এই যে কর্মব্যস্ত জীবনে সময় বাঁচাতে ঘর থেকে বের হবার আগেই গাড়ি ঠিক করে নিতে পারেন উবার বা পাঠাও অ্যাপের মাধ্যমে, কিংবা রেস্টুরেন্টে না গিয়ে খাবার বাসায় এনে দেবার জন্য অর্ডার করতে পারেন; আবার, করোনাকালীন প্রচুর সময় অনেকের হাতে, তাই অনেকেই হয়তো শুরু করেছেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে আয় করা। এসবই গিগ ইকোনোমির অন্তর্ভুক্ত।
গিগ ইকোনমি কী?
ইন্টারনেট এবং অ্যাপের উপর নির্ভরশীল একটা মুক্ত এবং বিশ্বব্যাপী বাজার ব্যবস্থা। এটি আসলে একটি ডিজিটাল বাজারে শর্তসাপেক্ষ কাজ লেনদেন। এখানে কর্মসংস্থান সাময়িক। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্পমেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন কর্মীদের কাজে নিয়োগ করে। এক্ষেত্রে কর্মীরা যেমন স্বাধীনভাবে কাজ নিতে পারে, কোম্পানিগুলোও তাদের ইচ্ছামতো কর্মীদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজে নিয়োগ দেয় এবং কাজের মানের উপর পারিশ্রমিক প্রদান করে। সব কাজই অ্যাপভিত্তিক, তাই গিগ ইকোনোমিতে কর্মক্ষেত্রগুলো অনলাইন রেটিংসের উপর নির্ভরশীল এবং অ্যাপের মাধ্যমেই নিরাপদ পেমেন্ট সিস্টেম কার্যকর হয়। এটা অনেকাংশেই বদলে দিচ্ছে সমাজ, সংস্কৃতি এবং চাকরি বা ব্যবসার পরিবেশ।
কেন এমন নামকরণ?
যেহেতু কাজ একটা স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী হয়, তাই একে গিগ বলা হয়। গিগ মূলত ভাষাগত অপভ্রংশের অংশ। ঐতিহ্যগতভাবে শব্দটি সঙ্গীতশিল্পীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হতো, যখন কোনো সঙ্গীতদল কদাচিৎ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। খুব স্পষ্টভাবে জানা না গেলেও মনে করা হয়, এটাই গিগ ইকোনোমির নামকরণের কারণ।
মানুষ কেন ঝুঁকছে এই ব্যবস্থায়?
- স্বাধীনভাবে কাজের সুবিধা এবং সহজে পরিবর্তনশীল ও নমনীয় কর্মক্ষেত্র।
- স্বল্পমেয়াদী ও চাহিদা-সাপেক্ষ।
- ৯টা-৫টা চাকরিতে আবদ্ধ না থেকে ইচ্ছামতো সময়ে কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়া যায়।
- সংসার সামলিয়ে ঘরে বসে কাজ করার সুবিধা।
- ফ্রিল্যান্সাররা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে কাজের জন্য আবেদন করতে পারে নিজের দেশে অবস্থান করেই এবং নিয়োগকর্তা বিশ্বের যেকোন প্রান্ত থেকে কর্মী নিয়োগ দিতে পারে।
- যেকোনো দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে অ্যাপের মাধ্যমে।
- সময়ের কার্যকারিতা বাড়াতে মানুষ সরাসরি চাকরির চেয়ে সফটওয়্যার ভিত্তিক চাকরিতে পরিবর্তিত হচ্ছে।
- অফিসের স্থান এবং প্রশিক্ষণের জন্য কম বিনিয়োগ করে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পুঁজি সংরক্ষণ করতে পারছে।
- পারিশ্রমিক বেশি দিয়ে দক্ষ কর্মীদের সাথে চুক্তি করা সম্ভব হচ্ছে।
কিছু অপকারিতা, যেমন স্থায়ী চাকরীর অনিশ্চয়তা, সবেতন ছুটি, আবার নিয়োগকারীদের অনেকসময় কাজ ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিতে ঝামেলার সম্মুখীন হওয়া, এগুলোর পরও এ ব্যবস্থার চাহিদা বাড়ছে। ২০২০ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রায় ৪০ শতাংশ আমেরিকানরা স্বনির্ভর হওয়ার জন্য স্বাধীনভাবে কাজের এ ক্ষেত্র খুঁজে নিবে।
বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন পরিবেশ থেকে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে আসা মানুষ এই কর্মক্ষেত্রে সংযুক্ত হয়। কেউ এটাকে প্রাথমিক আয়ের মাধ্যম হিসেবে নেয়, কেউ শখের বশে কাজ করে। তবে দেখা গেছে, প্রয়োজনের তাগিদের চেয়ে পছন্দের খাতিরেই বেশিরভাগ মানুষ এখানে কাজ করে।
বিএমও ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট একটি গবেষণা করেছিল এ ধরনের কাজে মানুষের এত আগ্রহের কারণ জানতে, তথ্যানুযায়ী, বেশিরভাগ মানুষ, প্রায় ৬০ শতাংশ স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেয়, স্বাধীনভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার, ৪২ শতাংশ চায় নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে এবং গতানুগতিক ধারার পরিবর্তন আনতে, এবং প্রায় ১৫ শতাংশের মতে, চাকরি পরবর্তী অবসরে আয়ের উৎস থাকা প্রয়োজন। নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ ৪৮ শতাংশ এবং নারী ৩৬%।
আবার, বেশিরভাগ বুমাররা (যাদের জন্ম ১৯৪৬-১৯৬৪ এর মধ্যে) মনে করেন, অবসরপ্রাপ্ত হবার পর অতিরিক্ত আয়ের মাধ্যম হিসেবে কার্যকরী, যেখানে সময় বাঁধা-ধরা নয়। জেনারেশন-এক্স (যাদের জন্ম ১৯৬০-১৯৭০ এর মধ্যে), তাদের অনেকাংশের মত একই। তবে মিলেনিয়ালদের (১৯৮১-১৯৯৬ এর মধ্যে জন্মগ্রহণকারী) এ ধারণা কম, যদিও সবচে বেশি তারাই গিগ ইকোনমিতে কাজ করছে, তাদের সংখ্যা অধিক হবার কারণ তাদের ঘন ঘন কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন এবং নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মানসিকতা।
ম্যাকিনজি'র গবেষণায়, প্রায় ১৪ শতাংশ সরাসরি চাকরিজীবী স্বাধীনতার জন্য কাজ পরিবর্তন করতে চায় এবং অনেক বেকার যারা কাজ করতে ইচ্ছুক, বেশিরভাগ এখানে কাজ করে স্বাবলম্বী হতে চায়।
বিশ্ব অর্থনীতিতে গিগ ইকোনমি
বিশ্বের অনেক দেশেই গিগ ইকোনমি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করলেও সব দেশে প্রভাব সমান নয়। কিছু কিছু দেশ আবার খুব বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এর উপর। এর উপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, চীন, কানাডা, ইন্ডিয়া, ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, স্পেন, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, আস্ট্রিয়া এবং চেক রিপাবলিক উল্লেখযোগ্য।
আবার কিছু দেশ, যেমন- সাইপ্রাস, তুরস্ক, গ্রিস, জাপান, রোমানিয়া, লাটভিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া এবং স্লোভেনিয়া এই ক্ষেত্রটিকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করছে না। গিগ ইকোনমি পরিচালনার জন্য উন্নত প্রযুক্তিগত পরিবেশ দরকার এবং অনলাইনে অ্যাপভিত্তিক সেবা আদান-প্রদান হয়, তাই অনেক দেশ অনলাইনে ব্যবসা বাণিজ্য বিস্তৃত করতে চায় না, যেমন- ক্রোয়েশিয়া। কিন্তু অনেক দেশে উন্নত প্রযুক্তি সুলভ থাকলেও, যেমন জাপান, গিগ ইকোনমিকে অগ্রসর করতে চায় না কর্মীদের নিম্ন আয় এবং সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে।
আবার সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিগ ইকোনমির বৃদ্ধি বাধার সম্মুখীন হয়, কেননা সেখানে মোট কর্মীসংখ্যার ৮০ শতাংশ বহিরাগত শ্রমিক, যাদের কাজের জন্য অনুমোদন তথা ওয়ার্ক পারমিট লাগে। তাই উবারের প্রচলন থাকলেও সেটা বুকিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে এবং অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের (যেমন লিমুজিন বা ট্যাক্সি প্রতিষ্ঠান) সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকতে হয়, ব্যাক্তিগতভাবে পরিচালনা করা যায় না।
করোনা মহামারি এবং গিগ ইকোনমি
চলমান বিশ্ব মহামারিতে ফ্রিল্যান্সাররা অনেকভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন। কারো কাছে কাজের অপার সুযোগ বেড়েছে, আবার কেউ কেউ প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে সে প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করা মানুষজন কাজ এবং আয়ের উৎস হারিয়েছেন, যেমন ওয়েডিং ইন্ডাস্ট্রি ভেন্ডররা। অন্যদিকে ফুড ডেলিভারি ড্রাইভারদের কাজ বেড়েছে। করোনাকালে দু ধরনের প্রশ্ন উঠছে, স্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থান নিয়ে। ফুড ডেলিভারি কাজে নিয়োজিতরা আয়ের ব্যবস্থা টেকাতে পারলেও তারা করোনা সংক্রমণের অধিক ঝুঁকিতে আছে। সেখানে ওয়েডিং ফটোগ্রাফাররা ঘরে থাকায় এ ঝুঁকি কম, কিন্তু তাদেরকে কর্মসংস্থান ও আয়ের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
গিগ ইকোনমির ভবিষ্যৎ
চাহিদার খাতিরে ভবিষ্যতে গিগ ইকোনমির উত্তরোত্তর সম্প্রসারণ ঘটবে। কর্মসংস্থানকারী এবং কর্মী- এই দু'পক্ষের মাঝে সমতা এবং সততা পরিপূর্ণভাবে রক্ষিত থাকলে এটি আরো উন্নত এবং কার্যকরী হবে।
This is a Bengali article. This is about Gig Economy and the changing situation of economy and job procedure due to it.
References are hyperlinked inside the article.
Featured Image: Twitter