আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে যারা নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে 'অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা' শব্দযুগল বেশ পরিচিত। গত দশকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ কয়েকবার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার খবর শিরোনাম দখল করেছে। ইতিহাস বলছে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা একেবারে নতুন কোনো ধারণা নয়, গত দশকে মাত্র এই চর্চা শুরু হয়েছে- বিষয়টা এমনও নয়। কিন্তু গত এক দশক ধরে প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর পাওয়া আগের তুলনায় অনেক বেশি সহজ হয়ে গিয়েছে। এক ক্লিকেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি দুনিয়ার যাবতীয় খবরাখবর। 'গ্লোবাল ভিলেজ' নিয়ে বর্তমানে জোরেশোরে আলোচনা শুরু হয়েছে। 'গ্লোবাল ভিলেজ' তত্ত্বানুযায়ী আক্ষরিক অর্থেই বর্তমানে পৃথিবী একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। গ্রামের কোনো অংশে একটি ঘটনা ঘটলে যেমন পুরো গ্রামবাসী মুহূর্তেই জেনে যায়, তেমনই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কোনো ঘটনা ঘটলে মুহূর্তের মধ্যে আমরা জেনে যাচ্ছি।
image source: tradepractitioner.com
যা-ই হোক, 'অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা' বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি বিষয় হলেও আমাদের অনেকেরই এই বিষয় নিয়ে পরিষ্কার ধারণা নেই। একটি দেশ বা একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন যখন আরেকটি দেশ বা কোনো ব্যক্তি, কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের উপর 'অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা' প্রদান করে, তখন পরিষ্কার ধারণার অভাবে একজন পাঠকের বিভিন্ন ভাবনা আসতে পারে মাথায়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কাজ করে, এর প্রভাবে কী হয়, কেন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, কিংবা আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করতে পারে, সেটি নিয়ে জানার চেষ্টা করা যাক।
'ইকোনমিক স্যাংশন' (Economic Sanction) কিংবা এর বাংলা পরিভাষা 'অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা' পাঠের মাধ্যমে সহজেই বুঝতে পারা যায়, এর সাথে অর্থনীতির সম্পর্ক রয়েছে। বাস্তবে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে একটি হাতিয়ার (Tool), যার মাধ্যমে কোনো সরকার কিংবা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তার স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্য কোনো সরকার, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া কূটনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে একটি দেশের সাথে আরেক দেশের, তারও যবনিকাপাত ঘটে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে। যেমন: আমেরিকা উত্তর কোরিয়ার উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে বেশ কয়েকবার। এর ফলে উত্তর কোরিয়ার সাথে অন্যান্য দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। উত্তর কোরিয়া ও আমেরিকা– দুই দেশেরই কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কর্মসূচি কিংবা অন্যান্য মারণাস্ত্র তৈরির কর্মসূচি যাতে ব্যহত হয়, সেজন্য উত্তর কোরিয়ার উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল আমেরিকা। নিষেধাজ্ঞা প্রদানের কারণে উত্তর কোরিয়ার সাথে অন্যান্য দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদানের আড়ালে একটি বার্তা প্রদান করা হয়- "সংযত হও, নয়তো অর্থনৈতিকভাবে একঘরে করে ফেলা হবে"।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে পুরোমাত্রায় একটি পররাষ্ট্রনৈতিক পদক্ষেপ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো দেশ আন্তর্জাতিক আইন ক্রমাগত ভঙ্গ করে চলেছে, বাধা দেয়া যাচ্ছে না। সামরিকভাবে হয়তো বাধা প্রদান করলে অসংখ্য সামরিক-বেসামরিক মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটবে। তাই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদানের মাধ্যমে দেশটির আচরণ সংযত হওয়ার বার্তা পাঠানো হয়। সাধারণত যে দেশটির উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় দারুণভাবে। সেই দেশের সাথে অন্যান্য দেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে অস্বীকৃতি জানায়। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও যদি আচরণ সংযত না হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে সামরিক আক্রমণ চালানো হয়।
কোনো দেশের উপর যখন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তখন সেই দেশের অর্থনীতিতে সেটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যেমন ধরা যাক, ইথিওপিয়ার সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে অনেক পণ্য আমদানি করে। এখন, ইথিওপিয়ার উপর যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে দেশটি এই নিষেধাজ্ঞার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে পণ্য আমদানি করতে পারবে না। এতে হঠাৎ দেশটির আমদানি বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়বে, দেশটিতে পণ্যের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নিষেধাজ্ঞার কারণে যোগান না থাকলে সংকট তৈরি হবে। এতে সেদেশের চাহিদার কারণে সরকারের উপর চাপ বাড়বে।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিভিন্ন রূপে কার্যকর হতে পারে। যেমন, শুধু নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে অনেক সময় 'অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা' কার্যকর করা হয়। আফ্রিকার একটি দেশ, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যে, সেই দেশে অন্য কোনো দেশ অস্ত্র রপ্তানি করতে পারবে না। কারণ সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে চলমান সহিংসতায় রপ্তানিকৃত অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার, অনেক সময় আমদানিকৃত পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়, যেটি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের আরেকটি রূপ। ২০২০ সালে আমেরিকা ও চীন বেশ কয়েকবার নিজেদের আমদানিকৃত পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছিল। বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে পণ্যে দাম বেড়ে যায়, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টেকা কঠিন হয়ে পড়ে। তেহরান সংকটকে কেন্দ্র করে আমেরিকা যে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তার একটি রূপ ছিল সম্পদ জব্দকরণ। আমেরিকা তার দেশে ইরানি ব্যক্তিদের যত সম্পদ ছিল, সব জব্দ করেছিল। এছাড়া, ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আরেকটি রূপ।
এবার দেখা যাক বহুজাতিক সংগঠনগুলো কোন পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। জাতিসংঘ যদি কোনো দেশ বা সেই দেশের নির্দিষ্ট একজন/কয়েকজন ব্যক্তি অথবা সংগঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চায়, সেক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব নিরাপদ পরিষদে উত্থাপন করতে হবে। সেখানে পনেরো সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে অধিকাংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে যদি প্রস্তাব গৃহীত হয়, তাহলে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব কাউন্সিলে গৃহীত হতে হবে, অতঃপর সেটি কার্যকর হতে হবে। ইতোমধ্যে প্রায় ত্রিশবারের মতো নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব কার্যকর হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্সিলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ জারির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা যায়, আবার কংগ্রেসে নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব পাশের মধ্য দিয়েও নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে পারে।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে দ্বিমত আছে বিশেষজ্ঞদের মাঝে। অনেকে মনে করেন, সরাসরি যুদ্ধ বা সামরিক সংঘর্ষের পরিবর্তে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে যদি সংকটের সমাধান হয়, তাহলে বিষয়টি মোটেও খারাপ নয়। আবার অনেকে বলছেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক সময়ই সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়েছে। আমেরিকা ও চীন যখন পাল্টাপাল্টি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছিল, দুটি দেশেই আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল, যাতে দিনশেষে দুটি দেশের সাধারণ নাগরিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আবার, অনেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপকে 'ব্যর্থ' আখ্যায়িত করেছেন। উত্তর কোরিয়ার উদাহরণ দিয়ে তারা বলেছেন, আমেরিকা কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের এতসব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে উত্তর কোরিয়া ঠিকই তাদের পরমাণু কর্মসূচি অব্যহত রেখেছে, সফলভাবে হাইড্রোজেন বোমা ও নিত্যনতুন ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বিভিন্ন মত থাকলেও সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের পরিবর্তে যে এটি বেশ কার্যকর উপায়, এ নিয়ে দ্বিমত নেই কারও।
Language: Bangla
Topic: How economic saction works
Reference:
১) How Economic Sanctions Work - Investopedia