রাশিয়ায় অবস্থিত তার সবুজ গ্রামের প্রতি। এজন্য সে বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাকুল, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাড়ি ফিরতে দিচ্ছে না। চলচ্চিত্রটির শেষ পর্যায়ে গিয়ে অনুধাবন করা যায়, সুখোভ হয়তো কখনোই বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না, কারণ তার দায়িত্ববোধ তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বরাবরই কর্মক্ষেত্রমুখী করে রাখবে। এক্ষেত্রে সুখোভের দায়িত্ববোধ আর নিজ আবাসস্থলের প্রতি তার ভালোবাসার মধ্যে সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব চলমান, যেটিতে বরাবরই শেষ পর্যন্ত তার দায়িত্ববোধ বিজয়ী হয়।

চলচ্চিত্রের সুখোভ শক্তিশালী, সুদক্ষ যোদ্ধা, দেশপ্রেমিক ও কর্তব্যপরায়ণ, অর্থাৎ, সোভিয়েত চলচ্চিত্রের একজন আদর্শ বীরের যেসব গুণ থাকা প্রয়োজন, সবই সুখোভের মধ্যে বিদ্যমান। আদর্শ সোভিয়েত সৈনিক সুখোভের তুলনায় রুশ সাম্রাজ্যের প্রাক্তন অফিসার ভেরেসচাগিনের বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে ভিন্নধর্মী। ভেরেসচাগিন একসময় জাঁদরেল সেনা কর্মকর্তা ছিল, কিন্তু রুশ বিপ্লবের পর তার চাকরি চলে গেছে আর সেই সঙ্গে চলে গেছে তার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। জীবন সম্পর্কে হতাশ ভেরেসচাগিনের সময় কাটে গৌরবময় অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে আর মদ্যপানের মাধ্যমে। কেবল তার স্ত্রী নাস্তাসিয়ার কারণেই সে পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অতীতের গৌরবময়গুলো স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভেরেসচাগিন আর নাস্তাসিয়া দুজনের জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনে।

সোভিয়েত অভিনেত্রী তাতিয়ানা ফেদোতোভা গুলচাতাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন; Source: ForumDaily Woman

চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্র হচ্ছে স্বল্পভাষী সাইদ। তার প্রকৃত উদ্দেশ্য, আদর্শ বা মনোভঙ্গি কেমন, সেটি শেষ পর্যন্ত এক রহস্যই থেকে যায়। সুখোভ তাকে বালু খুঁড়ে বের করে তার প্রাণ রক্ষা করার পর তার প্রতিক্রিয়া ছিল, সুখোভ তাকে কেন বের করল? চারপাশে চলমান লড়াই, রুশ বিপ্লবের নতুন আদর্শ – এগুলোর কোনোকিছু নিয়েই সাইদের আগ্রহ দেখা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয় যে, তার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য দস্যুসর্দার জাভদেৎকে খুন করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়া, কিন্তু আসলেই কি তাই? গোটা চলচ্চিত্র জুড়ে সে নির্বিচারে খুন–খারাবি করতে থাকে, সেটা সুখোভকে সহায়তা করার জন্য হোক কিংবা অন্য কোনো উপলক্ষে হোক। সাইদ কি তাহলে সব বাসমাচির মধ্যেই জাভদেৎকে দেখতে পায়? সাইদের প্রকৃত আনুগত্য কি বলশেভিকদের প্রতি, না বাসমাচিদের প্রতি? এইসব প্রশ্নের জবাব অবশ্য নিশ্চিতভাবে দেয়ার কোনো উপায় নেই, কারণ চলচ্চিত্রে ইচ্ছা করেই এই বিষয়গুলোকে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে।

চলচ্চিত্রটির আরেকটি উপজীব্য হচ্ছে মধ্য এশিয়ায় নারীদের তদানীন্তন দুরবস্থা। স্ত্রীরা পথিমধ্যে তার গতি কমিয়ে দিতে পারে, কেবল এই কারণে আব্দুল্লাহ নিজের স্ত্রীদের খুন করে ফেলে। শুধু তাই নয়, নিজের স্ত্রীদের মধ্যে যাদেরকে সে সময়ের অভাবে মারতে পারেনি, তাদেরকে পরবর্তীতে খুঁজে বের করে খুন করার জন্য সে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে, কারণ তার ভাষ্যমতে, অন্য কারোর হাতে পড়ার আগেই আত্মহত্যা না করে তার স্ত্রীরা তার ‘মর্যাদা’ ক্ষুণ্ণ করেছে। অবশ্য তার এই নিষ্ঠুরতাকে মধ্য এশিয়ার মানুষেরা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে না, উল্টো সাইদ তাকে ‘যোদ্ধা’ হিসেবে প্রশংসা করে। এমনকি আব্দুল্লাহর স্ত্রীরা নিজেরাও এই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। অবশ্য বলশেভিকরা মধ্য এশিয়ায় নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে বিস্তৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, চলচ্চিত্রে সেটিরও আভাস পাওয়া যায় এবং মধ্য এশিয়ায় সামাজিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেই চলচ্চিত্রটি সমাপ্ত হয়।

সবশেষে, ‘মরুভূমির শ্বেত সূর্য’ চলচ্চিত্রটির যে দিকটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, সেটি হচ্ছে চলচ্চিত্রটিতে ব্যবহৃত সংলাপগুলো। এখনো প্রাচ্য সংক্রান্ত জটিলতার ক্ষেত্রে রুশরা সুখোভের ‘প্রাচ্যের ব্যাপারস্যাপার সূক্ষ্ম’ এই সংলাপটি ব্যবহার করে থাকে। ‘গুলচাতাই, তোমার মিষ্টি মুখখানা দেখাও’ – চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাওয়ার পর সোভিয়েত তরুণরা নিজেদের প্রেমিকাদের মান ভাঙাতে পেত্রুখার এই সংলাপটি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করত। আর কেউ যখন কোনো কাজে ব্যর্থ হয় এবং বোকার মতো সেটার দায় অন্য কিছুর ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, সেটা সম্পর্কে রুশরা এখনো ব্যবহার করে বাসমাচি সদস্য সেমিয়োনের সংলাপ, ‘ওর কাছে ভুল ক্যালিবারের গ্রেনেড আছে’!

This is a Bengali review article about the White Sun of the Desert, a Soviet Eastern film.

Source of the featured image: Russian Film Hub

Related Articles