Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত চীন ভ্রমণ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার জীবদ্দশায় বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন। সেখানে তিনি বক্তৃতা করেছেন, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করেছেন। আবার ফিরে এসে লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনীও। তবে সব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যে একই রকম হবে তা-ও নয়। সেরকমেরই একটি ব্যতিক্রমী ভ্রমণ ছিল চীনে।

রবীন্দ্রনাথ ও চীন

মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৮৮১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তরুণ বয়সে ‘চীনে মরণের ব্যবসা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি চীনের জনগণের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং চীনে ব্রিটিশদের এই আফিমের ব্যবসাকে ডাকাতি বলে উল্লেখ করেন। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু পাঠপূর্বক এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, রবীন্দ্রনাথ তরুণ অবস্থাতেই চীন সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত এবং সচেতন ছিলেন। সময়ের সকল খোঁজ খবরই রাখতেন এবং প্রয়োজনে তা নিয়ে কথা বলতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন কবিগুরু।

১৯১৩ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন রবীন্দ্রনাথ। তার তিন বছর পর ১৯১৬ সালে জাপান ভ্রমণ করেন এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ভারত থেকে সমুদ্রপথে জাপান যাবার সময় হংকংয়ে যাত্রা বিরতি হয়। প্রসঙ্গ জাপান নয়, চীন। সেখানে কিছু চীনা শ্রমিকের দেখা পান রবীন্দ্রনাথ। চীনা শ্রমিকের কাজ করার শৃঙ্খলা ও উদ্যম দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। মেদহীন, নিরলসভাবে এভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এ সম্পর্কে তিনি  লিখেছিলেন,

“কাজের শক্তি, কাজের নৈপুণ্য এবং কাজের আনন্দকে এমন পুঞ্জীভূতভাবে দেখতে পেয়ে আমি মনে মনে বুঝতে পারলুম, এই বৃহৎ জাতির মধ্যে কতখানি ক্ষমতা সমস্ত দেশজুড়ে সঞ্চিত হচ্ছে। চীনের এই শক্তি আছে বলেই আমেরিকা চীনকে ভয় করছে, কাজের উদ্যমে চীনকে সে জিততে পারে না, গায়ের জোরে তাকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়”।

১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ; ছবি: গেটি ইমেজেস

চীনের এই ভেতর সঞ্চিত অসীম এই সম্ভাবনাকে অনুধাবন করতে পেরে সে সময়েই চীন আগাম ধারণা করতে পেরেছিলেন কবিগুরু; যা পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ১৯১৬-তে বসেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,

“এই এত বড়ো একটা শক্তি যখন আধুনিক কালের বাহনকে পাবে, অর্থাৎ যখন বিজ্ঞান তার আয়ত্ত হবে, তখন পৃথিবীতে তাকে বাধা দিতে পারে এমন কোন শক্তি আছে? তখন তার কর্মের প্রতিভার সঙ্গে তার উপকরণের যোগ সাধন হবে”।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে চীনের ধারণা

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও চীনাদের ধারণা ছিল উচ্চমার্গীয়, থাকাটাই স্বাভাবিক।  সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করার পর তার নাম সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। চীন যেহেতু বিশ্বের বাইরে নয়, তাই তার নামখানা চীনেও পৌঁছেছে সগৌরবেই। চীনারা, বিশেষ করে চীনা তরুণেরা, তার সম্পর্কে ছিল ব্যাপক আগ্রহী। রবীন্দ্রনাথের যেকোনো লেখা হাতে এলেই তারা সেটা গোগ্রাসে গিলতে থাকে। তবে ঝামেলাটা হয় ভাষা-গত। বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ বাংলায় সাহিত্য রচনা করতেন তারপর সেটা অনুবাদ হতো ইংরেজিতে। ইংরেজিতে অনুবাদ হলে সেই ইংরেজি থেকে সেটা অনুবাদ হতো চীনা ভাষায়। অর্থাৎ তারা সব সময় মূল অনুবাদটা পেতেন না, তারা পেতেন অনুবাদের অনুবাদ। এতে করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো না কিংবা হয়নি এমন নয়। অনেকক্ষেত্রেই অনেকে ভুল বুঝেছেন, অনেকে আবার ঠিকটা খুঁজে নিয়েছেন। কেউ কেউ আবার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে সন্তুষ্ট হবার চেষ্টা করেছেন।

চীন দেশে রবীন্দ্রনাথ; ছবি: বিবিসি

কবি সাহিত্যিক প্রত্যেকেই প্রথমে দার্শনিক। প্রত্যেকের লেখার মধ্যে তার স্বীয় দর্শনের ছাপ বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও তার মতামতের প্রতিফলন ঘটবে এমনটা ভাবা অমূলক নয়। তা সর্বক্ষেত্রেই যে সকলের ভাল লাগবে সেটাও অবান্তর। চীনের সকলের কাছেও যে রবীন্দ্রনাথ পূজনীয় ছিলেন এমনটিও নয়। তবে একথা সত্য, চীনের বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যে তার বেশ জনপ্রিয়তা ছিল বলেই মনে হয়। নইলে কেনই বা তাকে চীনের বক্তব্য প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে?

রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণ

২০২১ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষে পা রাখবে। ঠিক শতবর্ষ আগে চীনের অবস্থা এখনকার মতো উন্নত এবং সভ্য ছিল না। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে চীন কেবল আফিঙয়ের নেশা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। চীন বুঝতে শুরু করেছে পশ্চিমা দাসত্ব কখনো মুক্তি দেবে না। তাই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে হবে নিজেদেরকেই।

তৎকালীন চীনা তরুণেরা জ্ঞানের অনুসন্ধান এবং চর্চা করতে শুরু করেছে। সমন্বয় স্থাপন করেছে জ্ঞানস্পৃহা ও জ্ঞানচর্চার মধ্যে। ভাববাদের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে তারা তখন বস্তুবাদের ওপর ভর করে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর, কেননা তারা দেশের মানুষের বঞ্চনার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। এবং সে বঞ্চনা দূর করার দায়িত্ব তরুণদেরই। তারা পড়তে শুরু করেছে, লিখছে, যেকোনো বক্তব্য পেলে চলছে সে বক্তব্যের অতি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চলছে যাচাই এবং পরিশেষে গ্রহণ অথবা সরাসরি বর্জন। তরুণেরা ১৯২১ সালে গড়ে তুলেছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। চারিদিকে তখন প্রবল উত্তেজনা; প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে চলছে বিপ্লবের প্রস্তুতি।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির লোগো; Source: dr-znai.com

এমনই এক বিপ্লবের প্রস্তুতিকালে চীন ভ্রমণ করেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৪ সালের ১২ই এপ্রিল। ৪৯ দিনের এই ভ্রমণের প্রথম সপ্তাহের এক বক্তৃতার সারমর্ম ছিল, “ভাববাদকে ফিরিয়ে আনতে হবে, সে কারণে ধ্বংস করতে হবে বস্তুবাদকে’। এ কথা চীনের তরুণদের অজানা ছিলনা যে, কবি মাত্রই অবশ্যই একজন দার্শনিক। তাই তার বক্তব্যের পেছনে কোন দর্শন নেই এমনটা ভাববার কোন অবকাশই ছিল না। শুরুতেই এমন বক্তব্য দেবার পর স্বাভাবিকভাবেই অনেকের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

চীন ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথকে বেশ নাকাল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই যেতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত বাংলা ভাষার কবি, কিন্তু ভাষা-গত বিশাল পার্থক্যের কারণে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ তেমন হয়ে ওঠেনি। সমগ্র ভ্রমণে তিনি একবারের বেশি সাহিত্য নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাননি, তাই বার বার ফিরে যেতে হয়েছে মতাদর্শে।  রবীন্দ্রনাথ শুধু যে ভাববাদের পক্ষে বলেছেন তা নয়, অনেক বক্তব্যে ভাববাদের বিরোধিতা করেছেন বটে, তবে একইসাথে বস্তুবাদেরও বিরোধিতা করেছেন।

উপস্থিত তরুণদের মধ্যে সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন তরুণ মাও সে তুং। তারা তখন উঠতি বিপ্লবী। শ্রেণিসংগ্রামের প্রতি প্রবল বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথ সেই বিশ্বাস ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। তরুণ বিপ্লবীরা আশঙ্কা করেছিলেন, এটা আয়োজকদেরই ষড়যন্ত্র আর তাদের হয়েই দালালী করছেন রবীন্দ্রনাথ! পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যের বিরুদ্ধে লেখালেখি হয়েছে, সব লেখা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি। তিনি পড়েছেন, প্রতিক্রিয়া হিসেবে বক্তব্য প্রদান অনুষ্ঠান স্থগিত করেছেন। এমনকি বক্তৃতা করার সময় প্রবল বিক্ষোভের মুখে বক্তৃতা দানে ইস্তফা প্রদানও করতে হয়েছিল।

বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং; ছবি: গেটি ইমেজেস

চীন ভ্রমণের পূর্বে অন্য কোথাও রবীন্দ্রনাথ বিড়ম্বনায় পড়েননি এমন নয়। জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেও তাকে পড়তে হয়েছিল ঝামেলায়। সেখানে তিনি তীব্র সমালোচনা করেছিলেন পুঁজিবাদী জাতীয়তাবাদের। জাপানিরাও কবিকে ছেড়ে কথা বলেনি। পত্রিকায় লিখেছে, “রবীন্দ্রনাথ পরাজিত ও শৃঙ্খলিত জাতির কণ্ঠস্বর; তাঁকে গুরুত্ব না দিলেও চলবে”। আমেরিকানরা বলেছে, “রবীন্দ্রনাথের বাণী অসুস্থ ভাবালুতায় আচ্ছন্ন, তিনি মহৎ আমেরিকার যুবসমাজের মনে বিষ ছড়াবার তালে তালে আছেন, তাই সতর্ক থাকা প্রয়োজন”। তবে চীন ভ্রমণ বোধহয় ছাপিয়ে গেছে অন্য সব বিড়ম্বনাকে। বিরোধটা রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল না, ছিল তার মতাদর্শের প্রতি। বক্তব্য চলাকালীন তাকে শুনতে হয়েছে, “পরাধীন দেশের চাকর ফিরে যাও। আমরা দর্শন চাই না। চাই বস্তুবাদ”।

চীনের সেকাল-একাল

এতকিছুর পরেও রবীন্দ্রনাথের বাণী বিফলে যায়নি। ১৯১৬ সালেই তিনি চীন সম্পর্কে আগাম বার্তা প্রদান করেছিলেন। বলেছিলেন বিজ্ঞানের সাহায্য যখন চীনাদের কর্মক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত হবে তখন অসাধ্যকে সাধ্য করতে পারবে তারা। ঠিক তার কিছু বছর পরেই চীনে বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। চীন এগিয়ে গিয়েছিল মুক্তির পথে। এমনকি এখনো তারা উন্নতির ধারা বজায় রেখেছে। ১৮৭২ সাল থেকে অর্থনীতিতে বিশ্বে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় দেড়শ বছর পর তাদের হটিয়ে ২০১৪ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে শীর্ষস্থান দখল করে চীন। সমাজতন্ত্র বা পুঁজিবাদ প্রশ্নের উত্তরও তারা দিচ্ছে সমান তালে। বিগত তিন দশকের মধ্যেই চীনের প্রায় ৮০ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার উপরে উঠে এসেছে।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে শীর্ষে চীন; ছবি: ইউটিউব

ভ্রমণকাহিনী লেখায় রবীন্দ্রনাথের জুড়ি নেই, তবুও চীন ভ্রমণ সম্পর্কে তেমন কিছুই লিখেননি বিশ্বকবি। বোধহয় বিরক্তিই ছিল প্রধান কারণ। তবে এ কারণে রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণ ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়নি। চৈনিক তান ওয়েন তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন, বাঙালি শিশিরকুমার দাশ তার সাহায্য নিয়ে লিখেছেন ‘বিতর্কিত অতিথি: রবীন্দ্রনাথ ও চীন’। চীনের বিপ্লব পূর্ববর্তী সময় এবং রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণের আদ্যোপান্ত জানা যাবে ছোট এই গবেষণালব্ধ বইটিতে।

তথ্যসূত্র

অবিরাম পথ খোঁজা, প্রবন্ধ: চীন দেশে রবীন্দ্রনাথ, লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী; প্রকাশনা: প্রথমা, প্রথম প্রকাশ: ২০১৭

ফিচার ইমেজ: tsinghua.edu.cn

Related Articles