আগের পর্বে জ্বালানি তেলের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা, একটি দেশের অর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের গুরুত্ব, এবং গত পঞ্চাশ বছরে কীভাবে জ্বালানি তেলের দাম ওঠা-নামা করেছে, সেগুলো দেখানো হয়েছে। এই পর্বে দেখানো হবে কেন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে একটি দেশের অর্থনীতির উপর কী কী প্রভাব পড়তে পারে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেলের বাজারে একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, যখনই তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তেল উত্তোলনে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়, তখনই জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। ১৯৭৯ সালে যখন ইরানে ইসলামিক বিপ্লবের কারণে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ক্ষমতায় আসেন, তখন বিপ্লবের সময়ে ইরানের তেল উত্তোলন ব্যাহত হয়েছিল। ফলে আমরা দেখেছি, তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১২৫ ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সম্প্রতি স্বাধীন দেশ ইউক্রেনে যখন রাশিয়া সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে বসেছে, তখনও তেলের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ব্যারেলপ্রতি ১০৫ ডলারে, যেটি ২০১৪ সালের পর সর্বোচ্চ। কারণ, যুদ্ধাবস্থায় রাশিয়া আগের মতো তেল রপ্তানি নিশ্চিত করতে পারবে না, উত্তোলিত তেলের একটি বড় অংশ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও যদি জ্বালানি তেলের উত্তোলন ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিংবা ব্যাহত হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়।
image source: usip.org
সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য উত্তোলিত জ্বালানি তেলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্য যে আন্তর্জাতিক সংগঠন 'অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ' বা 'ওপেক' গঠন করা হয়েছিল, তারাও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ওঠানামায় বড় ভূমিকা রাখে। বলা হয়ে থাকে, এই সংগঠনের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অধীনে পৃথিবীর ৮০% তেলক্ষেত্র রয়েছে। যদি ওপেক চায় যে তারা তেলের উত্তোলন কমিয়ে দেবে, তাহলে অবশ্যই সেটির প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাজারে। অর্থনীতির সাধারণ নিয়মানুযায়ী, যখন বাজারে চাহিদার তুলনায় কোনো পণ্যের যোগান কমে যায়, তখন সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আবার চাহিদার বিপরীতে যখন যোগান বেশি হয়ে যায়, সেই পণ্যের দাম কমে যায়। ২০১৪ সালে ওপেক সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা ব্যারেলপ্রতি ১০০ ডলারের উপরে তেলের দাম রাখার জন্য চেষ্টা করবে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন চাহিদা কমে যাওয়ার পরও তারা একই উত্তোলন একই মাত্রায় অব্যাহত রেখেছিল, তখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে যায়।
পৃথিবীর সমস্ত দেশ বর্তমানে জাতীয় উন্নয়নের জন্য দ্রুত শিল্পায়নকে প্রাধান্য দেয়। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যত দেশ টেকসই উন্নয়ন লাভ করেছে, তার মূলে ছিল দ্রুত শিল্পায়ন। ইউরোপ এবং আমেরিকায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক আগে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ায় আমরা দেখতে পাই ইউরোপের দেশগুলো কিংবা আমেরিকা জাতীয়ভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি উন্নতি করতে পেরেছে। অপরদিকে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিল্পায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক দেরিতে, স্বাভাবিকভাবেই এই দেশগুলো অনেক দেরিতে উন্নত হতে শুরু করেছে। অনেক দেশ আবার উন্নয়নের কক্ষপথ থেকে সরে গিয়ে এখনও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে যখন জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল, তখনও এই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছে।
স্বল্প মেয়াদে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি শিল্পায়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পৃথিবীর প্রায় সব শিল্পকারখানা পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে জ্বালানি হিসেবে খনিজ তেল ব্যবহার করে। শুধু তা-ই নয়, জ্বালানি তেল থেকে বিভিন্ন উপাদান আলাদা করে সেগুলো রাসায়নিক দ্রবণে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবন আমরা যেসব পণ্য ব্যবহার করি, তার বড় অংশ প্লাস্টিকের তৈরি। এই প্লাস্টিক সরাসরি খনিজ তেল থেকে উৎপাদন করা হয়। শিল্পকারখানার উৎপাদিত পণ্য যখন বাজারজাত করা হয়, তখন সেগুলো পরিবহনের ক্ষেত্রে যে যানবাহনের সাহায্য নেয়া হয়, সেটি চলার জন্যও দরকার হয় জীবাশ্ম জ্বালানি, তথা খনিজ তেল। যেহেতু শিল্পকারখানার পণ্য উৎপাদন, পরিবহন কিংবা সেটি বাজারজাতকরণ– প্রায় সব ক্ষেত্রে জ্বালানি তেলের ব্যবহার অনিবার্য, তাই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে অবশ্যই উৎপাদিত শিল্পপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। আর অর্থনীতির নিয়মানুযায়ী, যখন জনগণের আয় না বেড়েও পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। জনগণের হাতে যে অর্থ থাকে, সেটির একটি বড় অংশ যখন পণ্যের পেছনে ব্যয় হয়ে যায়, তখন অন্যান্য খাতে ব্যয় করার মতো অর্থের পরিমাণ কমে আসে। বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক তৈরি করা হয় জ্বালানি তেল থেকে। মূল্য বৃদ্ধির ফলে এসবের মূল্যও বৃদ্ধি পায়, ফলে ফসল উৎপাদনের খরচও বেড়ে যায়।
এবার দীর্ঘমেয়াদের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা যাক। যদি দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়ে গিয়ে আর নেমে আসছে না, তাহলে জ্বালানি তেলের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল রাষ্ট্রগুলো বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধানে নেমে যাবে। ইতোমধ্যে এই সন্ধান শুরু হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ শক্তি কাজে লাগিয়ে অসংখ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হচ্ছে, যেটির মাত্রা সামনের দিনে আরও বৃদ্ধি পাবে। নেদারল্যান্ডসে গত শতাব্দী সত্তরের দশকের শুরুতে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ইওম কিপুর যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখন ডাচরা গণহারে সাইকেলের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করে। বর্তমানে দেশটিতে মোট যানচলাচলের ৫০ শতাংশ সাইকেলের মাধ্যমে হয়ে থাকে। ইউরোপে একটি কথা বলা হয়ে থাকে– নেদারল্যান্ডসে যতজন বাস করেন, তার চেয়ে বেশি সাইকেল রয়েছে দেশটিতে।
তবে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সব দেশের জন্য যে অভিশাপ হয়ে আসে, এমনটিও কিন্তু নয়। যেসব আন্তর্জাতিক কোম্পানি কিংবা দেশ জ্বালানি তেল রপ্তানির সাথে জড়িত, তাদের জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি আশীর্বাদস্বরূপ। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে তাদের মুনাফা বৃদ্ধি পায়, বাড়তি আয় থেকে তারা তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সম্প্রসারণ ঘটায়। ফলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়। প্রতিটি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানে ড্রিলিং ক্রু, ডিজেল মেকানিক, ট্রাক ড্রাইভারসহ অসংখ্য পেশার মানুষ কাজ করে। যখন একটি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সম্প্রসারণ ঘটায়, তখন দেখা যায় বিভিন্ন পেশায় আরও বেশি জনবল নিয়োগ দিতে হয়। এভাবে বেকারত্ব দূরীকরণে তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ভূমিকা পালন করে। আর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মানে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আরও বেশি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জমা হওয়া। এই বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনা যায়।
সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অপর্যাপ্ত যোগান ইত্যাদি বেশ কিছু কারণে জ্বালানি তেলে মূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। যখন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পায়, তখন জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য সেটি বেশ সমস্যা তৈরি করে, যদিও দীর্ঘমেয়াদে এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারা সম্ভব। আবার যেসব দেশ বা প্রতিষ্ঠান জ্বালানি তেল রপ্তানির সাথে জড়িত, তাদের জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি বাড়তি সুবিধা এনে দেয়। এছাড়াও জ্বালানির তেলের মূল্য বৃদ্ধির রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
Language: Bangla
Topic: Impact of oil price change in economy
Reference:
১) Why do oil prices matter to the global economy? An expert explains - WE Forum
২) What are the possible causes and consequences of higher oil prices on the overall economy? - FRBSF
৩) The Impact of Oil Price on the Economy - DW Energy Group
৪) The Impact of Higher Oil Prices on the Global Economy - IMF
৫) The Impact of Oil Price Increase on the Global Economy - Korea Energy Economics Institute