সকালের খবরের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এমন অনেক ঘটনাই আমাদের চোখের সামনে ধরা পড়ে, যা রীতিমতো রোমাঞ্চকর। এসব ঘটনার কোনোটিতে আলোচনার ঝড় ওঠে বিশ্বজুড়ে, আবার কোনো ঘটনা মানুষের চোখের অগোচরেই থেকে যায়। সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসা এমন কয়েকটি ঘটনা নিয়ে আজকের আয়োজন।
হাওয়াইয়ের নিষিদ্ধ স্বর্গের সিঁড়ি
হাওয়াইয়ের অঞ্চলটি পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। এখানে যেমন রয়েছে বিস্তৃর্ণ সমুদ্র বেলাভূমি, তেমনই রয়েছে রহস্যময় পাহাড়। হাওয়াইয়ের অনাবিল সৌন্দর্য যেকোনো পর্যটকের কাছেই বেশ আকর্ষণীয়। এর বাইরে এই স্থানটি আরও একটি কারণে বিশেষভাবে জায়গা করে নিয়েছে।
হাওয়াইয়ের হাইকু উপত্যকায় নাকি রয়েছে স্বর্গে পৌঁছানোর এক সিঁড়ি, যা হাইকু স্টেয়ার্স নামে পরিচিত। এ নিয়ে মানুষের কৌতুহলেরও শেষ নেই। তবে এর পেছনে রয়েছে অন্য এক রহস্য। ১৯৪১ সালে প্রশান্ত মহাসাগর তীরবর্তী হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে জাপানীদের আক্রমণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী নিজেদের মধ্যকার সামরিক যোগাযোগ সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে হাওয়াইয়ের হাইকু উপত্যকায় এক গোপন রেডিও স্টেশন নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই রেডিও স্টেশন নির্মাণের জন্য তারা এমন একটি স্থান বেছে নেয়, যেখানে ২০০ ফুট উচ্চতার পাশাপাশি দুটি পাহাড় রয়েছে। সেই দুই পাহাড়ের মাঝামাঝি একটি সমতল স্থানে নির্মাণ করা হয় এই রেডিও স্টেশনটি। এই রেডিও স্টেশনে পৌঁছানোর জন্য নির্মাণকারী দল পর পর লোহার সিঁড়ি দিয়ে পাহাড়ের গায়ে গেঁথে দেয়। এভাবে ৩,৯২২ ধাপের সিঁড়ি পাড়ি দিয়ে যেতে হয় রেডিও স্টেশনটিতে।
সেই সিঁড়ি দিয়ে পথ পাড়ি দেয়াও বেশ বিপজ্জনক। পাহাড়ি গাছগাছালিতে ঢাকা পড়ে রয়েছে অধিকাংশ সিঁড়ি পথ। বিশ্বের অনেক পর্যটকই রোমাঞ্চকর অভিযানের নেশায় এই পথ পাড়ি দিতে চেষ্টা করেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বাধ্য হয়ে সর্বসাধারণের জন্য এই পথটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৭৫ সালে পথটি পর্যটকদের জন্য আবার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
কিন্তু পর্যটকদের চাপে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সিঁড়ির বেশ কয়েক জায়গা ভেঙে পড়ায় পুনরায় বিপজ্জনক হয়ে পড়ে পথটি। ফলে ১৯৮৭ সালে পথটি আবার বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রশাসন বেশ কয়েকবার সিঁড়ি পথটি ভেঙে ফেলার কথা ভেবেছিল। কিন্তু ‘ফ্রেন্ডস অফ হাইকু স্টেয়ার্স’ নামের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সিঁড়ি পথটিকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসে। বর্তমানে তাদের তত্ত্বাবধানেই রয়েছে ৩,৯২২ ধাপের এই নিষিদ্ধ স্বর্গের সিঁড়ি।
অদ্ভুত সেই পোস্টবেক্সে আজও চিঠি আসে
আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে মানুষ এখন ভুলেই গেছে কাগজে চিঠি লেখার কথা। একসময় আমাদের চারপাশে দেখতে পাওয়া খুবই পরিচিত পোস্টবক্সগুলো এখন শৈশবের স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। তবে জাপানের পোস্টবক্সটি একটু ভিন্নমাত্রার। আর তাতে চিঠি ফেলা অনেকের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা।
জাপানের নিশিমুরো জেলার ওয়াকায়ামায় মাছ উৎপাদনের জন্য পরিচিত এক জনপ্রিয় শহর সুসামি। প্রায় ১৭৪.৭১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে শহরটি বিস্তৃত। প্রায় পাঁচ হাজার লোকের বাস এখানে। অধিকাংশই পেশায় মৎস্যজীবী। বেশ ছিমছাম আর সুন্দর এ শহরের পরিবেশ। সমুদ্র উপকূলবতী হওয়ায় শহরের কাছেই রয়েছে দর্শনীয় সমুদ্রতট। প্রতিবছর এখানে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসেন গভীর সমুদ্রে ডাইভিংয়ের জন্য। এর বাইরে আরও একটি রোমাঞ্চকর অভিযানের নেশায় তারা ছুটে আসেন এখানে।
১৯৯৯ সালের এপ্রিলে পর্যটনের প্রসার ঘটানোর জন্য এখানকার স্থানীয় প্রশাসন সমুদ্রের তলদেশে পোস্টবক্স স্থাপনের এক অদ্ভুত পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তৎহিকো মাতসুমোতো নামের এক ৭০ বছরের পোস্টমাস্টার সমুদ্রের তলদেশে এই পোস্টবক্সের ধারণাটি পর্যটন অধিদপ্তরের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন।
সমুদ্র সৈকত থেকে ১০ মিটার দূরে এবং প্রায় ৩২ ফুট গভীরে এই পোস্টবক্স স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু কীভাবে লোকে এই পোস্টবক্সে চিঠি ফেলবে? আর কীভাবেই সেই চিঠি সমুদ্রের পানিতে নষ্ট না হয়ে যথাযথ প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে? সে ভাবনা থেকে সিদ্ধান্ত হয়, পর্যটকরা ওয়াটারপ্রুফ কাগজে এবং ওয়াটারপ্রুফ মার্কার পেন দিয়ে চিঠি লিখে সমুদ্রের জলের নিচে গিয়ে সে পোস্টবক্সে চিঠি পোস্ট করতে পারবেন। ফলে সমুদ্রের জলে ডাইভিং করার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আর প্রিয়জনের কাছে তার মনের ভাব প্রকাশের ইচ্ছেয় চিঠি লিখে সেই পোস্টবক্সে চিঠি ফেলে আসেন।
প্রতিবছর হাজার হাজার চিঠি জমা পড়ে এই ডাকবাক্সে। পোস্টবক্স স্থাপনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই ডাকবক্সে প্রায় ৩২ হাজার চিঠি পড়েছে। ২০০২ সালে গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে এই অদ্ভুত পোস্টবক্সটি স্থান করে নেয়। আর এর আকর্ষণে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক পর্যটক জাপানের সুসামি শহরে জড়ো হন।
যে গ্রামে এখনও পূজিত হন হিটলার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেনি জার্মানিসহ তার আশেপাশের ইউরোপীয় দেশগুলোর জনগণ। যে মানুষটির কারণে লাখ লাখ মানুষ হলোকাস্ট নামক নির্মমতার শিকার হয়েছিল, অনেকে হয়েছিল ঘরছাড়া, দেশছাড়া, শরণার্থী হিসেবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তিনি আর কেউ নন, নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর দেশ থেকে হিটলারের অস্তিত্বকে চিরতরে মুছে ফেলার উদ্যোগ নেয় জার্মান সরকার। নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় তার তৈরি নাৎসি পার্টির সকল কর্মকান্ড। নাৎসি আর্দশের নতুন কোনো দল বা নেতা যাতে তৈরি হতে না পারে সেজন্য সরকার জার্মান পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন করে। হিটলারের স্মৃতিকে অপ্রসাঙ্গিক করতে পরবর্তীকালে জার্মানির বিভিন্ন সরকারের নানা উদ্যোগের পরও এখনও কিছু কিছু জায়গায় রয়ে গেছে এই স্বৈরশাসকের বেশ কিছু স্মৃতিচিহ্ন।
দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির এক প্রত্যন্ত গ্রাম হার্কহিম আম বার্গ। সেখানের প্রাচীন সেন্ট জেমস প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চে আজও হিটলারের শুভকামনায় ঘন্টা বাজানো হয়। সেই ঘন্টায় উপরের দিকে চরম মমতায় খোদাই করা হিটলারের প্রতি সমর্পিত বাণী, “পিতৃভূমির জন্য সমর্পিত, অ্যাডলফ হিটলার”। আর নীচের অংশে শোভা পাচ্ছে বড় বড় করে চিত্রিত আর্যরক্তের আভিজাত্যের প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন।
১৯৩৪ সালে তৎকালীন হিটলারের সমর্থকপুষ্ট এক মেয়র এই ঘন্টাটি গির্জার সম্মুখে স্থাপন করেন। এভাবে বছরের পর বছরের গির্জা থেকে নিয়মিত ঘন্টার ধ্বনি শোনা যেতে থাকে। এই ঘন্টা বাজিয়েই গ্রামবাসীরা তাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা শুভ কাজ সম্পন্ন করেন। গ্রামবাসীরা হয়তো এই ঘন্টার তাৎপর্যের কথা ভুলেই যেত, যদি না রোল্যান্ড বেকার নামের গ্রামের প্রাক্তন মেয়র বিষয়টি তুলে না ধরতেন। এর পরেই এই ঘন্টার কথা জার্মানির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় তা সরানোর জোর দাবি ওঠে।
ফলে সাড়ে সাতশ গ্রামবাসীর মধ্যে এ নিয়ে দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দেয়। ঐ অঞ্চলের নির্বাচিত কয়েকজন কাউন্সিলর ঘন্টাটি অপসারণের দাবি তোলেন। আবার কয়েকজন ঘন্টাটি সংরক্ষণের প্রস্তাব করেন। তাদের বক্তব্য, নাৎসি যুগের স্থাপিত ঘন্টাটি জাতির অন্ধকার অতীতের স্মারক হিসেবে রেখে দেয়া হোক। এ নিয়ে সেখানকার কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে ভোটাভুটিরও আয়োজন করা হয়। আর তাতে ১০-৩ ভোটে গির্জার ঘন্টা অপসারণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।
জার্মানিতে হিটলারের শাসনামলে তার সমর্থনে দেশের বিভিন্ন গির্জা থেকে স্তোকবাক্য পাঠ করা হতো। পরবর্র্তীকালে তার এবং তার সরকারের পতনের পর সেই রীতি বিলুপ্ত হয়। কিন্তু আজও হার্কহিম আম বার্গ অঞ্চলের মতো জার্মানির বেশ কিছু গির্জায় বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছে এমন কয়েকটি ঘণ্টা, যা অতীতের অন্ধকার দিনগুলোর কথা সবাইকে বারবার মনে করিয়ে দেয়।
This is a Bengali article. This describes about some strange places around the world. All the sources are hyperlinked inside the article.
Feature Image Source: trevellers.com