মানবজাতির ইতিহাসের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রতারণার ঘটনা। প্রাচীন গ্রীক পুরাণে আমরা দেখতে পাই, ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস যখন স্পার্টার রানী হেলেনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, তখন গ্রিকরা তাদের রানীকে উদ্ধার ও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ট্রয় নগরীতে হামলা চালিয়েছিল। দশ বছরের যুদ্ধ শেষে কোনো কার্যকর সফলতা না পাওয়ায় শেষমেশ একটি কাঠের ঘোড়া নির্মাণ করে গ্রীকরা রণে ভঙ্গ দেয়। আদতে সেই কাঠের ঘোড়ার ভেতরে বাছাই করা গ্রিক সৈন্যদের রেখে আসা হয়েছিল, যাতে করে যখন ট্রয়ের সৈন্যরা সেই কাঠের ঘোড়া তাদের নগরীর ভেতরে নিয়ে যাবে, তখন সেই সৈন্যরা ঘোড়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে অতর্কিত আক্রমণ চালাতে পারে। তাদের এই পরিকল্পনা কাজে দিয়েছিল। শেষপর্যন্ত গ্রীকরা এই যুদ্ধে জয়লাভ করে। এটি হচ্ছে প্রাচীন যুগের এমন একটি ঘটনা, যেখানে যুদ্ধে জেতার জন্য প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। এটি কেবল একটি ঘটনা, ইতিহাস ঘাটলে এরকম শত শত ঘটনা পাওয়া যাবে। শুধু যুদ্ধ জয়ের ক্ষেত্রেই নয়, নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনেক সময়ই মানুষ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।
সাধারণত বৈধভাবে যখন কোনো কাজ করা যায় না কিংবা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখন মানুষ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে। যেমন একটা উদাহরণ হতে পারে এই, একজন লোক যে পেশায় নিয়োজিত আছে, সেই পেশায় বৈধভাবে খুব বেশি অর্থ আয় করার সুযোগ নেই, অথচ তার বড় অংকের অর্থের প্রয়োজন বা বিশাল অংকের অর্থ আয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে তার। এই ধরনের পরিস্থিতিতে যদি সেই মানুষটি প্রতারণার মাধ্যমে তার প্রত্যাশিত অংকের অর্থ আয় করার সুযোগ পায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে সে সেটিই করবে। আমেরিকায় বার্নার্ড লরেন্স ম্যাডফ বা সংক্ষেপে বার্নি ম্যাডফ সেই কাজটিই করতে চাচ্ছিলেন। প্রথমে বৈধ উপায়ে একটি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান দাঁড় করালেন। যেকোনো অর্থনৈতিক কাজের পেছনেই মানুষের স্বার্থ জড়িত থাকে। বার্নি ম্যাডফ চেয়েছিলেন এই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ আয় করতে। কিন্তু বিধিবাম। তাকে একসময় লোকসান দেখতে হলো। এরপর তিনি যা করেছিলেন, তা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতারণার ঘটনা।
১৯৬০ সালে বার্নি ম্যাডফ মাত্র বাইশ বছর বয়সে তার নিজস্ব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম ছিল 'বার্নার্ড এল. ম্যাডফ ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিজ এলএলসি.'। তার প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন এবং রক্ষী নিয়োগের খাতে বিনিয়োগ করেছিল। প্রথমদিকে তার পুঁজি ছিল অনেক কম। তিনি তার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের তার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৬২ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস ধরে আমেরিকার স্টক এক্সচেঞ্জে বিশাল দরপতন ঘটে। ইতিহাসে এই ঘটনাকে 'কেনেডি স্লাইড' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯২৯ সালের পর থেকে প্রায় তিন দশক ধরে আমেরিকার স্টক এক্সচেঞ্জ কলেবরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছিল, ফলে বিনিয়োগের পরিমাণ আরও বেড়ে গিয়েছিল। 'কেনেডি স্লাইড' এর কারণে বার্নি ম্যাডফ প্রায় দেউলিয়াত্বের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। পরে তার শ্বশুর তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
প্রথমবার ব্যর্থ হলেও তিনি একেবারে দমে গেলেন না। তিনি জানতেন, একটু চেষ্টা করলে এবং ভাগ্য পক্ষে থাকলে প্রচুর অর্থ আয় করা সম্ভব। তাই 'কেনেডি স্লাইড' এর কিছুদিন পর বার্নি ম্যাডফ, এবং তার ভাই পিটার ম্যাডফ নতুন পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হন। তারা দুই ভাই মিলে 'ইলেক্ট্রনিক ট্রেডিং' এর ধারণা হাজির করেন বিনিয়োগকারীদের সামনে। ইলেক্ট্রনিক ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে বন্ড, স্টক কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা কেনা-বেচা করা যায়। এটা করার জন্য প্রয়োজন হয় ইন্টারনেটের। আমেরিকায় তখন ইন্টারনেট সুবিধা সহজলভ্য হতে শুরু করেছিল। অনেক বাড়িতে ইন্টারনেটের সুবিধা পৌঁছে গিয়েছিল। আর গতানুগতিক কাগজপত্রের ঝামেলার চেয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে 'ইলেক্ট্রনিক ট্রেডিং'য়ে সুবিধা ছিল অনেক বেশি। ম্যাডফ ভাইদের এই ব্যবসায়িক ধারণা অসংখ্য বিনিয়োগকারীকে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়, প্রচুর 'অর্ডার' আসতে থাকে তাদের প্লাটফর্মে। ১৯৮০'র দশকের শেষ দিকে তিনি বছরে প্রায় একশো মিলিয়ন ডলারের মতো আয় করতে শুরু করেন। তিনি এবং আরও চারটি প্রতিষ্ঠান মিলে নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের প্রায় অর্ধেক 'অর্ডার' লাভ করতে শুরু করেন।
এই ফাঁকে 'পঞ্জি স্কিম' (Ponzi Schme) সম্পর্কে একটু জানা যাক। যেসব প্রতিষ্ঠান 'পঞ্জি স্কিম' এর সাথে যুক্ত থাকে, তারা বিনিয়োগকারীদের উচ্চহারে লাভের সম্ভাবনা দেখিয়ে বিনিয়োগ করতে প্রলুব্ধ করতে। চার্লস পঞ্জি নামের একজন ইতালীয় নাগরিক আমেরিকায় এসে একসময় মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিনে ৫০% লাভ, এবং নব্বই দিন তথা তিন মাসে ১০০% লাভের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তিনি তার ব্যবসার যে মডেল দেখিয়েছিলেন, সেটি বেশ আগ্রহোদ্দীপক ছিল, যারা বিনিয়োগ করেছিলেন তারা ভেবেছিলেন সত্যিই বোধহয় চার্লস পঞ্জি যে মুনাফার হিসাব দেখিয়েছেন, তা সত্যি হবে। তার এই ব্যবসা টিকেছিল মাত্র এক বছর, এরই মধ্যে তিনি প্রায় বিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। একসময় তার প্রতারণা ফাঁস হয়ে যায়, তার নামে আদালতে মামলা করা হয়। আদালতে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে ১৯২০ সালে তাকে চৌদ্দ বছরের কারাদন্ড প্রদান করা হয়।
প্রতিটি পঞ্জি স্কিমে একজন কেন্দ্রীয় পরিচালক থাকেন। তার মূল কাজ হচ্ছে যেকোনো উপায়ে প্রতিষ্ঠানে নতুন বিনিয়োগের ধারা অব্যহত রাখা। সাধারণ পঞ্জি স্কিমে যেটা করা হয়, সেটি হচ্ছে নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয়, সেটি কোনো খাতে বিনিয়োগ না করেই পুরোনো বিনিয়োগকারীদের হাতে লাভ হিসেবে প্রদান করা হয়। যেমন বিষয়টা অনেকটা এরকম যে, একজন দুই বছর আগে এক হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিল। এবং হিসাব অনুযায়ী তিনি যদি এখন তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত চান, তাহলে ১৫০০ টাকা দিতে হবে। পঞ্জি স্কিম এর মূল কাজ হচ্ছে, নতুন যদি কেউ ৩০০০ টাকা বিনিয়োগ করে, তাহলে তার কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ থেকে আগের বিনিয়োগকারীকে ১৫০০ টাকা প্রদান করা। ঠিক একইভাবে নতুন যিনি বিনিয়োগ করলেন, তিনি ভবিষ্যতে বিনিয়োগকৃত টাকা ফেরত চাইলে তাকেও সেভাবে অন্য কোনো বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ফেরত দেয়া হবে। কিন্তু কখনও যদি নতুন বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যায়, তখনই 'পঞ্জি স্কিম' এর সমস্ত প্রতারণা ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
বার্নি ম্যাডফ ও তার ভাই পিটার ম্যাডফের এই পঞ্জি স্কিমে এই সমস্যাই দেখা দিয়েছিল। তারা বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে যে অর্থ লাভ করছিলেন, সেটা দিয়ে তারা পুরনো বিনিয়োগকারীদের মুনাফাসহ আসল প্রদান করছিলেন। অনেক বিনিয়োগকারী তাদের কাছে ব্যবসার মডেল সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা 'জানাজানি হলে ব্যবসা লোকসানের সম্মুখীন হতে পারে' এই যুক্তি প্রদান করে তথ্য প্রদান থেকে বিরত থাকতেন। কিন্তু যেহেতু পুরনো বিনিয়োগকারীরা যথাসময়ে তাদের অর্থ পেয়ে যাচ্ছিল, তাই কেউ প্রাথমিকভাবে কোনো সন্দেহ করেনি। আর কোম্পানির কর্ণধার বার্নি ম্যাডফ নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে নিজের এমন এক প্রতিচ্ছবি দাঁড় করিয়েছিলেন যে, তিনি প্রতারণা করতে পারেন, এটা ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি। কিন্তু একপর্যায়ে ব্যবসার পরিধি এত বেড়ে গিয়েছিল যে, পুরনো বিনিয়োগকারীরা যখন মুনাফাসহ তাদের বিনিয়োগ করা অর্থ লাভ করে, তখন তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার! অথচ কোম্পানির হাতে তখন বিনিয়োগকারীদের প্রদান করার জন্য দুইশো থেকে তিনশো মিলিয়ন ডলার ছিল মাত্র।
২০০৮ সালে বার্নি ম্যাডফ যখন তার দুই সন্তান মার্ক এবং অ্যান্ডিকে তার পঞ্জি স্কিম সম্পর্কে বলে বলেন, তখন তারা অবাক হয়ে যায়। এরপর তারা আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের 'প্রতারক' বাবার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। সেই বছরের ১১ ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৯ সালে আদালতের সামনে বার্নি ম্যাডফ দোষী সাব্যস্ত হন। তাকে প্রায় এগারোটি অপরাধে মোট ১৫০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তার আইনজীবীরা বার বার শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে তার শাস্তি কমিয়ে আনার আবেদন জানালেও আদালত প্রতিবার নাকচ করে দিয়েছিল। গত বছরের এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার এই ঘটনা মার্কিন ইতিহাস তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতারণার ঘটনাগুলোর একটি। এখনও পর্যন্ত অসংখ্য বিনিয়োগকারী, যারা তার সেই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের পুরো অর্থ ফেরত পাননি।
Language: Bangla
Topic: Bernie Madoff's Ponzi Scheme
Reference:
২) Bernie Madoff, financier behind largest Ponzi scheme in history, dies in prison - The Guardian