বিশ্ববিদ্যালয় জীবন মানেই উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করা, সামনে জ্ঞানের বিশাল মহাসাগরের হাতছানি। শিক্ষালাভের সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় হচ্ছে উচ্চশিক্ষা। মূলত উচ্চশিক্ষা পর্যায় থেকেই জ্ঞানের প্রায়োগিক ও চর্চাভিত্তিক অধ্যায় শুরু হয়। আমরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে কিছু নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরে থেকে জ্ঞান অর্জন করে থাকি৷ এ সময়ে আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের বিষয়ের ওপর একইসাথে পড়াশোনা করতে হয়। শিক্ষার্থীদেরকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যেই মূলত এ ধরনের বৈচিত্র্যময় শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তাদেরকে যেতে হয়।
তবে এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য কিছুটা ভিন্নতর৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য মূলত তিনটি। জ্ঞানের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ। নির্ধারিত বিষয়ে জ্ঞানলাভ ও জ্ঞান উৎপাদন, দু'টি সম্পুর্ণ ভিন্ন জিনিস। যে কারণে উচ্চশিক্ষা সবার জন্যে উন্মুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে কি না, তা নিয়ে বেশ পুরনো বিতর্ক সবসময়ই রয়ে গিয়েছে।
এ যাবতকালে শিক্ষাকে আদর্শ কোনো সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায়নি। শিক্ষাবিজ্ঞানীরা একেকভাবে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্যকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন৷ শিক্ষাবিজ্ঞানীদের সার্বিক মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় খুব সাধারণ একটি সংজ্ঞা দাঁড় করানো যায়,
শিক্ষা হচ্ছে মানুষের আচরণের কাঙ্ক্ষিত ইতিবাচক পরিবর্তন, যা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত ও একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
অর্থাৎ, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও যথাযথভাবে সমাজের প্রতিচ্ছবি বিবেচনা ও বাস্তবতার নিরিখে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এজন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু পাঠ্যবইয়ের মাঝে সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন বাস্তবধর্মী ও গবেষণাধর্মী জ্ঞানলাভ করে থাকি। আজ আমরা কথা বলব, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কেন আমাদের গবেষণাকাজে উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত, এ নিয়ে।
উন্মুক্ত জ্ঞানচর্চা
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে উন্মুক্ত জ্ঞান আহরণ৷ জ্ঞানচর্চার জন্য তাই প্রয়োজন নিয়মমাফিক গবেষনা। গবেষণার বিষয় সাধারণত মৌলিক হয়ে থাকে, নতুন এমন কোনো বিষয়ের উপরে হয়ে থাকে, যা নিয়ে ইতোপূর্বে কাজ করা হয়নি। চলমান কোনো সিস্টেমের সমস্যা নির্ণয় বা সংস্করণের জন্যও প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক গবেষণাকার্য। মূলত এভাবেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন আঙ্গিকে গবেষণা করার সুযোগ তৈরি হয়। উন্মুক্ত পর্যায়ে এমন গবেষণার জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চ পর্যায়ে শিক্ষালাভের সুযোগ। এতে করে জ্ঞানের উৎপাদনের মতো উচ্চশিক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হওয়া অনেকটাই উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।
বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানার্জন
প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আমরা সাধারণত একাধিক বিষয় সম্পর্কে মৌলিক ধারণা অর্জন করে থাকি। উচ্চশিক্ষা এ দিক থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীরা সাধারণত জ্ঞানের নির্দিষ্ট একটি গণ্ডি নিয়ে জ্ঞানার্জন করে। বাংলার একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে যেমন বাংলার ইতিহাস, স্বরূপ, গতি-প্রকৃতি ও বিশদ নিয়মাবলী সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন, একইভাবে একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রোগ্রামিং, ডিজাইনিং ইত্যাদি সম্পর্কে তার একাডেমিক পড়াশুনা চালিয়ে যান। এ ধরনের নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানলাভের জন্যে পঠিত বিষয় সম্পর্কে যত বেশি জানা যেতে পারে, ততই ভালো। আর এ কারণেও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকার্যের বিকল্প নেই। জ্ঞানের নতুন শাখা তৈরি কিংবা বর্তমানের বিষয়গুলোকেই পরিমার্জন বা পরিবর্ধন করার জন্যে প্রয়োজন বিস্তারিত জ্ঞানলাভের, আর এই জ্ঞানলাভের জন্যে প্রয়োজন যথাযথ গবেষণা।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
কোনো একটি একাডেমিক বা ব্যবহারিক জীবনের সমস্যার প্রতি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী ও একজন গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি কখনো এক হয় না। একজন গবেষক সাধারণত বিভিন্ন কেস স্টাডি, ডিসকোর্স ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সমস্যাদি নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে থাকেন। এ চর্চার ফলে যেকোনো ধরনের সমস্যাকে কীভাবে সমাধান করতে হবে কিংবা কোন পদ্ধতি অনুসরণ করলে একটি কাঠামোভিত্তিক সমাধানে আসা সম্ভব, তা একজন তরুণ গবেষকের থেকে ভালো কেউ জানে না। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে গবেষণাকাজ করলে তা পরবর্তী শিক্ষাজীবন, ক্যারিয়ার ও ব্যবহারিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বেশ যথাযথ একটি প্রত্যক্ষণের গুণ এনে দেয়।
শিক্ষণ-শিখনের গুণগত পার্থক্য
বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানার্জনের সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ধাপ হওয়ার কারণে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশই পরবর্তী সময়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। শিক্ষকদের যেমন জ্ঞানী হতে হয়, একইসাথে তাদের পাঠদানের গুণও আয়ত্তে থাকা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, তাদের সহজে পড়া বোঝানো, তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা ইত্যাদি সবই একজন আদর্শ শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য। আর সেজন্য প্রয়োজন যথাযথ বিশ্লেষণ দক্ষতা ও শিক্ষার্থীদের সমস্যা নিরূপণ। একজন তরুণ গবেষকের পক্ষে এই শিক্ষণ-শিখন সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা তুলনামূলকভাবে বেশি সহজ।
দক্ষতা বৃদ্ধি
একজন গবেষক হিসেবে শুধু নিজের কাজটুকু করে যেতে হয়, শুধু তা নয়। পুরো প্রজেক্ট পরিচালনার জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা, তারপর সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ, গবেষণার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান করা সহ আরও অনেক কিছু এই ম্যানেজমেন্টের আওতায় পড়ে। একজন গবেষককে প্রায় প্রতিদিনই এ ব্যাপারগুলোকে চর্চায় রাখতে হয়। ফলে বাড়ে ব্যক্তিগত দক্ষতা। তবে গবেষণা যে সবসময় ব্যক্তিগত হয়, তা-ও না। অনেকসময় দলীয়ভাবে গবেষণাকাজ পরিচালনা করতে হয়। ব্যক্তিগত গবেষণার তুলনায় দলীয় গবেষণাকাজ খুবই পরিশ্রমসাধ্য একটি ব্যাপার। কীভাবে অন্য সহকর্মীদের সাথে কাজ করে সেরা ফলাফলটি বের করে নিয়ে আসা যায়, সে সম্পর্কে একজন গবেষকের ভালো ধারণা থাকতে হয়। তা না হলে প্রজেক্টটি দিনশেষে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
পাশাপাশি, তথ্য-প্রযুক্তিতে বলতে গেলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো বড় রকমের পরিবর্তন আসছে। আর গবেষকদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস যে তথ্য-উপাত্ত, তার সংগ্রহ, রক্ষণাবেক্ষণ, বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে প্রায় সবরকমের কাজের জন্যই প্রয়োজন পড়ে এই তথ্য-প্রযুক্তির। কাজেই একজন গবেষককে নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে নিজেকে প্রতিনিয়ত আপডেট করতে হয়। এর ফলে নিজস্ব প্রযুক্তিগত দক্ষতাও বৃদ্ধি পায়।
ক্যারিয়ার গঠন
এতক্ষন আলোচনা করলাম গবেষণা করার গুণগত পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক। এবারে গুণগত উন্নয়নের পাশাপাশি কীভাবে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে গবেষণাকাজ সহায়তা করে, তা জেনে নেব। বর্তমান সময়ে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি জমায়। দেশের বাইরে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি সহ পড়াশোনা করার জন্যে যে ক'টি মূল দক্ষতা প্রয়োজন, তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে গবেষণাকাজে পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা। ভাষাগত দক্ষতা, একাডেমিক ফলাফলের পাশাপাশি বর্তমান সময়ে গবেষণার অভিজ্ঞতাকেও বেশ বড় করে দেখা হয়। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আন্তর্জাতিক কোনো জার্নালে নিজস্ব দুই-তিনটি রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হলে তার জন্যে দেশের বাইরে পড়াশোনা করার ফান্ড পাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে যায়।
এ তো গেল উচ্চশিক্ষার জন্যে দেশের বাইরে যাওয়া। বাইরে পড়াশোনা করে এসে পরবর্তী সময়ে যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা বা বিষয়ভিত্তিক যেকোনো কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চান, তবে সেখানেও গুরুত্বসহকারে দেখা হবে শিক্ষাজীবনে করা গবেষণাকর্মের রেফারেন্স। তাই শুধু বাইরের দেশে পড়াশোনার জন্যে নয়, একাডেমিক যেকোনো কর্মক্ষেত্রে সবসময়ই বেশ গুরুত্বসহকারে দেখা হয়ে থাকে গবেষণাকাজকে।
গবেষণা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বয়সসীমা নেই। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পরেও গবেষণাকাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এর চর্চা শুরু করলে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে আর সবার থেকে খানিকটা এগিয়ে থাকা যায়। বর্তমান পৃথিবী তারুণ্যনির্ভর। তরুণ বয়সে নতুন কিছুর প্রতি যতটা আগ্রহ আর উদ্যম থাকে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে শক্তি, আগ্রহ আর উদ্যম ধীরে ধীরে কমে যায়। তাই, যারা গবেষক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তাদের জন্য ভালো হবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গবেষণায় হাতেখড়ি করা।
This is a Bengali language article. It is about the importance of research works at the undergraduate level. Students may come up to know about the facilities and requirements of being a researcher during their higher education.
References are hyperlinked inside the article.
Featured image: www.presby.edu