Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বৈশ্বিক মহামারিতে কেমন আছে শ্রমজীবী শিশুরা?

কোভিড-১৯ এর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ইতোমধ্যেই আলোচনা শুরু করেছে বিভিন্ন সংস্থা এবং পত্রপত্রিকা। অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও এটি আরও কয়েকটি প্রধান ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষতিসাধন করেছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই। তবে উন্নয়নশীল বা মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এ ক্ষতির পরিমাণ খুবই বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, চলমান উন্নয়ন কাজ এবং জিডিপির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটি বর্তমানে পূরণ হলেও ভবিষ্যতে থমকে যেতে পারে। এছাড়াও মধ্যম আয়ের দেশের তকমা থেকে যেতে পারে আরও এক দশক। এত এত ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, তখন আরও একটি বিষয় ঠিকই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ইউনিসেফ সহ শিশুদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। করোনাভাইরাসের কারণে শ্রমজীবী শিশুদের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ইউনিসেফ ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)।

২০২০ সালের ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ‘কোভিড-১৯ ও শিশুশ্রম: সংকটের সময়, পদক্ষেপের সময়’ শীর্ষক এক যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংস্থা দু’টি। তারা আশঙ্কা করছে, গত দুই দশকে শিশুশ্রমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও এবার তা ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে। এ আশঙ্কার পেছনে সুস্পষ্ট কিছু কারণও দাঁড় করিয়েছে ইউনিসেফ এবং আইএলও। মূলত করোনাভাইরাসের কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে ব্যাপক হারে। এতে করে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো অভাবের তাড়নায় শিশুদের কাজ করতে বাধ্য করছে বলে ধারণা করছে সংস্থাটি। উল্লেখ্য, ২০০০ সালের পর শিশু শ্রমিকের সংখ্যা নয় কোটি ৪০ লাখে নেমে এসেছে, যা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়েও কম।

বাংলাদেশের একজন শিশু শ্রমিক; Image Source: Mahmud Hossain Opu/DhakaTribune

উক্ত যৌথ প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়, নতুন করে আরও ছয় কোটি মানুষ চরম দরিদ্রতার মুখোমুখি হতে পারে। কোনো কোনো হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি। আর ইউনিসেফের হিসেব অনুযায়ী, প্রতি এক শতাংশ দরিদ্রতা বাড়লে ০.৭ শতাংশ শিশুশ্রম বাড়বে। হিসেবটা যখন এমন, তখন ভবিষ্যতে খুব বড়সড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে, তা সহজভাবে অনুধাবন করা যায়। ইউনিসেফ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক করেছে। এখনই সতর্কতা অবলম্বন না করলে শিশুশ্রম যেমন কমানো যাবে না, তেমনি তাদের শিক্ষার অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। সেইসাথে বেড়ে যাবে অপরাধ এবং অরাজকতা। আর এর ফল ভোগ করতে হবে পুরো দেশ এবং জাতিকে। আজ আমরা দক্ষিণ এশিয়াসহ বৈশ্বিক শিশুশ্রমের ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করব। সেইসাথে বাংলাদেশের শ্রমজীবী শিশুদের বর্তমান অবস্থা এবং করণীয় দিকগুলো তুলে ধরব।

বিশ্বময় শিশু শ্রমিকদের অবস্থা

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ্বের ১৮৮টি দেশের অন্তত ১.৫ বিলিয়ন শিশু-কিশোর শিক্ষা ঝুঁকির মুখোমুখি। তাদের বেশিরভাগই এখন ঘরবন্দী জীবনযাপন করছে। তবে অনুন্নত এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট অনেকটাই ভিন্ন। বিভিন্ন সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৩৬৮.৫ মিলিয়ন শিশু স্কুলে প্রদানকৃত খাবার থেকে নিয়মিত বঞ্চিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় শিশুশ্রম বাড়ার বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে না নিয়েও উপায় নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুধুমাত্র এই ‘স্কুল মিল’ পদ্ধতি লাখ লাখ শিশুকে স্কুলমুখী করেছিল। সেইসাথে শিক্ষা-কার্যক্রম বাদ দিয়ে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেও তাদেরকে রক্ষা করত।

কোকোয়া সংগ্রহে কাজ করছে আফ্রিকার শ্রমজীবী শিশুরা; Image Source: raconteur. net

যেহেতু বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকার থেকে প্রাপ্ত নানা রকম সুযোগ-সুবিধা থেকে স্কুলগামী শিশুরা এখন পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছে, সেহেতু বর্তমান এবং ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট পুরোপুরি পাল্টে যেতে চলেছে। দারিদ্র্য বাড়ার কারণে অনেক পরিবার ঘরবন্দী শিশুদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছে না। এতে করে শিশুরা বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও শুধুমাত্র একটি কাজের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যোগ দিতেও তারা দু’বার ভাবছে না। এমন পরিস্থিতিতে মেয়েশিশুদের নিয়ে আলাদাভাবে উদ্বিগ্ন ইউনিসেফ এবং আইএলও। তারা আশঙ্কা করছে, বাণিজ্যিকভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারে মেয়েরা। এছাড়াও গৃহস্থালির কাজে স্থায়ীভাবে যোগ দেয়ার হার বাড়তে পারে। তাদেরকে আবারও সেখান থেকে ফিরিয়ে স্কুলে ফেরানো খুব সহজ হবে না বলেও জানিয়েছে ইউনিসেফ

কৃষিনির্ভর দেশগুলোতে গ্রামগঞ্জে বেড়ে ওঠা শিশু শ্রমিকদের বেশিরভাগই বিভিন্ন খামারে কাজ করে থাকে। মূলত কম মূল্যে শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগানো যায় বলেই এমন বৈষম্যমূলক পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে। গত দুই দশকে বাধ্যতামূলক শিক্ষা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা গ্রামীণ শিশুদের যেভাবে স্কুলমুখী করেছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তাদেরকে পুরোপুরি কর্মমুখী করেছে। ঘরে বসে না থেকে মাঠে কাজ করার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে তারা। নিম্ন আয়ের দেশে দারিদ্র্য যখন মূল সমস্যা, তখন একটি শিশুর তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হওয়া পুরো পরিবারের জন্য বড় একটি বিষয়। আর তাই অন্তত বেঁচে থাকার তাগিদে কর্মযজ্ঞ শুরু করা ছাড়া তাদের জন্য দ্বিতীয় কোনো পথও খোলা নেই।

কয়েকজন আফ্রিকান শ্রমজীবী শিশু; Image Source: Reuters/Finbarr O’Reilly

আরও একটি বিষয় গ্রামীণ শিশুদের জীবিকার তাগিদে শ্রমিক হিসেবে যোগদানে বাধ্য করছে। গ্রামীণ জনপদে ইন্টারনেট এবং বিদ্যুৎ সুবিধা নেই বললেই চলে। বিপরীতে শহুরে ছেলেমেয়েরা ইন্টারনেটের সংস্পর্শে থেকে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম যেমন চালিয়ে যেতে পারছে, তেমনি বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ের ভিন্ন মাধ্যমও খুঁজে নিচ্ছে। তাদের পক্ষে এমন সব পেশায় থেকে পুনরায় বিদ্যালয়ে ফেরা সম্ভব হলেও গ্রামীণ শিশুদের জন্য তা একেবারেই অসম্ভব বলা চলে। একবার আয়ের পথে পা বাড়ালে তাদের পরিবারও হয়তো বা চাইবে না, সন্তান পুনরায় বিদ্যালয়ে ফিরুক। কেননা, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দরিদ্রতা এবং বেকারত্ব রাতারাতি ঘোচাতে পারবে না কোনো দেশের সরকার। পরিপ্রেক্ষিতে শিশুশ্রমই হবে তাদের ভবিষ্যত।

২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী, শুধুমাত্র আফ্রিকা মহাদেশেই প্রায় ৭২.১ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩১.৫ মিলিয়ন শিশু বিপজ্জনক কাজ করছে, যা পৃথিবীর অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়েও বেশি। সেখানকার শিশু শ্রমিকদের ৫৯ শতাংশের বয়স ৫-১১ বছর, ২৬ শতাংশ ১২-১৪ বছর বয়সী এবং ১৫ শতাংশের বয়স ১৫-১৭ বছর। বিপজ্জনক কাজ ছাড়াও খননকাজ, কফি, কোকোয়া উৎপাদন এবং কৃষিকাজে যুক্ত রয়েছে এ অঞ্চলের অধিকাংশ শিশুশ্রমিক। বর্তমান প্রেক্ষাপট বাদ দিলেও সেখানকার শিশুদের স্কুলে ফেরাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেনি জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।

আফ্রিকান শ্রমজীবী শিশু; Image Source: theirworld.blog

সেভ দ্য চিলড্রেন-এর তথ্যমতে, পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার ৭৮ শতাংশ ছেলে এবং ৬৯ শতাংশ মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে, যা পৃথিবীর অন্য যেকোনো অঞ্চলের চেয়েও কম। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় এই অঞ্চলের কিছু সংখ্যক বিদ্যালয় খুলে দেয়া হলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। কেননা, ইতোমধ্যেই তারা বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই বৈশ্বিক মহামারি বিদায় নিলেও সর্বসাকুল্যে ১০ মিলিয়নের অধিক শিশু আর কখনোই বিদ্যালয়ে ফিরবে না। আর সেসব শিশুর এক-তৃতীয়াংশই হতে পারে পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকা অঞ্চলের। মেয়েদের ক্ষেত্রেও দারুণ সংকটের আশঙ্কা করছে সেভ দ্য চিলড্রেন। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলে গত চারমাসে বাল্যবিবাহের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সিয়েরা লিওনের নারী জোসেফাইন এক সাক্ষাৎকারে সেভ দ্য চিলড্রেনকে বলেন,

আমি যখন করোনাভাইরাসের কথা শুনি, তখন খুবই কষ্ট পাই। কারণ ইবোলা প্রাদুর্ভাব চলাকালে এভাবে স্কুল বন্ধ হয়েছিল। সেসময় আমি সন্তানসম্ভবা হই! আমার চিন্তা হচ্ছে, সেসময়ের পুনরাবৃত্তি এখন আরও মেয়েদের সাথে হতে পারে।

সিয়েরা লিওন, নাইজেরিয়া, সেনেগাল এবং বুর্কিনা ফাসো ইতোমধ্যেই রেডিও এবং টেলিভিশনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। এছাড়াও অনলাইন কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে দেশগুলো। কিন্তু পদক্ষেপগুলো আফ্রিকান শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ঠিক কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে, এ প্রশ্নটি এখন সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। ইউনেস্কোর দেয়া তথ্যমতে, প্রতি ১০ জন শিক্ষার্থীর ৯ জনেরই কম্পিউটার নেই। আর প্রতি ১০ জনের ৮ জনই ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এমতাবস্থায় বিদ্যালয়ে ফেরা অবধি আফ্রিকান শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আর তাই গত কয়েকমাস যাবৎ ঐ অঞ্চলে বিভিন্ন সেবামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি দেশগুলোকে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে আসছে সেভ দ্য চিলড্রেন।

এই বৈশ্বিক মহামারি উপ-সাহারীয় অঞ্চলের শিক্ষা কার্যক্রমের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় প্রায় ১৮ মাসের অতিরিক্ত অর্থ বাজেটে যোগ করতে হচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেন, উপ-সাহারা অঞ্চল নিয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকা নিয়ে বেশ আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। শুধুমাত্র শিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরাতেই বৈদেশিক সহায়তা এবং তহবিল গঠন করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করে। অন্যথায় ঐ অঞ্চলের সরকারের পক্ষে পুরো পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্ষতিপূরণ এবং বাজেটে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করা একেবারেই অসম্ভব। সংস্থাটির তথ্যমতে, শুধুমাত্র আফ্রিকা অঞ্চলেই ১.৪ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে। নয়তো ইবোলার সময় সেখানকার প্রাথমিক শিক্ষার হার যেমন কমেছিল, তার থেকেও বেশি শিক্ষার্থী এবারের মহামারিতে ঝরে পড়বে। সেইসাথে লাখ লাখ মেয়ে বাল্যবিবাহের সম্মুখীন হবে।

সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে, করোনাভাইরাস চলাকালে শিশুশ্রম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। এ অঞ্চলের প্রায় সবক’টি দেশই অনুন্নত। ফলে, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই এখানে শিশুশ্রম অত্যধিক প্রচলিত একটি প্রথা। বর্তমান হিসেব অনুযায়ী এই অঞ্চলের ৫-১৭ বছর বয়সী প্রায় ১৬.৭ মিলিয়ন শিশু-কিশোর বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তবে গত এক দশকে বাংলাদেশ, ভারত এবং শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপট অনেকটাই পাল্টেছে। শিক্ষার হার এবং জিডিপি বৃদ্ধির সাথে সাথে কমেছিল শিশু শ্রমের হার। কিন্তু নতুন করে চলমান এই করোনাকালীন সংকট এই অঞ্চলের শিশুদের শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন কাজে যোগ দিতে বাধ্য করছে।

একজন পাকিস্তানি শিশু শ্রমিক; Image Source: amp.dw.com

অর্থনৈতিকভাবে খুবই সংকটপূর্ণ সময় পার করা পাকিস্তানের অবস্থা এখন আরও খারাপের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। এখনও দেশটিতে প্রায় ১০ শতাংশ আর্থিক ঘাটতি রয়েছে। সেইসাথে রাজস্ব সংকটে ভুগছে দেশটির সরকার। এমন পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শিশু-কিশোররা তাদের আগের কাজগুলো হারিয়ে বিপাকে পড়েছে। এতে করে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিতেও দু’বার ভাবছে না তারা। কারণ দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে এই কাজগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত শিশু-কিশোরেরা। পাকিস্তানের প্রায় ১৮ মিলিয়ন লোক ইতোমধ্যেই চাকরি হারিয়েছেন, যার প্রভাব তাদের পরিবার এবং সমাজে ইতোমধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে।

ইউনিসেফের দেয়া তথ্যানুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ২২ মিলিয়ন শিশু-কিশোর কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়াও এ অঞ্চলের দারিদ্র্য অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। কেননা, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতি ১০ জন নাগরিকের ৭ জনই স্বীকৃত পেশায় নিয়োজিত নন। এতে করে প্রায় সবসময় চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকেন এই অঞ্চলের নাগরিকেরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, যার ফলে পরিবারের শিশু সদস্যসহ অন্যরা বিকল্প কাজের খোঁজে নিয়মিতই বিভিন্ন পেশায় নাম লেখাচ্ছেন।

ঘরবন্দী শিশু এবং তাদের অভিভাবক; Image Source: globalmarch

দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক খাত গার্মেন্টস শিল্প। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অর্ধেক শ্রমিক চাকরি হারিয়ে বর্তমানে বেকার হয়ে পড়েছেন। আর তাই তাদের সন্তানরা আবার পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারবে কি না, সে ব্যাপারেও নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সর্বোপরি, করোনাভাইরাসের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুশ্রম যে হারে বেড়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে আর এক দশক সময় লেগে যাবে। ততদিনে একটি প্রজন্ম শিক্ষাবঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ কিশোরী বাল্যবিবাহের সম্মুখীন হবে বলে আশঙ্কা করছে ইউনিসেফ।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম

বাংলাদেশের বেশিরভাগ শ্রমজীবী শিশুই মফস্বল কিংবা বড় শহরে কাজ করে। তবে গ্রামীণ জনপদে শ্রমজীবী শিশুদের সংখ্যাও রয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কিশোরদের শহরের পথে যাত্রা করার একটি বিশেষ ঝোঁক রয়েছে। আমাদের দেশের কলকারখানা এবং ছোট-বড় শিল্পগুলো শহরকেন্দ্রিক হয়ে গড়ে উঠেছে। আর সেখানকার শ্রমিকদের বড় একটি অংশ শিশুকিশোর। মূলত কম মজুরিতে শিশুদের দিয়ে কাজ আদায় করা যায় বলেই যুগ যুগ ধরে এমন চর্চা তৈরি হয়েছে আমাদের শ্রমবাজারে। অন্যদিকে, গ্রামের শিশু শ্রমিকদের একমাত্র পেশা কৃষিকাজ, যার ফলে বাড়তি আয়ের আশায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিতে ভয় পায় না তারা।

বাংলাদেশী শ্রমজীবী শিশু; Image Source: The Daily Observer

বর্তমান এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে শহুরে শ্রমজীবী শিশুদের নানা রকম নতুন দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। সেভ দ্য চিলড্রেন এবং ইউনিসেফ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের শ্রমজীবী শিশুদের নিরাপত্তা এবং বাসস্থান নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ঢাকায় গার্মেন্টস শিল্প বহু বছর যাবৎ চাকুরির সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে পরিচিত। দেশের গার্মেন্টস শিল্পে প্রায় ৫ মিলিয়ন শ্রমিকের উল্লেখযোগ্য অংশই শিশু। এছাড়াও গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ নারী, যাদের বেশিরভাগই ১৭ থেকে ২৫ বছর বয়সী। তাদের বসবাসের জায়গা এবং শিক্ষার অধিকার নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলেছিল বিভিন্ন সংস্থা।

বাস্তবিক গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিশুদের বেশিরভাগই অপরিচ্ছন্ন বস্তি এলাকায় বসবাস করে। অনেক মানুষ অনেক পেশায় যুক্ত বলে এই শিশুরা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু এটি ছাড়াও আরো একটি বড় সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে পোশাক শিল্পে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকরা। বর্তমানে বিভিন্ন দেশের রপ্তানি আদেশ সীমিত পর্যায়ে চলে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত শ্রমিক ছাঁটাই করছে। এতে করে অন্য সবার মতো চাকরি হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে শ্রমজীবী শিশু-কিশোরেরা।

দু’জন মেয়ে শিশু শ্রমিক; Image Source: orissaPost

চামড়া শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি বড় শিল্প। রপ্তানির হিসেব বাদ দিলেও দেশে চামড়ার তৈরি জিনিসপত্রের বড় বাজার রয়েছে। এ শিল্পকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে শ্রমজীবী শিশুদের বড়সড় অবদান রয়েছে। তাদের সস্তা শ্রমের বিনিময়ে চামড়া শিল্প দেশে এবং বিদেশে লাভজনক অবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছে। কিন্তু গত ঈদ-উল-ফিতরে আনুষ্ঠানিক লকডাউন থাকায় মার্কেটগুলো বন্ধ ছিল। যার ফলে বড়সড় লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর এমন পরিস্থিতিতে তারাও কর্মী ছাঁটাই করেছেন নিয়মিত। আর এই শিল্পে নিয়োজিত শিশুরা কাজ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছে নতুন কাজের আশায়।

গ্রামীণ মেয়ে শিশুদের একটি বড় অংশ শহরে বাসাবাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এটিও বাংলাদেশে শিশু শ্রমের একটি পুরাতন চর্চা। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনেক শহুরে পরিবার এসব মেয়ে শিশুদের কাজ থেকে ছাঁটাই করেছে। যেহেতু এ কাজে কোনো লিখিত চুক্তি নেই কিংবা ক্ষতিপূরণ নেই, সেহেতু এই মেয়েরা আবারও তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অভাবের তাড়নায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাদ দিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করাকে বেছে নেওয়া মেয়েদের গন্তব্য আবারও তাদের পরিবারের কাছেই।

ময়লা আবর্জনায় পুরাতন জিনিস খুঁজছে একজন পথশিশু; Image Source: Omar Havana/Getty Images

এছাড়াও দীর্ঘ লকডাউনের কারণে বন্ধ ছিল প্রায় সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান, সেলুন, বেকারি, প্যাকেজিং ইত্যাদি কাজে জড়িত শিশুরা কাজ হারিয়েছে আরও কয়েকমাস আগে। রাজধানী ঢাকাস্থ বেশিরভাগ ছোট-বড় ব্যবসার সঙ্গে শ্রমজীবী শিশুরা যুক্ত। এসব শিশুদের ৯৯ শতাংশ গ্রাম থেকে পাড়ি জমায়। একটা পর্যায়ে তারা তাদের পরিবারকেও সাহায্য করে থাকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা নিজেদের লোকসানের কথা চিন্তা করে শ্রমিক ছাঁটাই করছেন। আর কাজ হারানো এসব শিশুরা অভাবের তাড়নায় চুরি সহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে খুব সহজেই।

শ্রমজীবী শিশুদের অবস্থা যখন এমন, তখন পৃথিবীর অন্য সকল দেশের মতোই বাংলাদেশ সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ‘জীবন, নাকি জীবিকা?’ যদিও আশার কথা, গত জুন মাসে আনুষ্ঠানিক লকডাউন তুলে নেয় বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু দীর্ঘ তিনমাসের লোকসানের পর মাঝারি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোদমে চালু হয়নি রাজধানী ঢাকা সহ অন্যান্য শহরে। এতে করে চাকরি হারানো শ্রমজীবী শিশুরা কাজে ফিরতে পারবে, এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউই। এছাড়াও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পরিবারগুলোও তাদের পুরোনো গার্হস্থ্যকর্মীদের এখনই কাজে ফেরানোর কথা ভাবছে না। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি খুবই শোচনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। এ যেন বিস্ফোরণে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর মতো করে চাকরি হারানোর মতো অবস্থা।

বাংলাদেশী শ্রমজীবী শিশু; Image Source: Bangladesh Post

বাংলাদেশের শ্রমজীবী শিশুদের বৃহৎ একটি অংশকে পথশিশু বলা হয়। তাদেরকে এই দু’টি নামে ডাকার পেছনে দুটো কারণও রয়েছে। প্রথমত এরা সে সকল ১.৫ মিলিয়ন শিশুর অন্তর্গত, যাদের বসবাসের কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। রেলস্টেশন, ফুটপাথ, ফ্লাইওভারের নিচে, রাস্তার পাশে কিংবা বিভিন্ন ওভারব্রিজেই কাটে তাদের রাত। আর পেশাগতভাবে প্লাস্টিক, কাগজ, ময়লা কুড়ানোর সঙ্গে যুক্ত এরা। আবার এদের কেউ কেউ হকারি করেও জীবিকার্জন করে।

এককথায়, বাসস্থান না থাকায় এরা পথশিশু আর জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হওয়ায় এরা শ্রমজীবী শিশু। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে বাসস্থানহীন পথশিশুর সংখ্যা হওয়ার কথা ১.৫৬ মিলিয়ন। কিন্তু চলমান বৈশ্বিক মহামারিতে চাকরি হারানো আরও অনেক শিশু শ্রমিক পথশিশুদের মতোই জীবনযাপন করছে বলে আশঙ্কা করছে পথশিশুদের উন্নয়নে কাজ করা অনেক সংস্থা। এতে করে ২০২৪ সালের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তা ইতোমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

একজন হকার পথশিশু; Image Source: UNICEF

বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমজীবী শিশুরা একেবারে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছানোর আগে তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র তাদের শিক্ষা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। গার্হস্থ্যকর্মীরা কোনো কোনো দিক দিয়ে তাদের পরিবারের কাছে বোঝা। আবার গ্রামীণ শিশুরা অভাবে জর্জরিত পরিবারকে সাহায্য করতেই বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছে। আর পথশিশুদের ঠিকানা বলতে কিছুই নেই। তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে, এ পরিস্থিতি থেকে তাদেরকে উদ্ধার করবে কে? কে দেবে শ্রমজীবী শিশুদের দিকে তাকিয়ে থাকা পরিবারগুলোর নিরাপত্তা কিংবা স্থায়ী কাজের নিশ্চয়তা?

একজন শিশু শ্রমিককে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন একজন চিকিৎসক; Image Source: (Photo | P Jawahar, EPS)

অবশ্যই সরকারকে এ বিষয়গুলোর প্রতি নজর দিতে হবে। এযাবতকালে বিভিন্ন সহযোগিতা সংস্থা, এনজিও শ্রমজীবী শিশুদের নিরাপত্তা এবং অধিকারের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা করলেও তাদের অবস্থাও এখন খুব একটা ভালো না। সরকার গার্মেন্টস সহ বড় বড় শিল্পে প্রণোদনা ঘোষনা করেছে। এখনই সবচেয়ে বড় সুযোগ, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার। এছাড়াও সরকার চাইলেই শিশু কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক টেকসই কাঠামো প্রস্তুতের উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক, বেসরকারি এবং বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে পারে। এতে করে করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুর্ভোগ যেমন শিশুরা কাটিয়ে উঠতে পারবে, তেমনি সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। কারণ এক যুগ পরে হলেও তাদের সমস্যার সমাধান করে শিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হতো। আর এটি তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যেই পড়ে।

This article is in Bengali language. It is written about covid-19 effects in child labour's all over the world. This is the first time in recent history that schools almost everywhere around the world have closed. That's why many children's are joining different types of works. UNICEF said some of them never returns to school once again.

Necessary references have been hyperlinked inside the article.

Featured Image Source: African blog

Related Articles