‘ডাচ ডিজিজ' শুনলে কী মনে হয়? কোনো রোগের নাম? আপনার ভাবনাটা নিতান্তই ভুল নয়। এটি রোগেরই নাম। তবে তা মানুষ বা কোনো প্রাণীর নয়, বরং কোনো দেশের অর্থনীতির।
ডাচ ডিজিজ কী?
কোনো দেশের একপ্রকার অর্থনৈতিক অবস্থা হলো ডাচ ডিজিজ। এ অবস্থায় একদিকে দেশের অর্থনীতির একটি বিশেষ ক্ষেত্রের দ্রুত উন্নতি এবং অপরদিকে অন্যান্য ক্ষেত্রের পতন দেখা যায়, যার ফলে দেশীয় মূদ্রার মূল্য স্বাভাবিকের চেয়ে অধিকতর বেড়ে যায়। ডাচ ডিজিজে মূলত প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক কোনো ক্ষেত্রের উন্নতিকে বোঝানো হয়। দীর্ঘমেয়াদে ডাচ ডিজিজের পরিণাম দাঁড়ায় ভয়াবহ। একটু সহজভাবে বলতে গেলে, ডাচ ডিজিজ হলো এমন একটি অর্থনৈতিক ঘটনা, যা ঘটে যখন কোনো দেশের জন্য ভালো কোনো খবর থাকে; যেমন- কোনো প্রাকৃতিক সম্পদের আবিষ্কার। কিন্তু এর ফলে নিকট ভবিষ্যতে দেশটির অর্থনীতির উপর ইতিবাচক প্রভাব না পড়ে নেতিবাচক প্রভাবেরই প্রসার ঘটে। এক্ষেত্রে এমন কোনো সীমিত পরিমাণের বস্তুর (প্রাকৃতিক সম্পদ) ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে ওঠে একটি দেশের অর্থনীতি। আর সীমিত কোনো সম্পদের উপর নির্ভরশীলতা কোনো দেশের জন্য সবসময়ই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কোনো দেশের অর্থনীতি প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক ক্ষেত্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে উঠলে বুঝতে হবে যে, নিকট ভবিষ্যতে দেশটি ‘ডাচ ডিজিজ'-এর সম্মুখীন হতে পারে। এই নির্ভরশীলতা কেন হানিকর, তার উত্তর খুব ছোট করে বলা যায়। আপনি নিজেই চিন্তা করুন। যেকোনো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত। সুদূর ভবিষ্যতে এর সমাপ্তি ঘটবে, সেটাই স্বাভাবিক। একটি দেশের অর্থনীতি মূল যে ক্ষেত্রের ওপর নির্ভর করে চলছে, সেই ক্ষেত্রের কাঁচামালই যদি না থাকে, তাহলে ক্ষেত্রটা চলবে কী করে আর দেশের সমগ্র অর্থনীতিই বা চলবে কী করে? অর্থাৎ, এক্ষেত্রে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থায় ধ্বস নামা স্বাভাবিক বিষয়। এই ধ্বস তৎক্ষণাৎ না ঘটলেও ভবিষ্যতে ঘটতেই পারে। আবার আরেকদিকে প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক ক্ষেত্র নয় যেগুলো, সেসব ক্ষেত্রের বা ঐ দ্রব্যগুলোর চাহিদা বিশ্ব বাজারে কমে যাওয়ার কারণে রপ্তানিও কমে যায়। এমন অবস্থায় নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত দ্রব্য বাদে বাকি দ্রব্যগুলোর জন্য আমদানির উপরই নির্ভরশীল হতে হয়। ফলে, ঐ ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ এবং চাকরির সুযোগ দু'টোরই অভাব দেখা যায়। এতে করে দীর্ঘমেয়াদে বেকারত্ব বাড়তেই থাকে। আর ম্যানুফ্যাকচারিং এবং এ ধরনের শিল্প সংক্রান্ত কাজ চলে যায় নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে। ফলে দেশের মানুষই কাজের অভাবে ভুগতে থাকে। অতিরিক্ত মূদ্রাস্ফীতি, আয়ের দিক থেকে অতিরিক্ত বৈষম্য এবং দেশের আমদানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়াটা বারবারই ডাচ ডিজিজের পূর্বাভাস দিতে থাকে।
ডাচ ডিজিজের শুরু
সর্বপ্রথম ১৯৭৭ সালে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ম্যাগাজিনে ‘ডাচ ডিজিজ’ শব্দের প্রয়োগ করা হয়। ম্যাগাজিনটি মূলত ১৯৫৯ সালে নেদারল্যান্ডসে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল এলাকা আবিষ্কৃত হওয়ার পর সেখানে কীরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা ব্যাখা করার জন্য এটি ব্যবহার করে। সেই সময়ে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেলের অতিরিক্ত রপ্তানি শুরু হয়। ফলে নেদারল্যান্ডসের আয় অতিরিক্ত বেড়ে যায়।
অবশ্য এই বৃদ্ধি মূলত যারা এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সাথে জড়িত, তারাই অনুভব করতে পারে। তবে সমস্যা তখন শুরু হয়, যখন অধিক রপ্তানির ফলে ডাচ গিল্ডার তথা ডাচ মুদ্রার মূল্য বেড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে যেসব দ্রব্য প্রাকৃতিক গ্যাস কিংবা তেলের সাথে সংযুক্ত নয় সেগুলো বিশ্ব বাজারে কম প্রতিযোগিতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। সোজা কথা হলো, ঐ একটি ক্ষেত্র বাদে বাকি ক্ষেত্রগুলো অকেজো হতে শুরু করে।
ডাচ ডিজিজের সাথে তুলনামূলক সুবিধা (কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজ)-এর বিষয়ের গড়মিল বাঁধে। কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজ মডেলে বলা হয়, যদি একটি দেশ কোনো একটি বিশেষ সেক্টরে পারদর্শী বা নির্ভরশীল হয় তাহলে তা ঐ দেশের জন্য ভালো। এতে করে অন্যান্য দেশের তুলনায় ঐ সেক্টরের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে। তবে ডাচ ডিজিজের পুরো বিষয়টিই হলো একটি সেক্টরের উপর নির্ভর থাকার নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে। বিশেষ করে সেক্টরটি যদি প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক হয়। এসব সম্পদের রপ্তানিতে ব্যস্ত অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টর, যেমন- কৃষি এবং ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর অথবা বাকি সেক্টরগুলো উন্নত করার ক্ষেত্রে কারো মাথাব্যথা থাকে না৷
প্রতিরোধের উপায় কী?
রিয়াল এক্সচেঞ্জ রেটকে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে ডাচ ডিজিজও প্রতিরোধ করা সম্ভব। এখানে উদাহরণস্বরূপ চীনের কথা বলা যায়। চীন নিজের মুদ্রার রিয়াল এক্সচেঞ্জ রেট কম রাখার জন্য ইউএস বন্ড কেনে। আবার দেখা যায়, কোনো দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বেশি হলে আমদানিও বেশি হয় তথা বাজেট ঘাটতি দেখা যায়। এখন কোনো দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ঘাটতি বাজেট থেকে উদ্বৃত্ত বাজেটে আনা গেলে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না। এতে করে সরকারি বন্ড বা মুচলেকা ক্রয়ের তাগিদে দেশে বৈদেশিক মূলধনের প্রবাহও অতিরিক্ত বাড়তে পারবে না তথা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। যদি এই মূলধনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে এক্সচেঞ্জ রেট (রিয়াল টাইম)-ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এর ফলটাও হবে ইতিবাচক। আর তা হলো- ডাচ ডিজিজের ঝামেলা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
ডাচ ডিজিজের সময় দেখা যায় যে, হাতে প্রচুর টাকাকড়ি থাকলেও তা ঠিকমতো ব্যয় করা সম্ভব হয় না। অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি হলে যা হয় আর কি! এমন অবস্থা দমানোর জন্য তখন সরকারের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। যদি সরকার প্রাকৃতিক সম্পদভিত্তিক সেক্টর থেকে যে পরিমাণ আয় হয়, তার ওপর কর আরোপ করে তাহলে তা আয় নিয়ন্ত্রণ করার সাথে সাথে জনকল্যাণেও কাজে লাগবে। করের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ সরকার পাবে তা যদি জনসাধারণের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পরিবহণ ব্যবস্থায় কাজে লাগানো হয়, তবে তা সবার জন্যই কল্যাণকর হবে। তাছাড়া এই অর্থের কিছু অংশ অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর এবং বাকি সেক্টরগুলোতে ব্যবহৃত হলে সেসব সেক্টরও উন্নতি লাভ করতে পারবে, যা দীর্ঘমেয়াদে ঐ দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে। ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের প্রতিযোগিতার যোগ্যতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে কর থেকে প্রাপ্ত এই আয়।
ডাচ ডিজিজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সরকার সার্বভৌম সম্পদ তহবিলেরও ব্যবস্থা করতে পারে। এই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল থেকে যা আয় আসবে, তা খরচ করা হবে না, বরং ভবিষ্যতে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়ার জন্য জমিয়ে রাখা হবে। যেমন- নরওয়েতে ডাচ ডিজিজের ঝামেলা রুখতে সরকারি পেনশন তহবিল গঠন করা হয়।
আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন- বিলাস দ্রব্যের উপর উচ্চ কর আরোপ করা। এই পদক্ষেপ অর্থনীতি যেন বিলাস দ্রব্যের উপর অধিকতর নির্ভরশীল না হয় সেজন্য নেওয়া হয়। কারণ দীর্ঘমেয়াদে এসব দ্রব্যের উপর নির্ভরশীলতা ক্ষতিকর হতে পারে। অভিবাসনে আমজনতাকে অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে এই ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করা যাবে। এর ফলে বেকারদের বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচবে এবং পাশাপাশি সার্ভিস সেক্টরেও দেশটি উন্নতি লাভ করতে পারবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীলতা কিছুটা হলেও কমবে। আর মজুরি বৃদ্ধি (রিয়াল টাইম)-ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
ডাচ ডিজিজের প্রভাব আরো বেশি ক্ষতি সাধন করে, যখন সম্পদ কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জীভূত থাকে। কারণ এতে করে বিলাস দ্রব্য ও সেবার উপর খরচ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, টাকার অভাবে বাকিরা কিছু ক্রয় করতে পারে না। অর্থাৎ অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে ডাচ ডিজিজ প্রতিরোধ করার উপায় হলো এই বৈষম্য দূর করা।
This article is in Bangla language. It's about 'Dutch Disease'.
References have been hyperlinked in this article.
Featured image: profit.pakistantoday.com.pk