Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাগরিকায় বাংলাদেশের স্মরণীয় জয়

জয় থেকে তখনও ১৩ রানের দূরত্বে ব্যাট করছিল বাংলাদেশ। এমন সময় ইমরুল কায়েস উইলিয়াম মাসাকাদজার ঘূর্ণি বলে হাওয়ায় ভাসিয়ে মারলেন, সেই বল গিয়ে বাউন্ডারির কাছে তালুবন্দী হলো এল্টন চিগাম্বুরার। দুশ্চিন্তার কিছু নেই, কারণ ততক্ষণে ওপেনার ইমরুল কায়েস ১১২ বলে ১১৫ রানের চোখ ধাঁধানো এক ইনিংস খেলে ফেলেছেন। বোলার মাসাকাদজার সঙ্গে উদযাপন করতে এসে তারই সতীর্থ সিকান্দার রাজা তাই প্রতিপক্ষ দলের ইমরুলকে অভিনন্দন জানাতে ভুললেন না, হাতটা মুঠো করে বাড়িয়ে ধরলেন তার দিকে। প্রত্যুত্তরে গ্লাভস পরা ইমরুলও ছোট একটা ঠোকা দিয়ে ড্রেসিংরুমের পথ ধরলেন।

এই দৃশ্য দেখে ধারাভাষ্যকক্ষে তখন জিম্বাবুইয়ান কিংবদন্তি অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল মাইক্রোফোন হাতে বলে উঠলেন,

‘হোয়াট আ পারফেক্ট রেসপেক্ট ফর আ সেঞ্চুরিয়ান!’

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে ইমরুল কায়েস কেবলই একজন সেঞ্চুরিয়ান নন। তিন ম্যাচে সিরিজের সেরা ক্রিকেটার, সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক, তিন ম্যাচে যেখানে ছিল দু’টি সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় ম্যাচে সেঞ্চুরি হয়নি, ৯০ রানে ফিরেছেন।

পুরো সিরিজ জুড়ে এভাবেই উদযাপনের গল্প লিখেছেন ইমরুল কায়েস; Image Credit: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

তার ব্যাটে চড়ে সহজ জয়ের পথে হেঁটেছে বাংলাদেশ। নিয়মরক্ষার শেষ ম্যাচে ৪৭ বল হাতে রেখে জয় পেয়েছে ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে।

সাগরিকায় কেবল ইমরুল নন, আসল চমকটা দেখিয়েছেন সৌম্য সরকার। এই সিরিজেই প্রথমবারের মতো দলে জায়গা পাওয়া ফজলে মাহমুদ রাব্বি যখন পরপর দুই ম্যাচেই শূন্য রানে ফিরলেন, তখন আর ভরসা রাখতে পারেনি বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। শেষ ম্যাচকে সামনে রেখে উড়িয়ে আনা হলো সৌম্যকে। এসেই ৯২ বলে ১১৭ রানের এক ঝড় তোলা ইনিংস খেলে দিলেন, ম্যাচ সেরার পুরস্কারটাও বাগিয়ে নিলেন।

সবমিলিয়েই ৩-০ তে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতে নিল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। যেখানে তামিম ইকবাল ও সাকিব আল হাসানের মতো দুই সেরা ক্রিকেটারের অনুপস্থিতি, সেখানে তরুণদের নিয়ে এভাবে হেসে খেলে জিতলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা-মুশফিকুর রহিম-মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরা; জানান দিলেন আসন্ন বিশ্বকাপের আত্মবিশ্বাসী প্রস্তুতির।

১.

ইতিহাস গড়ার পথে সৌম্য-ইমরুল; Image Credit:  MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

দলে তিনটি পরিবর্তন। সাকিব আল হাসানের জায়গায় ফজলে রাব্বি ব্যর্থ হওয়ার কারণে সুযোগ এল সৌম্য সরকারের। অন্যদিকে, এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ নিশ্চিত হওয়ায় তরুণদের একটু বাজিয়ে দেখার ইচ্ছা। ফলাফল, মেহেদী হাসান মিরাজ, মুস্তাফিজুর রহমানকে বিশ্রামে দিয়ে দলে নেওয়া হলো আরিফুল হক ও আবু হায়দার রনিকে।

সাগরিকার চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী ক্রিকেট স্টেডিয়ামের উইকেট আগেই বুঝে নিয়েছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। টের পাচ্ছিলেন, উইকেটে রানটা ভালোই হবে। হয়তো সে কারণেই ‘যাহাই বাহান্ন, তাহাই তেপ্পান্ন’ মনে রেখে টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন।

ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেও প্রথমদিকে জিম্বাবুয়েকে চেপে ধরেছিল বাংলাদেশ, সফরকারীরা রানের খাতায় ৬ রান তুলতে না তুলতেই দুই ওপেনারকে সাজঘরে পাঠিয়ে দেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ও আবু হায়দার রনি।

কিন্তু এই শুরুর ভালোটা বাংলাদেশকে বেশিক্ষণ উপভোগ করতে দেয়নি জিম্বাবুয়ে। তৃতীয় উইকেটে সাবেক অধিনায়ক ব্রেন্ডন টেইলর ও শন উইলিয়ামস মিলে দারুণভাবে ঘুরিয়ে দেন দলকে। গড়েন ১৩২ রানের দারুন জুটি, যা কিনা জিম্বাবুয়েকে বড় সংগ্রহের দিকে এগিয়ে দেয়। দলীয় ১৩৮ রানে জুটি ভাঙেন স্পিনার নাজমুল ইসলাম অপু, তার বলে কট বিহাইন্ডের শিকার হন টেইলর। ততক্ষণে অবশ্য ৭৫ রানের দারুণ এক ইনিংস উপহার দিয়েছেন।

অপুর ট্রেডমার্ক নাগিন ড্যান্স; Image Credit:  MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

পরের উইকেটে ১০৪ রানের জুটি গড়েন শন উইলিয়ামস ও সিকান্দার রাজা। এই জুটিতেই ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরি পান উইলিয়ামস। রাজা ৪০ রানে নাজমুলের বলে ফিরলে আরও ৬২ রানের ব্যবধানে আউট হন পিটার মুর, তার ব্যাটে আসে ২৮ রান। শেষ পর্যন্ত শন উইলিয়ামসের সঙ্গে ১ রানে অপরাজিত ছিলেন এল্টন চিগাম্বুরা। অন্যদিকে, ১৪৩ বলে ১২৯ অপরাজিত অনবদ্য এক ইনিংস খেলে মাঠ ছাড়েন উইলিয়ামস। সবমিলিয়ে নির্ধারিত ৫০ ওভারে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ২৮৬ রানের বড় সংগ্রহ তুলে থামে জিম্বাবুয়ে।

২.

বাংলাদেশের জন্য নিয়মরক্ষার ম্যাচ, তবে জয়টা চাই-ই। টিম ম্যানেজমেন্ট এই জয়টা চায় তরুণদের কাছ থেকে। টপ অর্ডারের ব্যাটিং নিয়ে গত কয়েক মাসে যা সমালোচনা হচ্ছে, সেটাকেই কাটিয়ে উঠাতে চাওয়া দলের।

কিন্তু শুরু হলো একেবারে উল্টোভাবে। দলের খাতায় কোন রান তোলার আগেই ইনিংসের প্রথম বলেই এলবিডব্লিয়ের জোরালো আবেদন, ব্যাটসম্যান লিটন কুমার দাশ। আম্পায়ার আউট দিলে রিভিউ নিতে দেরি করেনি বাংলাদেশ। এই লিটনই আগের ম্যাচে ৮৩ রানের ইনিংস খেলেছেন। সেবারও আম্পায়ার রড টাকার তার বিপক্ষে আউটের সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন, কিন্তু রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান লিটন। শুক্রবার তার দূর্ভাগ্য, সাজঘরেই ফিরতে হয়েছে। শূন্য রানে, রিক্ত হাতে।

তবে দ্বিতীয় উইকেটে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। জাতীয় লিগ থেকে উড়ে আসা সৌম্য আর ইমরুল মিলে গড়লেন ২২০ রানের জুটি, সেটাও আবার মাত্র ৩০ ওভারে!  সৌম্য সরকার ৯২ বলে ১১৭ রানের ইনিংস খেলে হ্যামিল্টন মাসাকাজদার বলে আউট হলে জুটি ভাঙ্গে। বলে রাখা ভালো, সৌম্য-ইমরুলের এই ২২০ রানের জুটি বাংলাদেশের পক্ষে ওয়ানডেতে দ্বিতীয় উইকেটের সর্বোচ্চ রানের জুটি।  

সাগরিকা দু’হাত ভরে দিয়েছে সৌম্যকে; Image Credit:  MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

সৌম্য সরকারের ফিরে আসাটা চোখে লেগে থাকার মতো ছিল। ৯২ বলে খেলা এই শতরানের ইনিংসে ছিল নয়টি চার ও ছয়টি ছক্কার মার। বাজে পারফরম্যান্সের কারণে জাতীয় দলের বাইরে থাকা, চুক্তির বাইরে থাকা এই সৌম্য ২০১৫ সালের পর প্রথম একটা সেঞ্চুরি পেলেন। মাঝের সময়ে নিজেকে একরকম হারিয়েই ফেলেছিলেন এই ওপেনার। ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে তাকে কম সুযোগ দেওয়া হয়নি, তারপরও যেন পেরে উঠছিলেন না ৩৫ ওয়ানডে ম্যাচে ১১১৭ রান করা এই ক্রিকেটার।

জিম্বাবুয়ে সিরিজের ওয়ানডে কিংবা টেস্ট কোনো দলেই ছিলেন না সৌম্য। কিন্তু এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই বিকেএসপিতে প্রস্তুতি ম্যাচে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন, শেষ ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়ে তারই উপহার পেলেন তিনি। পাশাপাশি, প্রতিদানটাও দিয়েছেন মনের মতো করে।

ম্যাচ শেষে উচ্ছ্বসিত সৌম্য সরকারের মুখে হাসি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বললেন,

‘এমন একটা ইনিংস খেলতে পেরে খুব খুশি হয়েছি। দলের বাইরে ছিলাম, সে কারণেই হয়তো এভাবে খেলতে পেরে বেশি ভালো লাগছে। উইকেট ব্যাটিং সহায়ক ছিল। কভারে ফিল্ডিং করছিলাম যখন, তখন দেখছিলাম জিম্বাবুয়ে ভালো রান করছে। তখনই মনে হয়েছিল ভালো কিছু হতে পারে আজ।’

সৌম্য ফেরার পর ইমরুল কায়েসকে সঙ্গ দিতে আসেন মুশফিকুর রহিম। এই উইকেটে দুজনে গড়েন ৫৪ রানের জুটি। এই জুটিতেই সিরিজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির দেখা পান ইমরুল কায়েস, শেষ পর্যন্ত খেলেন ১১৫ রানের ইনিংস। উইলিয়াম মাসাকাজদার বলে সাজঘরে ফিরলে জয়ের ফুল ফোটে মুশফিক ও মিঠুনের ব্যাটে। মুশফিক ২৮ রানে ও মিঠুন ৭ রানে অপরাজিত ছিলেন। শেষটায় ছক্কা মেরে দলকে জিতিয়ে দেন সাবেক অধিনায়ক মুশফিক।

জয়ের আলোর পুরোটা কেড়েছেন ইমরুল নিজে, খানিকটা যেন সৌম্যকেও ছাপিয়ে গেছেন। জুটির রেকর্ডের পাশাপাশি গড়েছেন ব্যক্তিগত রেকর্ড। সৌম্যর সঙ্গে ২২০ রানের জুটি কেবল দ্বিতীয় উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটি নয়, ঘরের মাঠে যে কোন উইকেটেই সর্বোচ্চ রানের জুটি।

৩ ম্যাচে ৩৪৯ রান করা ইমরুল এখন বাংলাদেশের পক্ষে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। এর মধ্যে দিয়ে পিছনে ফেলেছেন ড্যাশিং ওপেনার ও যেকোনো ফরম্যাটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম ইকবালকে। এর আগে ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ৩১২ রান তোলেন তামিম ইকবাল। সেবার তার ব্যাটে ছিল দুই সেঞ্চুরি ও একটি হাফ সেঞ্চুরি।

রেকর্ডের পাতায় ইমরুল কায়েস; Image Credit:  MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

ইমরুলের এমন পারফরম্যান্স তাকে করেছে টুর্নামেন্টের সেরা ক্রিকেটার। উচ্ছ্বাসের কমতি করেননি। পাশাপাশি যে সৌম্য তাকে এতটা সাহায্য করেছেন উইকেটে, তাকেও কৃতিত্ব দিতে ভোলেননি। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ইমরুল বলেন,

‘আমার জন্য দারুণ একটা সিরিজ ছিল। আমি আমার সেরাটা দিয়ে ভালো করার চেষ্টা করেছি। আজ সৌম্য উইকেটে অনেক ইতিবাচক ছিল। সে ভালো ব্যাটসম্যান, আমার উপর থেকে অনেকটা চাপ কমিয়েছে। আসন্ন টেস্ট সিরিজেও আমি আমার এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবো।’

রঙিন পোশাকের ধবল ধোলাইয়ে মনে রাখার মতোই কিছু করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এবারের মিশন সাদা পোশাকের টেস্টে। প্রথমবারের মতো সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে পাঁচদিনের এই মিশনটা শেষ পর্যন্ত রাঙাতে পারবে তো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল? হয়তো সময়ই বলে দেবে সেটা।

This article is in Bangla language. 

Featured Image: MUNIR UZ ZAMAN/AFP/Getty Images

Related Articles