Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মৃত্যু কেমন? মানুষ কেন মৃত্যুকে ভয় পায়?

একটি অতি সাধারণ প্রশ্ন হতে পারে এই যে, আপনি কোন জিনিসটিকে সবচেয়ে বেশি ভয় পান। সাপ, কুকুর, পুলিশ, ভূত, উত্তাল নদী, উচ্চতা ইত্যাদি নানারকম উত্তর আসতে পারে। তবে এসব উত্তরের মাঝে একটি উত্তর হয়তো আপনাকে ভাবিয়ে তুলতে পারে। আর সেটি হচ্ছে মৃত্যু! মৃত্যুই কী মানুষের সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা নয়? মানুষতো সাপকে এজন্যই ভয় করে যে সাপে কাটলে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হবে। কিংবা উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়ে মানুষ যদি ব্যাটম্যানের মতো ডানা মেলে ভেসে বেড়াতে পারতো এবং যথাযথভাবে মাটিতে নেমে আসতে পারতো, তাহলে কী উচ্চতার ভয় থাকতো?

পৃথিবীতে অনেক ধর্ম রয়েছে এবং সব ধর্মে মৃত্যু নিয়ে রয়েছে ভয়ভীতি; Image Source: religija.mk

কুল্লু নাফসিন যাইক্বাতুল মাউতসুরা আল ইমরান, আয়াত ১৮৫।

উপরে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে যার অর্থ, “প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।” তবে লেখার শুরুতে ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি এজন্য দেয়া হয়নি যে আলোচনাটি ধর্মতত্ত্বের আলোকে করা হয়েছে। বরং আয়াতটি ধর্মকে দর্শন থেকে আলাদা করতেই উল্লেখ করা হয়েছে। দর্শন হচ্ছে এমন একটি বিষয় যা কোনো কিছুই পরম বলে মানে না। সবকিছুকেই যুক্তি তর্কের ছাঁচে ফেলে বিচার করা হয়। দর্শন দ্বারা আপনি চাইলে মানুষকে অমরও প্রতীয়মান করতে পারেন! অথচ ধর্ম হচ্ছে পরম বিশ্বাসের ব্যাপার। তাই বলে রাখা ভালো, এই লেখাটিতে মৃত্যুকে দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা জানতে চেষ্টা করবো দার্শনিকগণ কী ভাবতেন মৃত্যুর বিষয়ে। এখানে ধর্মের খোঁজ না করাটাই যুক্তিযুক্ত হবে।

ধর্মকে দূরে রেখে মৃত্যুর আলোচনা করতে চাইলেও ধর্মের উদ্ধৃতির প্রয়োজন আছে। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ বিভিন্ন ধর্ম অনুসরণ করে আসছে এবং সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে আসছে। সেক্ষেত্রে মৃত্যুপরবর্তী জীবন মানুষের জন্য চিরকালই এক রহস্য এবং একই সাথে ভয়। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো যে মৃত্যুর পর মানুষের আত্মাকে একটি নিক্তিতে মাপা হবে। সেটিতে যদি পুণ্যের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে তাকে একটি অদেখা শান্তিময় জগতে প্রবেশ করতে দেয়া হবে।

কিন্তু পাপ বেশি হলে আত্মাটিকে একটি মস্ত রাক্ষস ‘চিবিয়ে চিবিয়ে’ খেয়ে ফেলবে! মিশরীয়দের এ বিশ্বাস মোটামুটি সকল প্রচলিত ধর্মের সারকথা। কিন্তু সমাজে একটি বড় শ্রেণীও রয়েছে যারা কিনা মৃত্যুপরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করেন না। তাদের ভাবনায় মৃত্যু কেমন? চলুন জানার চেষ্টা করি।

গ্রিকদের মৃত্যুদেবতা; Image Source: ebay.com

“মৃত্যুই সম্ভবত মানবজীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ!”- সক্রেটিস

সক্রেটিস এখানে সম্ভবত কথাটি কেবল এজন্যই ব্যবহার করেছেন যে মরে গেলে তিনি আদতে ফিরে এসে জানাতে পারবেন না কী হয়েছিল। তথাপি, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে মৃত্যুর চেয়ে বড়, সৃষ্টিকর্তার আর কোনো আশীর্বাদ নেই। সক্রেটিসের মৃত্যুর ইতিহাস আমাদের সবারই মোটামুটি জানা আছে। ধর্মবিরোধ, তরুণদের বিপথে চালিত করা এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কাজকর্মের জন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। অথচ তিনি সহজেই বেঁচে যেতে পারতেন নিজের দোষ স্বীকার করে নেয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সক্রেটিস এমন একজন মানুষ ছিলেন, যার যুক্তির কাছে মৃত্যুভয়ও হার মেনেছিল। তিনি নিজের নীতিতে অচল রইলেন, কারণ তার নিকট মৃত্য খুবই সহজ স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। মৃত্যুর সাথে ভয়ের সামান্যতম সম্পর্ক তিনি খুঁজে পাননি। কারণ, তিনি মনে করতেন মৃত্যুর পর দুটি ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

সম্ভাবনা-১: মৃত্যু একটি স্বপ্নহীন ঘুম। অর্থাৎ, মৃত্যু মানে চির নিদ্রায় শায়িত হওয়া, যে নিদ্রার কোনো শেষ নেই। সেক্ষেত্রে মৃত্যুকে ভয় পাবার আদৌ কোনো কারণ আছে কি?
সম্ভাবনা-২: মৃত্যু হচ্ছে অন্য পৃথিবীতে প্রবেশ করার টিকিট! হ্যাঁ, এক পৃথিবী থেকে অন্য এক পৃথিবীতে যাওয়া যাবে মৃত্যুর পর যেখানে দুঃখ, কষ্ট, জড়া, ক্লেশের মতো ব্যাপারগুলো থাকবে না। বরং সেখানে পূর্বে মৃত্যুবরণ করা মানুষদের সাথে দেখা হবে যা তার নিকট নিছক আনন্দের ব্যাপার। এক্ষেত্রেও মৃত্যুকে ভয় পাবার মতো কোনো উপরকরণ খুঁজে পাননি সক্রেটিস।

নিজেকে জানো, নিজের আত্মাকে চেনো, নশ্বর দেহের এ অংশটিই চিরকাল তোমার রবে!সক্রেটিস

মৃত্যুর পূর্বমূহুর্তেও শান্ত ছিলেন সক্রেটিস; Image Source: pinterest.com

মৃত্যু সম্বন্ধে নিজের দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির ব্যাখ্যায় এ উক্তিটি করেছিলেন সক্রেটিস। তার মতে, মৃত্যুপরবর্তী কোনো জীবন যদি থেকে থাকে, তাহলে সেখানে মানুষের কোনো শরীর থাকবে না, থাকবে কেবল আত্মা। সেটি হবে সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ গ্রিক পুরাণের কাল্পনিক হেডিস শহরের মতো। তাই আত্মা বিশুদ্ধ থাকলে সেখানে নিজেকে অন্যদের চেয়ে ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে! আর এই ধারণা থেকে সক্রেটিস মনে করতেন, মৃত্যু মানুষের জন্য আশীর্বাদ বটে। পৃথিবীতে যতদিন মানুষ বেঁচে থাকে, ততদিনই তাকে ক্ষুধা, রোগ, অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হয়। কিন্তু মৃত্যুপরবর্তী জীবনে শরীর না থাকায় এসব ভাবনা নেই। তখন নিশ্চিন্তে জ্ঞানার্জন করা যাবে, যা ইচ্ছে তা-ই করা যাবে! কী মজা তাই না? এরকম হলে মৃত্যুকে আশীর্বাদ না বলে উপায় আছে?

মৃত্যু হচ্ছে সংবেদনশীলতার বিরাম! – এপিকিউরাস

সক্রেটিস থেকে এবার এপিকিউরাসের দিকে যাওয়া যাক। তিনি সক্রেটিসের মৃত্যুপরবর্তী জীবনের সম্ভাবনাটিকেও নাকচ করে দেন। তার কাছে মানুষ মানে কেবলই একটি নশ্বর দেহ যার সাথে দু’টি জিনিস সম্ভব, একটি জীবন অপরটি মৃত্যু। মৃত্যুকে তিনি ভালো বা মন্দ, কোনোটিই বলতে নারাজ। কারণ, ইপিকিউরাস বিশ্বাস করতেন, পুরো পৃথিবীতে ভালো এবং মন্দ, এ দু’টি বিষয় আছে কেবল। আর এ দুটি বিষয় পুরোটাই মানুষের সংবেদনশীলতার উপর নির্ভর করে। মানুষ যেহেতু মৃত্যুর পর কিছুই অনুভব করতে পারবে না, তাই মৃত্যুর কোনো সংবেদনশীলতা নেই এবং মৃত্যু ভালো-মন্দের উর্ধ্বে।

এপিকিউরাস; Image Source: thephilosophersmail.com

মৃত্যুকে ভয় পাওয়াটাকে ইপিকিউরাস নিছক মূর্খতা বলেই মনে করেন। কারণ, মানুষ যতদিন জীবিত থাকে, ততদিন সংবেদনশীল থাকে। আর এসময়টা নিজের চেতনা ও অনুভব শক্তি দিয়ে যতটা পারা যায় জীবন উপভোগ করতে হবে। মৃত্যু নিয়ে ভাবারই কোনো দরকার নেই। মৃত্যু তো কেবল সংবেদনশীলতার সমাপ্তি, তাতে ভয়ের কী আছে? যেকোনো পরিস্থিতিতেই মৃত্যু হোক না কেন, তা হবে অত্যন্ত সহজ।

প্রশ্ন হতে পারে, আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে কিংবা এরূপ কোনো দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে সেটি সহজ হবে কী করে? এর উত্তর পেতে হলে ইপিকিউরাস সূত্রের শরণাপন্ন হতে হবে। সূত্রটি এরকম,

মানুষ এবং মৃত্যু একই সময় উপস্থিত থাকতে পারে না।

অর্থাৎ, যতক্ষণ মানুষ বেঁচে থাকে, ততক্ষণ মৃত্যু অনুপস্থিত। কিন্তু মৃত্যু উপস্থিত হতেই মানুষ আর সংবেদনশীল থাকে না। তার মানে, আগুনে পুড়ে যান আর পানিতে ডুবে যান, আপনার গন্তব্য তো হচ্ছে মৃত্যু। আর মৃত্যু মানে আপনি আর নেই। আর আপনি না থাকলে ব্যথাও নেই। এ সহজ ব্যাপারটিকে অত ভয় পাবার কী আছে?

২০ শতকের আধুনিক দার্শনিকদের কাছেও মৃত্যু ভয় পাবার মতো কোনো বিষয় নয়। মার্কিন দার্শনিক থমাস নেগেল তো মানুষের মৃত্যুকে ভয় পাবার এক অভিনব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মতে, মানুষ মৃত্যুপরবর্তী কী হবে সেজন্য মৃত্যুকে ভয় পায় না, বরং হঠাৎ মরে গেলে অনেক কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, সে জন্য ভয় পায়। যেমন, একজন প্রৌঢ় বাবা তার মেয়েদের বিয়ে নিয়ে চিন্তিত থাকেন। তিনি সর্বদাই ভাবতে থাকেন যে, মেয়েদের বিয়েটা করিয়ে দিতে পারলেই আর ভয় নেই। একজন বিজ্ঞানী তার গবেষণা কাজের মাঝপথে কখনোই ধরণী ছেড়ে ওপারে চলে যেতে চাইবেন না। সুতরাং এই প্রৌঢ় বাবা এবং বিজ্ঞানী, উভয়েই মৃত্যুকে সমীহ করছেন না বরং নিজেদের অসমাপ্ত কাজ নিয়েই অধিক চিন্তিত।

থমাস নেগেল; Image Source: humanos16.blogspot.com

নেগেল এই চিন্তাটাকেও অমূলক বলেছেন। তার মতে, মানুষ জন্ম নেয়ার পূর্বেও তো কত কিছু ঘটে গেছে। সেগুলো নিয়ে না ভাবলে কেন মৃত্যুর পর অসমাপ্ত কাজ নিয়ে ভাবতে হবে? রোমান সাম্রাজ্যের পতন, ফরাসী বিপ্লব কিংবা হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ যেমন আমাদের জন্মের জন্য অপেক্ষা করেনি, তেমনি আমাদের মৃত্যুতেও কোনো কাজ আটকে থাকবে না। কেউ না কেউ সেটি সমাপ্ত করবেই। তাই মৃত্যু নিয়ে অহেতুক উদ্বিগ্ন না হবারই পরামর্শ দিয়েছেন নেগেল। তবে এই পরামর্শের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সমালোচকরা। নিজের মৃত্যু নিয়ে না হয় ভয় না পেলাম, নিজের পরিবার পরিজন আর ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভয় পাওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?

এবারও নেগেলের উত্তর ‘না’। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যু নিয়ে ভীত হওয়া তার মৃত্যুকে পরোয়া করা নির্দেশ করে না। বরং মানুষ প্রিয়জনের মৃত্যুর ব্যাপারে এজন্য ভীত থাকে যে, তার মৃত্যুর পর সে একা হয়ে যাবে, সে তার সঙ্গী/গুরু/শিষ্য হারাবে। এ কারণেই কারো মৃত্যুর শোক চিরস্থায়ী হয় না। কেননা মৃত্যুর কিছুকাল পর তার অভাব পূরণে নতুন কারো আবির্ভাব ঘটে। ফলে যারা ইতোপূর্বে তার মৃত্যু নিয়ে কাতর ছিল, শূন্যস্থান পূরণ হতেই তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়!

জালালউদ্দীন রুমি; Image Source: virtualvoice.org

দর্শনের জগতে মৃত্যুভয় বলতে কিছুর অস্তিত্ব নেই, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। এ ব্যাপারটা প্রতিফলিত হয়েছে সুফি দর্শনেও। বিখ্যাত সুফি দার্শনিক এবং কবি জালালউদ্দীন রুমি তো মৃত্যুকে রীতিমতো আনন্দের উপলক্ষ বলে অভিহিত করেছেন। তার জন্য, “মৃত্যু হচ্ছে অনন্তের সাথে বিবাহ!” পৃথিবীতে কাটানো সময়টা কেবলই চোখের একটি পলকের ব্যাপার। প্রকৃত জীবন তো শুরু হয় মৃত্যুর পরেই। এজন্য জীবনকে আবার অর্থহীন ভাবার কোনো কারণ নেই। জীবন যত ছোটই হোক, অনন্তের পথে যাত্রার পূর্বে আত্মিক পরিশুদ্ধিতা অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ। রুমির নিচের উক্তিটিতে সে কথাই প্রতিফলিত হয়েছে।

পৃথিবী হচ্ছে খেলার মাঠ, মৃত্যু হচ্ছে রাত্রি!

ফিচার ছবি: Kb4images.com

Related Articles