নতুন হোস্টেল ভবনের কোল ঘেঁষে ছড়িয়ে পড়া সূর্যের আলোয় শুরু হয় জিলা স্কুলের কার্যক্রম। ভোরের আবছা আলোয় মিশে থাকা কুয়াশার আবরণ বাড়িয়ে তোলে স্কুলের সবুজ আঙিনার সৌন্দর্য বহুগুণে। সুবিশাল মাঠের সবুজ ঘাস ভিজে সতেজতার প্রমাণ দেয়। মাঠের দু'প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী দুটি বটগাছ এভাবেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। নোয়াখালী জিলা স্কুলের অস্তিত্বের সাথে শতবর্ষী দুই বটগাছের জীবনের রয়েছে এক দারুণ মিতালী। বছরের পর বছর হাজার হাজার ছাত্র এসএসসি পাশ করে স্কুলকে বিদায় জানালেও এই দুটি বটগাছ জানায়নি। পরম মমতায় জিলা স্কুলকে আগলে গেছে শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও।
নোয়াখালী জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠায় আয়ারল্যান্ডের ইংরেজ কর্মকর্তা মি. জোনসের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল। ১৮৫০ সালে ইংরেজ সরকার ভারতীয় উপমহাদেশে ১৭টি জেলায় ১টি করে জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। তার মধ্যে বাংলাদেশের জিলা স্কুল ছিলো ১৪টি, পশ্চিমবঙ্গের জিলা স্কুল ছিলো ৩টি। তন্মধ্যে বাংলাদেশের একটি জিলা স্কুল নোয়াখালী জিলা স্কুল।
এই স্কুলের ইতিহাস ধ্বংসাবশেষ থেকে বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস। ১৯২০ সালে স্কুল নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়, ফলে ১৯২১ সালে মহব্বতপুর গ্রামের পূর্ব প্রান্তে মন্তিয়ার ঘোনায় স্থানান্তরিত হয় স্কুল। বিদ্যালয়টি আবারও নদী ভাঙ্গনের শিকার হলে ১৯২৩ সালের ১ জানুয়ারি আর. কে. জুবিলী বিদ্যালয়ে একে স্থানান্তর করা হয় ও স্কুলের নামকরণ করা হয় আর. কে. জিলা স্কুল। ১৯৩১ সালে স্কুলটি আবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে, ফলে বিদ্যালয়কে আহম্মদিয়া মাদ্রাসায় স্থানান্তর করা হয়। সেখানে এর প্রাতঃশাখা চালু হয়।
বিদ্যালয়টি আবারও নদী ভাঙ্গনে পড়লে বঙ্গ বিদ্যালয়ে ও ১৯৪৮ সালে তা বঙ্গবিদ্যালয় থেকে কারামতিয়া মাদ্রাসায় আনা হয়। ১৯৫৩ সালে কারামতিয়া মাদ্রাসা থেকে এটি বর্তমান মাইজদী সদরে প্রধান সড়কের পাশে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৮ ও ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়, পরে একে পুনঃনির্মাণ করা হয়। বারবার প্রতিকূলতার শিকার হয়েও থেমে যায়নি জিলা স্কুলের অগ্রযাত্রা। প্রতিবার ধ্বংসাবশেষ থেকে জন্ম নিয়ে লিখেছে নতুন ইতিহাস। ১৭০ বছর ধরে অব্যাহত রেখেছে নিজের যাত্রা গৌরবের সাথে।
ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশের অপরূপ এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে মাত্র ৭.৩৮ একরের উপর প্রতিষ্ঠিত নোয়াখালী জিলা স্কুল। স্কুলের অডিটোরিয়াম থেকে শিক্ষক মিলনায়তন পর্যন্ত দীর্ঘ গাছগুলো ছায়া হয়ে সঙ্গী হয় পথের, শিক্ষক মিলনায়তনের কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা কৃষ্ণচূড়া গাছ লাল হয়ে বৃদ্ধি করে শহীদ মিনারের সৌন্দর্য, ক্লাসরুমের পেছনের সুবিশাল পুকুর, প্রধান শিক্ষকের পরিত্যক্ত বাসভবনের ইতিহাস, সাইকেল স্ট্যান্ডের পাশের বট গাছটার নিচে নববর্ষ উদযাপন এবং পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলা জামে মসজিদ বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে জিলা স্কুলের গুরুত্ব।
ছাত্র-শিক্ষকদের অসাধারণ মেলবন্ধনে অপ্রতিরোধ্য গতিতে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে স্কুলটি। শ্রেণীর পাঠ্য কার্যক্রমে শিক্ষকদের ভূমিকা অসাধারণ। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেন ছাত্রদের মাঝ থেকে সেরা ফলাফল বের করে নিতে। তাই শিক্ষকদের দিক-নির্দেশনা বরাবরের মতোই প্রশংসনীয়। পাশাপাশি ছাত্রদের সমর্থন জিলা স্কুলের এত বছরের পথচলায় সফলতার মূলমন্ত্র, যার ফলস্বরূপ বিগত কয়েক দশকে সকল পরীক্ষায় পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে নোয়াখালী জেলায় শীর্ষে অবস্থান করে আসছে নোয়াখালী জিলা স্কুল। এভাবেই দিনপঞ্জিকার পাতা বদলে সময় যত পেরিয়েছে, স্কুলটি ততই সমৃদ্ধ হয়েছে।
সহশিক্ষা কার্যক্রমে নোয়াখালী জেলায় সবার চেয়ে এগিয়ে নোয়াখালী জিলা স্কুল, যা অন্যান্য স্কুলের জন্য ঈর্ষণীয়। দিবা ও প্রাতঃ- দুই শাখার ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্বে পিটি তথা শরীরচর্চা কার্যক্রমে ছাত্রদের পাশাপাশি সকল শিক্ষক অংশ নিয়ে একসাথে জাতীয় সঙ্গীতে কণ্ঠ মেলান। বিএনসিসি, স্কাউটিং, রেড ক্রিসেন্ট ফাংশন, ক্রীড়া (ক্রিকেট , ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ), বিতর্ক, স্কুল মডেল ইউনাইটেড নেশনস, বিজ্ঞান মেলা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কর্মসূচি, শিক্ষা সফর নিয়মিত হয়ে থাকে। ক্রীড়া, স্কাউটিং, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট এবং বিতর্কে জেলা ছাড়িয়ে বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে আসছে জিলা স্কুলের ছাত্ররা। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় জিলা স্কুলের বিশাল মাঠ অলিম্পিকের মাঠের ন্যায় রূপ ধারণ করে। অলিম্পিকের মতো এখানেও মশাল হাতে একজন শিক্ষার্থীকে মাঠ প্রদক্ষিণ করানো হয়।
জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষ করে দেশকে সেবা করার মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলে। এ স্কুলের উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক, প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা, সাবেক সচিব প্রয়াত সা'দত হোসেন, সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত এএইচ মোফাজ্জল করিম, প্রয়াত শহীদউদ্দীন এস্কান্দার কচি (খেলোয়াড় ও রাজনীতিবিদ), মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ মেজর (অবঃ) আব্দুল মান্নান যিনি তিন মেয়াদে ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত এবং বঙ্গে এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমদ, প্রকৌশলী ফজলুর করিম, প্রয়াত আব্দুর রশিদ (এম.পি), এমাদ উদ্দীন, জামাল উদ্দীন, কর্নেল (অব:) সালাউদ্দীন, ডা. বাহার, প্রফেসর গাজী আহসানুল কবির এবং ওয়েডিং ডায়েরির স্বত্ত্বাধিকারী প্রীত রেজাসহ আরও অনেকে।
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা যুদ্ধ অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। জিলা স্কুলও জড়িত রয়েছে সে ইতিহাসের আষ্টেপৃষ্ঠে। পৃথিবীর মানচিত্রে 'স্বাধীন বাংলাদেশ' নামটি স্থান পাওয়ার ক্ষেত্রে অবদান কম ছিল না জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের। তৎকালীন জিলা স্কুলের অসংখ্য শিক্ষার্থী অংশ নেয় স্বাধীনতা যুদ্ধে। তাদেরই কয়েকজন ড. শাহাদাত হোসেন সিএসপি, মিজানুর রহমান, মাহমুদুর রহমান বেলায়েত (বিএলএফ কমান্ডার), এ.কে আযাদ (আযাদ কমিশনার), একরামুল হক। অহিদুর রহমান, জসিম উদ্দীন, ক্যাশ সরকার, বিশ্বেশ্বর দে সহ কয়েকজন শাহাদাত বরণ করেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের তালিকায় রয়েছে জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের নামও।
চলতি বছরের শুরুতে স্কুলের ১৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে, নোয়াখালী জিলা স্কুল প্রাক্তন ছাত্র ফোরাম কর্তৃক আয়োজিত প্রাক্তন ছাত্র মিলনমেলা ২০২০ অনুষ্ঠিত হয় স্কুলপ্রাঙ্গণে। ১৯৪৯-২০১৯ ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ ছাত্র সেই মিলনমেলায় যোগ দেয়। ওয়ারফেজ ও এস আই টুটুল অংশ নেন সন্ধ্যা পরবর্তী কনসার্টে। বর্তমানে স্কুলে ১৪৬৭ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে। ৭.৩৮ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন নুর উদ্দীন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। এছাড়াও সর্বমোট ৪১ জন শিক্ষক বর্তমানে কর্মরত আছেন।
জিলা স্কুলের বন্ধুত্বগুলো বেশ মজবুত হয়। সঠিক বন্ধনটা ছাত্ররা থেকেই শেখে। আর এই বন্ধনগুলো মজবুত হয় স্কুল মাঠ, শহীদ মিনার, ভূতের বাড়ি, সাইকেল স্ট্যান্ড, অডিটোরিয়াম, পুরাতন হোস্টেল, পার্শ্ববর্তী বড় মসজিদের অজুখানা আর সার্কিট হাউজ এলাকায় আড্ডা দিয়ে। স্কুলের সময়টা অনেক দীর্ঘ হলেও শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেগুলো অনেক ক্ষুদ্র মনে হয়।
দেশের সংকটাপন্ন অবস্থায় সবসময় এগিয়ে এসেছে জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী ও কর্তৃপক্ষ। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নোয়াখালীতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলো জিলা স্কুলের ছাত্ররা। চলমান করোনাভাইরাস আতঙ্কে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে নোয়াখালী জিলা স্কুলের মাঠ ব্যবহৃত হচ্ছে অস্থায়ী কাঁচাবাজার হিসেবে। সকল পরিস্থিতিতে এভাবেই যুগ যুগ ধরে বুক পেতে দেয় নোয়াখালী জিলা স্কুল।
This is a Bangla article. This is about Noakhali Zilla School, a very renowned education institution of Noakhali.
References:
1. School Magazine 'Mukul'; Publication Year: 2018-19
3. নোয়াখালী জিলা স্কুল প্রাক্তন ছাত্র ফোরাম
Featured Image Credit: Rifat Ahmed