ধরুন বাজারে গিয়ে দেখলেন আপনার পছন্দের সবজিটা আগের দিনের তুলনায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আপনি বিক্রেতাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে বিক্রেতা সরাসরি বলে দিবে বাজারে সরবরাহ কম। তাই এর দাম আগের দিনের তুলনায় বেশি। আপনি তখন কি করবেন? অন্য কোনো সবজি কিনবেন? কিন্তু সেখানেও একই কাণ্ড। দাম বাড়তি। কারণও একই। তখন আপনার মনের অবস্থাটা কী হবে?
প্রায় সময়ই আমরা দেখে থাকি বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের চড়া দামের কারণে সাধারণ ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার করতেই হিমশিম খেয়ে যান সাধারণ মানুষ।
দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির জন্য মুদ্রাস্ফীতি দায়ী। আবার কিছু কিছুর জন্য দায়ী সিন্ডিকেট ও আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়লে তা দেশীয় বাজারে প্রভাব ফেলে। আবার দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমেও পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। ফলে যা হবার তাই হয়। বাজারে পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। একে অর্থনীতির ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি বলে।
মুদ্রাস্ফীতি হলো এমন এক অর্থনৈতিক অবস্থা যখন দ্রব্যের দাম বেড়ে যায় আর টাকার মূল্য বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এটি এমন এক সংকটের সৃষ্টি করে যার ফলে দেশের মানুষের হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও তারা প্রয়োজনীয় পণ্য বা দ্রব্যসামগ্রী কিনতে পারে না। কারণ সে দ্রব্যটির মূল্য হাতে থাকা অর্থের চেয়েও বেশি হয়ে যায়।
মুদ্রাস্ফীতিকে আপাতদৃষ্টিতে শত্রু মনে হলেও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এর অবদান রয়েছে। তবে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি দেশের সাধারণ জনগণের জন্য ভোগান্তি নিয়ে আসে। লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে সেজন্য দেশের বাজার ব্যবস্থার অর্থনীতিকে কঠোর নীতির আওতায় আনা জরুরি।
তবে মুদ্রাস্ফীতির সময় আমরা এমন কিছু পরিকল্পনা করে নিতে পারি যাতে আমাদের আর্থিক দিক থেকে কিছুটা লাভবান হতে পারি। এরূপ কিছু বিষয় নিয়েই আজকের এই লেখা। চলুন জেনে নিই কোন কোন বিষয়গুলোর দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা
মুদ্রাস্ফীতির সময় বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়া যায়। কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হলে, পরবর্তীতে সে বিনিয়োগ থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর মুনাফা বা লাভ পাওয়া যাবে। যেহেতু বাজারে মুদ্রাস্ফীতি চলমান, তাই বিনিয়োগের উপর অর্জিত মুনাফার পরিমাণও বেশি আসবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে বিনিয়োগ করার আগে অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে দেশের বাজারে কোন কোন খাতে মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে, শুধুমাত্র সেসব ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ করাই উত্তম।
সঞ্চয় না করা
মুদ্রাস্ফীতির সময় আপনি যদি ব্যাংকে টাকা জমা রাখেন তবে সেটা হবে ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ ব্যাংকের মুনাফার হার থাকে নির্দিষ্ট। আপনি যে টাকা আজ জমা রাখবেন তা একমাস পর ঐ পরিমাণ মূল্য থাকবে না। অর্থাৎ, আপনি ১০ হাজার টাকা জমা রাখলে তা মূল্য পরবর্তীতে গিয়ে কমে যাবে। ১০ হাজার টাকায় আজ যতটুকু কিনতে পারবেন, কাল হয়ত ততটুকু পাবেন না। আর যেহেতু মুনাফার হার নির্দিষ্ট, তাই আপনি একটি নির্দিষ্ট অর্থসহ মূল টাকা ফেরত পাবেন। কিন্তু দেখা যাবে মুনাফাসহ সে টাকার মূল্য অনেক কমে গেছে। কারণ ততদিনে বাজারে মুদ্রাস্ফীতির জন্য দ্রব্যমূল্য অনেকে বেড়ে গিয়েছে আর ঐ টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে গিয়েছে। তাই এই সময় ব্যাংকে টাকা জমা না রাখাই ভালো।
কিনুন, ভাড়া দিবেন না
বিশেষত আপনি যখন কোনো কিছু ভাড়া দেন যেমন: দোকান বা বাসা তখন আপনি ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট মূল্য ভাড়া হিসেবে গ্রহণ করেন। এটি সাধারণত মাসভিত্তিক হয়ে থাকে। কিন্তু বাজারে চলমান মুদ্রাস্ফীতির জন্য প্রতিমাসের সে অর্থ তার আসল মূল্যমান হারিয়ে ফেলবে। আজ থেকে একমাস পর আপনি যে ভাড়াটা পাবেন তার মূল্য আজকের মত থাকবে না বরং আরো কমে যাবে। তাই এই সময় নতুন করে ভাড়া না দিয়ে যত পারা যায় কেনার চেষ্টা করুন। কারণ আজকে আপনি যা কিনবেন একমাস বা এক বছর পর তার মূল্য আরো অধিক হয়ে যাবে। ফলে ঐ সময় আপনি চাইলে তা বিক্রি করে দিতে পারবেন।
ব্যাংক থেকে অর্থায়ন করুন
ব্যাংক থেকে যত পারুন টাকা নিন। আর সে টাকা বিনিয়োগ করুন লাভজনক খাতে। হতে পারে ব্যাংকে ওই সময় সুদের হার বেশি থাকতে পারে, কিন্তু আপনি যথাযথ পরিকল্পনা করেই বিনিয়োগ করবেন। বাজার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে কোন খাতে তুলনামূলক বেশি লাভবান হবেন, সেই খাতেই বিনিয়োগ করবেন।
পণ্য কেনার আগে ভাবুন
যদিও এই সময়টায় সব পণ্যদ্রব্যের দাম উর্ধ্বমুখী থাকে, তারপরও কম দামে যত পারা যায় তা কেনার চেষ্টা করতে হবে। যেহেতু নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার আর জিনিসপত্রের চাহিদা বাজারে বেশি থাকে তাই সেগুলোর দামও বেশি বাড়ে। আর তাই কেনার আগে দেখে নিতে পারেন তুলনামূলক কোন কোন দ্রব্যের দাম অন্যগুলোর চেয়ে কম। তাই বাজার ব্যবস্থা বিবেচনা করে ভেবেচিন্তে পণ্য কেনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
বাজেট করুন
যেকোনো কিছু শুরুর আগে পরিকল্পনা যেমন দরকার, ঠিক তেমনি বাজেটও জরুরি। এটা এমন হতে পারে; ধরুন, আগামী এক সপ্তাহ বা এক মাস আপনার পরিবারের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে রাখার পরিকল্পনা করতে পারেন। কারণ ওই এক সপ্তাহ বা এক মাসের মধ্যে বাজারে সে দ্রব্যের দাম আরো বাড়বে। তাই চলমান মুদ্রাস্ফীতিতে আপনার আয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রয়োজনীয় ব্যয়গুলোর একটি তালিকা করে রাখতে পারেন। এতে আপনার কিছুটা সাশ্রয়ও হবে।
স্টক বা স্বল্পমেয়াদে বন্ডে বিনিয়োগ
বর্তমান সময়ে স্টক বা বন্ডে বিনিয়োগের বিষয়টির সাথে অনেকেই পরিচিত। বিশেষ করে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের বিনিয়োগ করে সেখান থেকে মুনাফার কিছু অংশ পাওয়া যায়। কোম্পানির স্টক কিনলে মূলত সেটার একজন মালিক হওয়া যায়। যার ফলে আপনি সে কোম্পানির ক্রয়কৃত শেয়ারের অনুপাতে মুনাফার কিছু অংশ পাবেন। তবে এর জন্য আপনাকে শেয়ার বাজার সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। সাথে সাথে দেশের চলমান পরিস্থিতি অনুযায়ী কোন কোন কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো এবং শেয়ার বাজারে তা তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে সেটাও দেখতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান মুদ্রাস্ফীতির সময়েও ভালো অবস্থানে থাকবে চেষ্টা করতে হবে সেসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে বিনিয়োগ করার। তবে আপনাকে শেয়ারবাজারের প্রতিনিয়ত আপডেট বা হালনাগাদ জানতে হবে। আবার কিছু ঝুঁকিহীন স্বল্পমেয়াদে বন্ডে বা সরকারি ট্রেজারি বন্ডেও বিনিয়োগ করা যেতে পারে। তাই স্বল্পমেয়াদে বিনিয়োগের কারণে ঝুঁকির হার থাকবে কম, মুনাফাও পাওয়া যাবে। বাজার ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে স্টক বা বন্ডে বিনিয়োগ করা উচিত।
রিয়েল এস্টেট
যত পারবেন সম্পত্তি বিশেষ করে জমি কিনুন। মূলত আপনার কাছে প্রচুর অর্থ থাকলে সম্পত্তি যেমন জমি বা স্বর্ণ কিনে রাখতে পারেন। এসবের মূল্য বাড়তেই থাকে। যার ফলে পরবর্তীতে গিয়ে আপনি সেসব বিক্রি করেও আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন।
যত খরচ করতে পারুন তত খরচ করুন
যেহেতু বাজারে মুদ্রাস্ফীতি চলমান থাকবে, তাই প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হবে। বাজার ব্যবস্থা যতদিন নিয়ন্ত্রিত না হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের বেশি দামেই জিনিস কিনতে হবে। কিন্তু আপনার আয় সীমিত। তাই সে আয়ের বেশিরভাগ বা পারলে পুরোটাই খরচ করে ফেলুন। এজন্য এটাই উপযুক্ত হবে আপনি বেশি বেশি কিনুন আর ভোগ করুন। কারণ আজকে আপনার আয়ের অর্থমূল্য আগামীকাল কমে যাবে। তার অর্থ আজকে আপনার হাতে থাকা অর্থে যা কিনতে পারবেন তা দিয়ে আগামীকাল আরো কম জিনিস পাবেন। তাই বর্তমানের কথা বিবেচনা করে যত পারবেন খরচ করুন। তবে যথেচ্ছভাবে না করে কিছু পরিকল্পনা আর বাজার ব্যবস্থা বিবেচনা করে খরচ করুন।
মূলত লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে একটি দেশের সরকার চাইলেই এই অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এর ফলে বাজারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটলেও তা হবে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। একই সাথে দেশের অর্থনীতির পরিমাণও বৃদ্ধি ঘটবে।
This article is in Bangla. This is about what should we do during market inflation?.
Some necessary references are hyperlinked in the article also.
References:
1. Inflation is rising-what should consumers do? | Forbes
2. Handling money during inflation financial planners | Fortune
3. How to save your money during inflation? | Deseret News
4. If inflation is coming here is what to do about it | Wall Street Journal
5. Where to put your money during inflation surge? | CNBC
6. 14 expert tips for protecting your wealth with inflation on the rise | Forbes
7. Inflation will come: here are five ways to combat it | Forbes
Feature image source: searchenginejournal.com