একটি দেশের বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ নির্ধারিত হয় নাগরিকদের থেকে প্রাপ্ত আয়কর থেকে। দেশভেদে তাই আয়করেরও রয়েছে ভিন্নতা। বিশেষ করে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের কথাই বলা যাক। সেখানে থাকতে গেলে আপনাকে অনেক বেশি অর্থ খরচ করতে হবে। কারণ সেসব দেশের মানুষের জীবনমান যেমন অনেক উঁচু, তেমনি প্রতিবছর তারা সরকারকে বড় অঙ্কের আয়করও জমা দিয়ে থাকে। এভাবেই সরকার নাগরিকদের সেবা দিতে আয়-ব্যয়ের একটা ভারসাম্য তৈরি করে। আর যদি কোনো দেশ নাগরিকদের কাছ থেকে আয়কর সংগ্রহ না করে, তাহলে কী ঘটে?
এখানে একটি মজার ব্যাপার ঘটে! নাগরিকদের কাছ থেকে আয়কর সংগ্রহের বদলে এসব দেশ তাদের খনিজ সম্পদ কিংবা অন্য খাত থেকে আয় করে থাকে। যে আয়ের উপর ভর করে তারা নিজেদের অর্থনীতি সচল রাখে। খোদ আমেরিকারই একটি অঙ্গরাজ্যে কোনো আয়কর নেই! আলাস্কার কথাই বলছি। এখানকার জাতীয় বাজেট লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ বাস্তবায়িত হয় তাদের উৎপাদিত তেল থেকে। ফলে সেই রাজ্যের নাগরিকদের তো কোনো কর দিতেই হয় না, উল্টো তেল বিক্রির আয়ের মুনাফা ভোগ করে তারা!
আবার এমনও দেশ আছে যারা সরাসরি আয়কর সংগ্রহ করে না, তবে এদের আঞ্চলিক কর রয়েছে। যার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় উৎসগুলো থেকে আয়কর নিয়ে থাকে। যেমন- সিঙ্গাপুর, তাদের কোনো নাগরিক কর নেই। তারা স্থানীয় বিনিয়োগের উপর কর ধার্য করে থাকে। কিন্তু সেখানে যদি বিদেশী বিনিয়োগ থাকে, তবে বিনিয়োগের সেই অংশের কোনো কর নেই। এভাবে তারা বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। এভাবেই সিঙ্গাপুর নিজেদের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। আজকের লেখাটি যেহেতু আয়করবিহীন দেশগুলো নিয়েই, তাই সরাসরি সেসব দেশ নিয়েই জানব আমরা।
১. বাহামাস
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘বাহামাস’ নামক ক্ষুদ্র দেশটির অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী। এমন ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির পেছনে বড় একটি শক্তি হিসেবে কাজ করছে দেশটির পর্যটন শিল্প। সুন্দর সব সমুদ্র সৈকতে সময় কাটাতে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতি বছর অনেক পর্যটক আসেন এখানে। সাজানো-গোছানো দেশটিতে থাকতে গেলে খুব একটা কাঠ-খড় পোড়াতে হয় না। পকেটে অল্প কিছু পয়সা থাকলে সহজেই এখানে নিজের একটি ঠিকানা তৈরি করতে পারেন।
তবে সম্প্রতি বাহামাস সরকার তাদের বিদেশী নাগরিকদের জন্য নতুন একটি আইন তৈরি করেছে। ফলে কেউ এখন থেকে বাহামাসে থাকতে গেলে বিনিয়োগ করতে হবে সেখানে। কিংবা প্রতি বছর আপনাকে ১,০০০ ডলার দিয়ে নিজের অবস্থান নবায়ন করতে হবে। আর যদি স্থায়ী আবাস গড়তে চান, তবে ২,৫০,০০০ ডলারের সম্পত্তি কিনতে হবে। তাই সেই দেশের কর্তৃপক্ষকে যদি খুশি রাখতে চান, অভিবাসী হিসেবে বেশি করে বিনিয়োগ করতে হবে আপনাকে। যদিও বাহামাসে কোনো আয়কর নেই, তবে সেখানকার নাগরিক ব্যয় অনেক বেশি।
২. আরব আমিরাত
অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সূচক অনুসারে, মুক্ত বাণিজ্য আর স্বল্প করের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত পৃথিবীতে দশম স্থান দখল করে আছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো তারাও প্রচুর তেল উত্তোলন করে থাকে। তেল বিক্রির অর্থ থেকেই নিজেদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে তারা। পাশাপাশি সেই দেশে অবস্থানকারী নাগরিকদেরও আয়কর বাবদ গুণতে হয় না কোনো অর্থ।
উপসাগরীয় দেশগুলোর মাঝে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিদেশী বিনিয়োগকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করে থাকে। এখানেই রয়েছে দুনিয়ার কাছে পরিচিত এক শহর ‘দুবাই’। কেবলমাত্র দুবাইকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিলিয়ন ডলারের সব মেগা প্রজেক্ট। বিনিয়োগের ব্যাপারগুলোতে তাদের উদারতার জন্যই এটি বিনিয়োগকারীদের কাছে পছন্দনীয় একটি গন্তব্য।
বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়িক কার্যক্রম যাতে নিজস্ব গতিতে চলতে পারে, সেজন্য আরব আমিরাত সদা সতর্ক। জীবনমানের দিক থেকে আরব আমিরাত অনেক উন্নত দেশের কাছেও ঈর্ষার দাবীদার। সামাজিক সুরক্ষা আর সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার দিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত আশপাশের দেশগুলো থেকে বেশ উদার। যদিও বিশেষ কিছু ব্যাপারে তাদের এখনো বেশ কড়াকড়ি অবস্থান রয়েছে। যেমন- মদ্যপানের জন্য যে কাউকে ৫০ শতাংশ কর দিতে হবে। আর তিনি যদি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান, তবে অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ কর পরিশোধ করতে হবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাসিন্দা হওয়া উপসাগরীয় অনেক দেশের চেয়েও সহজ। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য স্থায়ী বসবাসের সুযোগ না থাকলেও, তাদের ভিসা নবায়ন চুক্তি অনেক সহজতর। সম্প্রতি ১০ বছর মেয়াদি নতুন ভিসা সেবা চালু করেছে সেখানকার সরকার। ফলে বিনিয়োগকারীরা চাইলে কয়েক দশক এখানে থেকে যেতে পারেন।
৩. ওমান
আমাদের তালিকায় থাকা আরব আমিরাতের মতো ওমানও তেল আর গ্যাসের কল্যাণে ধনী একটি রাষ্ট্র। তবে নিজেদের তেল আর গ্যাসের উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে তারা বরং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে আগ্রহী। যার কারণে ওমান বিদেশী বিনিয়োগকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। যদিও তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উঠে-পড়ে লাগেনি। এর একটি কারণ হতে পারে, তারা এখনো নিজেদের অবকাঠামো বিদেশী বিনিয়োগের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারেনি।
তাছাড়া সাংস্কৃতিক দিক থেকেও ওমানে বেশ কড়াকড়ি রয়েছে। যেমন, মদ পান করার জন্যও আপনাকে পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতে পারে।
ওমানে বসবাস করা নাগরিকদের প্রকৃত অর্থে কোনো আয়কর দিতে হয় না। তবে তাদের কাছ থেকে ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ প্রদানের জন্য কিছু অর্থ নেওয়া হয়। ক্ষেত্রবিশেষে এই হার ৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এই অর্থ বাসিন্দাদের অবসরকালীন ভাতা হিসেবেও ব্যয় করে হয়। এছাড়াও চিকিৎসা বাবদ বাড়তি এক শতাংশ অর্থ নেওয়া হয়, বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য।
৪. কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জ
কেইম্যান হলো পশ্চিম ক্যারিবিয়ান সাগরের স্বায়ত্ত্বশাসিত তিনটি দ্বীপের সমষ্টি। অন্যান্য আয়করহীন রাষ্ট্রের মতো কেইম্যানেও থাকতে গেলে কোনো কর দিতে হয় না। এখানকার বাসিন্দাদের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ আনুসাঙ্গিক যাবতীয় খরচ আসে তাদের বন্দর আর পর্যটনকেন্দ্রগুলো থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে। প্রতিনিয়ত বিদেশী জাহাজে করে আসা পণ্য, আর সমুদ্র সৈকতে বিলাসীদের আনাগোনা এখানকার অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখছে।
অন্যান্য ক্যারিবিয়ান দেশের মতো আপনি যত বেশি বিনিয়োগ করবেন এখানে, ততই নাগরিকত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। তবে বিনিয়োগ করলেই হবে না, এখানে অন্তত ৮ বছর অবস্থান করলে তবেই মিলবে স্থায়ী নাগরিকত্ব।
৫. মোনাকো
পশ্চিম ইউরোপের বিলাসবহুল একটি দেশ মোনাকো। আয়কর মুক্ত দেশগুলোর ভেতর মোনাকোতে নাগরিকত্ব পাওয়া তুলনামূলক সহজসাধ্য। তবে সেজন্য আপনাকে একজন ধনকুবের হিসেবে সেখানে হাজির হতে হবে!
প্রতি বছর ইউরোপসহ বিশ্বের তাবৎ ধনীরা এখানে অবকাশ যাপন করতে আসেন। ফলে পর্যটন থেকে দেশটি প্রচুর অর্থ পেয়ে থাকে। যার ফলে বাসিন্দাদের আয়করের ঝামেলায় পড়তে হয় না।
নির্দিষ্ট কিছু ব্যবসা ছাড়া মোটামুটি সবগুলো খাত আয়কর মুক্ত। দেশের বাইরে বিনিয়োগ করতে হলে ব্যবসায়ীদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়, তবে সেটা তাদের লাভের অংশ থেকে।
বিনিয়োগকারীদের কাছে মোনাকো আকর্ষণীয় হওয়ার আরও একটি কারণ আছে। আর সেটা হলো তাদের গোপনীয়তা নীতি। এই নীতির কারণে যে কেউ চাইলেই কোনো প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগকারীদের তথ্য জেনে নিতে পারে না।
৬. মালদ্বীপ
নিচে স্বচ্ছ পানি, তার উপর সাজানো সব কটেজ! চাইলেই পানিতে ঝাঁপ দিয়ে শরীরটা চাঙ্গা করে নেওয়া যায়। সাঁতরে এসে দেখবেন আপনার সামনে বাহারি সব খাবার সাজিয়ে রাখা হয়েছে! এমন দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যায় ভারত মহাসাগরের বুকে জেগে উঠা ছোট একটি দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে।
এখানকার বাসিন্দাদের কোনো আয়কর জমা দিতে হয় না। তবে পানি আর কটেজের রাজ্যে থাকতে হলে পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে আপনার কাছে। সেটাও খুব বেশিদিনের জন্য নয়। কারণ বাইরের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার এখনো কোনো সুবিধাজনক আইন নেই সেখানে।
তারপরও তাদের পর্যটন শিল্প এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। মূলত কৃত্রিমতা বিবর্জিত আর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসেন, এমন মানুষগুলোই প্রচুর টাকা খরচ করে এখানে ঘুরতে আসেন।
This article is about some countries with no income taxes.
Necessary sources are hyperlinked in the article.
Featured Image: gordonblair.com