সাহিত্য জগতের সবচেয়ে বড় সম্মাননা হিসেবে বিবেচিত হয় সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। সম্প্রতি ঘোষিত হয়েছে ২০১৯ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয়ীর নাম। ভাষার সৌকর্য এবং মানবিক অভিজ্ঞতার প্রান্তিক ও সুনির্দিষ্টতা উন্মোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় চলতি বছর এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন অস্ট্রিয়ান লেখক পিটার হ্যান্ডকি।
এছাড়া গত বছর নোবেল সাহিত্য কমিটির বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত কেলেঙ্কারি গণমাধ্যমে চলে এলে স্থগিত করা হয়েছিল ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। এবার ঘোষিত হয়েছে সেটিও। মানবজীবনের নানা সীমা অতিক্রমের গল্প নিজের কল্পনার তুলিতে ফুটিয়ে তোলার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জয়ী পোল্যান্ডের লেখক ওলগা তোকারচুক।
হ্যান্ডকি ও তোকারচুকের নোবেল জয়ের ব্যাপারে অধিকাংশ সাহিত্যবোদ্ধার আপত্তি না থাকলেও, বরাবরের মতো এবারও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এখনো সাহিত্যে নোবেল জয়ের জন্য উপযুক্ত মনে করা হলো না হারুকি মুরাকামি কিংবা মিলান কুন্ডেরার মতো সমকালীন সর্বোচ্চ খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের।
মজার ব্যাপার হলো, সমকালীন সর্বোচ্চ খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের নোবেল না জেতার দৃষ্টান্ত নতুন কোনো ব্যাপার নয়। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রচলনের শুরু থেকেই চলে আসছে এগুলো। অনেকে তো এমনও মনে করেন যে, নোবেল জয়ীর চেয়ে নোবেল জিততে না পারাদের তালিকা করলেই উঠে আসবে অপেক্ষাকৃত বেশি মহান সাহিত্যিকের নাম।
এমন দাবি অবান্তর নাকি যুক্তিসঙ্গত, তা তর্কসাপেক্ষ। তবে এটুকু বলাই যায় যে অনেক মহান সাহিত্যিকের নোবেল জয়ে ব্যর্থতা সত্যিই অনেক বিস্ময়কর। চলুন পাঠক, জেনে নেয়া যাক ইতিহাসের এমনই কয়েকজন মহান সাহিত্যিকের কথা, যারা সমকালীন পাঠক-সমালোচকদের হৃদয় জয় করে নিলেও, জিততে পারেননি সাহিত্যের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নোবেল।
লিও তলস্তয়
১৯০১ সালে যখন প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো, লিও তলস্তয় অবস্থান করছেন নিজের লেখক জীবনের মধ্যগগণে। নিজের সেরা লেখাগুলোর অধিকাংশও ইতিমধ্যেই প্রকাশ করে ফেলেছেন তিনি। তাই অনেকটাই ধরে নেয়া হয়েছিল, সাহিত্যে প্রথম নোবেলটি যাবে তাঁরই ঘরে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, শেষ পর্যন্ত নোবেল জেতেননি তিনি। কেননা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে একমত ছিল না নোবেল কমিটি। এতে অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। এমনকি অ্যাকাডেমির ভুল সিদ্ধান্তে হতভম্ব ৪২ জন সুইডিশ লেখক-শিল্পী মিলে তলস্তয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন তাদের অসন্তোষের কথা। মনে মনে ব্যথিত হলেও, তলস্তয় তার অনুরাগীদের চিঠির প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে,
"আমি জেনে খুবই খুশি হয়েছি যে আমাকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। এতে আমি খুব বড় একটি সমস্যার সম্মুখীন হওয়া থেকে বেঁচে গেছি। সেটি হলো, কীভাবে এত টাকা খরচ করব! আমি নিশ্চিত এই টাকা... কেবল অমঙ্গলেরই উৎস হতে পারে।"
আর. কে. নারায়ণ
দক্ষিণ ভারতের কাল্পনিক শহর মালগুডির পটভূমিকায় রচিত রচনাগুলো বিশ্বসাহিত্যের আকাশে নিজস্ব অবস্থান গড়ে দিয়েছে আর. কে. নারায়ণের। এছাড়া তিনি রচনা করেছিলেন ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের সংক্ষেপিত সংস্করণও। এসবের সুবাদে তিনি বেশ কয়েকবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত ও শর্টলিস্টেডও হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত সম্মাননা তাঁর জন্য অধরাই রয়ে যায়। নারায়ণের বন্ধু ও পরামর্শদাতা গ্রাহাম গ্রিন, যার মাধ্যমে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, প্রায়ই আশাবাদ ব্যক্ত করতেন যে একদিন তিনি অবশ্যই নোবেল জিতবেন। গ্রিনের সাথে তাল মিলিয়ে লর্ড জেফরি আর্চারও সম্প্রতি বলেছেন, সত্যিই নোবেল পুরস্কার প্রাপ্য ছিল নারায়ণের।
জর্জ অরওয়েল
অ্যানিমেল ফার্ম, ১৯৮৪ এর মতো উপন্যাস লিখে অমর হয়ে আছেন জর্জ অরওয়েল। কিন্তু পৃথিবী থেকে দেহাবসান কেড়ে নিয়েছে তাঁর সাহিত্যে নোবেল জয়ের সম্ভাবনা। যদি তিনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতেন, তাহলে হয়তো নোবেল পুরস্কারটা জিতেই যেতেন। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার, নিজের সম্ভাব্য সেরা কাজ ১৯৮৪ প্রকাশিত হওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ফলে নোবেল জয়ের সম্ভাবনাও যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে। কেননা মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় না। মৃত্যুর কারণে নোবেল জেতা হয়নি এমন আরো কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক হলেন ভার্জিনিয়া উলফ, মার্সেল প্রুস্ত এবং এফ. স্কট ফিট্জেরাল্ড।
হোর্হে লুইস বোর্হেস
প্রথম পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী বোর্হেস যথেষ্ট সময়ই বেঁচে ছিলেন নোবেল পুরস্কারে বিবেচিত হওয়ার জন্য। কিন্তু তারপরও তিনি যে নোবেল জেতেননি, সেটি যতটা না সাহিত্যিক কারণে, তার থেকে বেশি রাজনৈতিক কারণে। ভাবা হয়ে থাকে, বিভিন্ন ডানপন্থী সেনা স্বৈরশাসকদের প্রতি সহানুভূতিই কাল হয়েছে বোর্হেসের জন্য। চিলির অগাস্তো পিনোশে, স্পেনের ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কো এবং নিজ দেশ আর্জেন্টিনার হোর্হে রাফায়েল ভিদেলার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল তাঁর, যা নোবেল কমিটির আদর্শ পরিপন্থী। কেননা আলফ্রেড নোবেল চেয়েছিলেন যেন "সঠিক আদর্শিক পথে অসাধারণ কাজ করা" ব্যক্তিরাই তাঁর নামে নামাঙ্কিত পুরস্কারটি জেতে। নোবেল পুরস্কার না পাওয়ায় হতাশা ছিল বোর্হেসের মনেও,
"আমি হলাম সেই লাতিন আমেরিকান লেখক, যে কখনো নোবেল পুরস্কার জেতেনি। স্টকহোমের ওই মানুষগুলো ভেবেছেন, তাঁরা ইতিমধ্যেই আমাকে একটি পুরস্কার দিয়ে ফেলেছেন।"
রবার্ট ফ্রস্ট
অনেকের মতেই তিনি বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম কবি। চারবার পুলিৎজার পুরস্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেছেন তিনি, যে রেকর্ড তিনি ভাগাভাগি করছেন ইউজিন ও'নীলের সাথে। কিন্তু ও'নীল ১৯৩৬ সালে নোবেল পুরস্কার জিতলেও সেই সৌভাগ্য হয়নি ফ্রস্টের। ১৯৬১ সালে তাঁর বয়স যখন ৮৬ বছর, নোবেল কমিটি জানিয়েছিল যে আমেরিকান এই কবির অতিরিক্ত বয়সই নাকি তাঁর নোবেল জয়ের পথে "মৌলিক বাধা"। একই কারণে নোবেল জেতা হয়নি ই. এম. ফরস্টারেরও। অবশ্য ২০০৭ সালে ৮৭ বছর বয়সে ঠিকই নোবেল জিতে নিয়েছেন ডোরিস লেসিং।
হেনরিক ইবসেন
তাঁকে মনে করা হয় শেক্সপিয়ারের পর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রনাট্যকার। তাঁর গুরুত্ব ঠিক কতটা, তা বুঝতে পারবেন, যখন জানবেন অস্কার ওয়াইল্ড, জর্জ বার্নার্ড শ, জেমস জয়েস, আর্থার মিলার, ইউজিন ও'নীলদের মতো বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকারদের অনুপ্রেরণা ছিলেন এই ইবসেনই। তাহলে তিনি কেন কখনো জেতেননি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার? এর কারণ, নোবেল কমিটির দৃষ্টিতে তাঁর কাজগুলো ছিল অতিমাত্রায় বাস্তববাদী, যেখানে নোবেল কমিটির পছন্দ আদর্শবাদিতা। ঠিক একই কারণে নোবেল জেতা হয়নি মার্ক টোয়েইনেরও। ১৯০৭ সালে যেমন টোয়েইনকে প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করা হলেও, পরে পুরস্কারটি দেয়া হয় মাত্র ৪২ বছর বয়সী রুডইয়ার্ড কিপলিংকে। কারণ নোবেল কমিটির নিজস্ব আদর্শ ছিল অপেক্ষাকৃত "উঁচুদরের আড়ম্বরপূর্ণ আদর্শবাদিতাকে" স্বীকৃতি দেয়া।
চিনুয়া আচেবে
সুইডিশ অ্যাকাডেমি প্রায়শই সমালোচনায় বিদ্ধ হয় অতিমাত্রায় ইউরো-কেন্দ্রিক হওয়ার কারণে। হয়তো এ কারণেই নোবেল জেতা হয়নি নাইজেরিয়ান লেখক চিনুয়া আচেবের। এখন পর্যন্ত গোটা আফ্রিকা মহাদেশ থেকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন মাত্র চারজন: ওলে সোয়েনকা, নাগিব মাহফুজ, নাডিন গর্ডিমার ও জে. এম. কোয়েটজি (আলবার্ট কামু ও ক্লদ্ সিমোঁ ছিলেন ফ্রান্সের নাগরিক), যেখানে শুধু আয়ারল্যান্ড থেকেই সাহিত্যে নোবেল জিতেছেন চারজন: ডব্লিউ. বি. ইয়েটস, জর্জ বার্নার্ড শ, স্যামুয়েল বেকেট ও সিমাস হিনি।
আন্তন চেখভ
সর্বকালের সেরা ছোটগল্প লেখকদের তালিকা করা হলে সেখানে অনায়াসে ঢুকে পড়বেন চেখভ। কিন্তু তাঁকেই কি না চোখে পড়ল না নোবেল কমিটির! আসলে চোখে পড়েনি বললে ভুল হবে। চোখে পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়া হয়েছে। কারণ সুইডেনের সাথে রাশিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা। এমনটাই মনে করে রাশিয়ানরা। তাদের ধারণা, এই একই কারণে নোবেল জেতা হয়নি ম্যাক্সিম গোর্কিরও।
শেষ কথা
বলাই বাহুল্য, নোবেল কমিটিও রাজনীতির উর্ধ্বে নয়। ফলে তারা যে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সেরা সাহিত্যিক নির্বাচন করবে, সে আশাও করা বোকামি। সুতরাং কখনোই উচিত হবে না কেবল নোবেল জয়ের উদাহরণ দিয়েই কোনো সাহিত্যিককে মূল্যায়ন করা। নোবেল কোনো সাহিত্যিককে মূল্যায়নের মাপকাঠি হতে পারে না। যুগে যুগে অনেক মহান সাহিত্যিকই নোবেল জয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, কিন্তু তাতে তাদের সাহিত্যের অসাধারণত্বে বিন্দুমাত্র কমতি পড়েনি। আবার নোবেল জয় সত্ত্বেও কালের গর্ভে হারিয়ে গেছেন অনেক সাহিত্যিকই। দিনশেষে তাই নোবেলও অন্য যেকোনো পুরস্কারের মতো কেবল একটি পুরস্কারই, এর বেশি কিছু নয়।
নোবেলজয়ীদের নোবেলপ্রাপ্তির পর বক্তৃতা সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলো:
১) নোবেল ভাষণ : লাগের্লোফ্ থেকে য়োসা
২) নোবেল ভাষণ, এলিয়ট থেকে গুন্টার গ্রাস
বই-সিনেমা সংক্রান্ত চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/
This article is in Bengali language. It is about the great writers who never won the Nobel Prize in Literature. Necessary references have been hyperlinked inside.
Featured Image © Getty Images