ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়ায় সগর্বে। আর তা যখন রসনা পরিতৃপ্ত করে দেওয়ার মতো কোনো খাবার, তাতে মানুষের বাড়তি কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। মেজবানের সংস্কৃতি প্রসারে অতিথিপরায়ণ চট্টগ্রামবাসী বেশ সফল। দেশের সীমা পেরিয়ে তা এখন বিশ্বব্যপী সমাদৃত।
'মেজবান' শব্দটি ফারসি। এর অর্থ নিমন্ত্রণকারী। আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হয় 'মেজ্জান'। মেজবান একটি অনুষ্ঠান, ভোজন কেবল তার অংশ। ধনী-গরিব, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটে এ মিলনমেলায়। জানা যায়, চট্টগ্রামে মেজবানের প্রচলন শুরু হয় ১৮ শতকের দিকে। স্থানীয় অসংখ্য ছড়া-কবিতার পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যেও স্থান পেয়েছে এ ঐতিহ্য। বিশিষ্ট ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া লিখেছেন-
বিভিন্ন উপলঅনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে মেজবান হয়ে থাকে। আকিকা, সুন্নতে খৎনা, কুলখানি, চল্লিশা থেকে শুরু করে বিয়েশাদি, জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী- মানে উপলক্ষের অন্ত নেই। ব্যবসায় সাফল্য লাভ, নতুন ঘরে ওঠা, এমনকি মেয়েদের নাক-কান ফোঁড়ানো হলেও মেজবান দেওয়া হয়। রাজনৈতিক নেতারাও জনপ্রিয়তা লাভে কিংবা দলীয় কর্মী, সমর্থকদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে বড় পরিসরে এ আয়োজন করেন। চট্টগ্রামে বছর জুড়ে মেজবানি অনুষ্ঠান হয়। এ অঞ্চলের মানুষ আবার মাজার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। তাই শীতের মৌসুমে বিভিন্ন মাজারের ওরস শরিফ, মিলাদ মাহফিল উপলক্ষে এ গণভোজ অনুষ্ঠান বেশি হয়।
মেজবানের খাওয়া যতটা না মজাদার, তার চেয়ে মজার ব্যাপার হলো এ কর্মযজ্ঞের আয়োজন আর রান্নাবান্না। রেওয়াজ অনুযায়ী, মেহমানদের আপ্যায়ন এবং মেজবানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় শলা-পরামর্শের জন্য আয়োজকরা আগের রাতে বসেন, নিজেদের মাঝে দায়িত্ব বণ্টন করে নেন। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় 'আগ দাওয়াত' বা 'আগদঅতী'। অন্যান্য অঞ্চলে বলে 'পান সলাৎ'। গ্রামের দু-একজন মাতব্বরও এতে যোগ দেন।
সচরাচর মেজবানের আগেরদিন গরু জবাই করে মাংস প্রস্তুত করা ও মসলা বাটার কাজ সেরে রাখা হয়। মেজবানের দিন বেলা বাড়ার সাথে রান্নার কাজও এগোতে থাকে। বিশাল শামিয়ানার নিচে সারি সারি তামার ডেকচি, একেক ডেকচিতে গোশত ধরে ৭০/৮০ কেজি। ধোঁয়া আর আগুনের উত্তাপে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তবে মাংস রান্না হলে খুশবু বয়ে বেড়ায় সমগ্র মহল্লাতে। একের পর এক পদ রান্না হয়ে গেলে দুজন 'ডেক-বারি' চেপে চুলা থেকে নামিয়ে আনেন বিশাল বিশাল ডেকচি। খাবার গরম রাখতে ঢাকনার উপর জ্বলন্ত অঙ্গার দিয়ে রাখা হয়। বাবুর্চি ও তাদের যোগালিরা মাংস কোটা থেকে শুরু করে মেহমান বিদায় করা পর্যন্ত পরিশ্রম করেন, বিশ্রামের ফুরসতটুকু পান না।
প্রথা অনুযায়ী, আপ্যায়নের আগে হুজুর দোয়া-মোনাজাত পরিচালনা করেন। তারপর মেহমানরা খাওয়া-দাওয়া শুরু করেন। এভাবে দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে আপ্যায়ন। আমন্ত্রিত অতিথিদের অংশগ্রহণে এ মিলনমেলায় বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। লাকড়ির চুলা আর কয়লাকাঠে রান্না বেশ সুস্বাদু হয় বলে মানুষ তা তৃপ্তিসহকারে খেতে পারে। দীর্ঘ সময় পর অনেকের দেখা-সাক্ষাৎ হয়। খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি পরস্পর আড্ডা ও খোশগল্প চলে। সম্পর্ক অটুট রাখার ভালো সুযোগও বটে।
মোহাম্মদপুর শারিরীক শিক্ষা কলেজ মাঠে চট্টগ্রাম সমিতির মেজবান; Image Source: UNB
অনেক জায়গায় এত বড় পরিসরে মেজবান হয় যে, 'আনলিমিটেড গেস্ট আর আনলিমিটেড ফুড'। বিরামহীন চলে খানাপিনা, এক ব্যাচ উঠছে তো আরেক ব্যাচ বসছে। আয়োজকও সাধ্যমতো আঞ্জাম দেন, যাতে কেউ অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে না যান। গরু কেনা থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক খরচাদিতে কার্পণ্য করেন না। মানুষ পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবসহ খেতে যায়। ময়-মুরব্বি, মোড়লরাও বাদ থাকে না। এলাকার ছেলেপেলেরাও হাজির হয়ে যায় দলবল নিয়ে। মেজবানের সৌন্দর্য হলো, এতে শ্রেণি-বিভাজন নাই।
আগে এক গ্রামে কোনো মেজবানের আয়োজন থাকলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে এ খবর রটে যেত। ঢোল পিটিয়ে, চুঙ্গি ফুঁকিয়ে মানুষকে জানানো হতো, আর যে যার মতো এসে খেয়ে যেত। খোলা মাঠে পাটি বা বাশের ধাঁরা বিছিয়ে আপ্যায়ন করতেন আয়োজকরা। খাবার পরিবেশন করা হতো মাটির সানকিতে।
এখন অবশ্য যুগ বদলেছে। বদলেছে মেজবানের ধরন। খোলা জায়গার অপ্রতুলতায় এখন আয়োজন করা হয় নগরের কমিউনিটি সেন্টারে। কার্ড বিলি করে কিংবা মোবাইলে দাওয়াত প্রদান করা হয়। মাটির সানকির প্রচলন নেই বললেই চলে। ডেকোরেশনের বয়-বেয়ারাদের পরিবেশনার মধ্যে তো আর গ্রামের মানুষের আন্তরিকতার সেই ছোঁয়া পাওয়া যাবে না।
প্রশ্ন জাগতে পারে, এতক্ষণ যাবৎ তো মেজবানের এন্তেজাম ও রন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে জানলাম। খাবারের মেন্যু তো জানা বাদ পড়ল। পোলাও, বিরিয়ানি না থাকলেও গোশত, ভাতের মিশেলে এটি পরম উপাদেয় এক খাবার। মেজবানের অনুষ্ঠানসমূহে সাদা ভাত ছাড়াও গরুর গোশতের ৩টি পদ থাকে। সেগুলো হলো-
১. মেজবানের ঝাল মাংস: মেজবানের মূল আইটেম এ মাংস অন্য দুই পদের চেয়ে বেশি ঝাল হয়। বিশেষ মসলা দেওয়া হয় বলে প্রচলিতভাবে রান্না করা মাংসের চেয়ে ভিন্ন।
২. চনার ডাল: ছোলার ডালের সাথে গরুর হাড়-চর্বি, লাউ বা মিষ্টি কুমড়া দিয়ে রান্না করা হয়।
৩. নলা হাজি: নেহারি বলে আমরা যেটা চিনি ঠিক তা, গরুর পায়ার ঝোল।
অতিরিক্ত কোথাও আবার 'আখনি' পরিবেশন করা হয়। আখনি হলো হালকা মশলা দিয়ে ভাত আর গোশতের সমন্বয়ে একধরনের খাবার। কিছুটা বিরিয়ানির মতো।
মেজবান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং গরুর মাংস না খাওয়া অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য খাসির ব্যবস্থা থাকে। চট্টগ্রামে আগেকার দিনে হিন্দু অধ্যুষিত কিছু এলাকা থাকায় সেখানে গরুর পরিবর্তে মাছের মেজবান হতো।
মুখরোচক কালাভুনা; Image Source: Bangla Tribune
মূলত খাবারের স্বাদ নির্ভর করে বাবুর্চি বা রাঁধুনির হাতের উপর। মেজবানি রান্নায় চাটগাঁইয়া বাবুর্চিরা বেশ দক্ষ, বংশ-পরম্পরায় এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কেউ কেউ দেশের বাইরে গিয়েও মেজবানি রান্না করে থাকেন।
মেজবানের উৎপত্তি চট্টগ্রামে হলেও তা কিন্তু এখন আর শুধু চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ ভোজন অনুষ্ঠান বিস্তৃতি লাভ করে 'জেয়াফত' নামে। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় মেজবানের এন্তেজাম করা হয়। এছাড়াও ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি জাঁকজমকের সাথে প্রতি বছর মেজবানি খানার আয়োজন করে। মূলত জাতীয় অধ্যাপক নূরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় বড় পরিসরে মেজবান অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালে ঢাকা কলেজ মাঠে। পরবর্তীকালে সংসদ ভবনের হোস্টেল মাঠে এবং মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজ মাঠেও এ আয়োজন হয়েছে বলে শোনা যায়।
শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশের সীমা পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ-আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে চট্টগ্রামের প্রবাসীরা পারস্পরিক সম্পর্ক দৃঢ় করার পাশাপাশি গেট টুগেদারে মেজবানের ঐতিহ্যও রক্ষা করে আসছেন।
চনার ডাল বা বুটের ডাল; source: charpashe.com
মেজবানি খাবারের বিশেষ আকর্ষণ থাকায় চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁর এ খাবার মেন্যুতে থাকে। এদের মধ্যে জামালখানের 'মেজ্জান হাইলে আইয়ুন’ রেস্তোরাঁ উল্লেখযোগ্য। এ নামের মানে হলো, মেজবান খেতে চাইলে আসুন। ঢাকা শহরেও বেশ কিছু রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, যারা বিভিন্ন প্যাকেজে মেজবানি খাবার পরিবেশন করেন। যে কেউ মেজবানির স্বাদ নিতে চাইলে সেসবে ঘুরে আসতে পারেন।
তো পাঠক, মেজ্জান হাইলে যাইয়ূন!
This article is in Bengali language. This is about Mejban, a traditional food culture and also food item of Chattogram.
রোর মিডিয়া হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি বহুভাষী মিডিয়া প্লাটফর্ম, দেশ ও মানবজাতির গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত নানা বিষয় নিয়ে যারা চমকপ্রদ সব কন্টেন্ট তৈরি করে থাকে, তুলে ধরে গবেষণালব্ধ ফলাফল। আমাদের সকল কন্টেন্টেরই লক্ষ্য থাকে পাঠক-দর্শকদের নতুন কিছু জানানো, নতুন করে ভাবতে শেখানো, এবং সর্বোপরি সমাজের জন্য ইতিবাচক কিছু করবার আহবান।