সারা পৃথিবীর ভোজনরসিক মানুষের মনে লেবানিজ কুইজিন একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। অসাধারণ স্বাদ, মোহনীয় ঘ্রাণ আর চোখ ধাঁধানো পরিবেশন; লেবাননের বিশেষ রন্ধনশৈলী অনন্য উদাহরণ। সমৃদ্ধ ইতিহাসের দেশ লেবানন নানা সময়ে নানা সভ্যতার বিচিত্র সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছে। ফলে দেশটির রান্নাবান্না ও খাদ্যভ্যাসে এসেছে বৈচিত্র্য। প্রচুর তাজা শাক-সবজি, ভেড়ার মাংস, মশলা আর অলিভ ওয়েলের সংমিশ্রণে তৈরী এই খাবারগুলো দেখলে আপনি ভোজনরসিক হোন বা না হোন আপনার জিভে জল আসবেই। বিশেষভাবে রন্ধনকৌশল অবলম্বনকারী মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশের খাবারগুলো বেশ স্বাস্থ্যকরও বটে। আজকের লেখাটি সাজানো হয়েছে লেবাননের জনপ্রিয় ও দারুণ সুস্বাদু কিছু খাবার নিয়ে।
কিবে
কিবে লেবাননের জাতীয় খাবার। 'জাতীয় খাবার' তকমা থেকে লেবাননে এর জনপ্রিয়তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। কিবে মূলত এক ধরনের মচমচে মাংসের বল। কিমা করা গরু, ভেড়া, খাসি বা উটের মাংসের সাথে দস্ফ আটা, পেঁয়াজ কুচি, পুদিনা পাতা মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই খাবারটি। সাথে ব্যবহার করা হয় দারুচিনি, জায়ফল বা লবঙ্গের মতো মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত মশলা
বেক করে বা ডুবো তেলে ভেজে রান্না করার পর এটি পরিবেশন করা হয় ঘরে তৈরী ইয়োগার্ট বা তাহিনি (এক ধরনের চাটনি) দিয়ে। তবে কিবে লেবাননের প্রধান খাদ্য হিসেবে খাওয়া হয় না, খাওয়া হয় অন্যান্য খাবারের সাথে পার্শ্বখাবার হিসেবে। স্বাদবর্ধক বা অ্যাপেটাইজার হিসেবে মূল খাবারের আগে পরিবেশনের রীতি চালু আছে মধ্যপ্রাচ্যে। কিবে এই উদ্দ্যেশ্যেও ব্যবহৃত হয়।
কোফতা
কোফতা হচ্ছে এক ধরনের গ্রিল করা কাবাব, অনেকটা আমাদের দেশের শিক কাবাবের মতো। কোফতা বানাতে লাগে গরু বা ভেড়ার মাংস এবং প্রচুর মশলা। প্রথমে চাকু বা মিট গ্রিন্ডার দিয়ে মাংসগুলো পাতলা করে কেটে নেয়া হয়, তারপর মশলায় মাখিয়ে কাঠিতে গেঁথে উচ্চতাপে গ্রিল করা হয়।
যতক্ষণ না মাংসের গোলাপি ভাব চলে যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভালভাবে গ্রিল করতে হয়, খেয়াল রাখতে হয় মাংসটা ঠিকমতো সেদ্ধ হয়েছে কিনা। রান্না শেষে ইয়োগার্ট বা সসের সাথে পরিবেশন করা হয় লোভনীয় স্বাদের কোফতা। কোফতা লেবাননের বিশেষ রুটি পিটার সাথে বা স্বাদবর্ধক হিসেবে খাওয়া হয়। অনেকে গ্রিল না করে কাঁচা কোফতাও খেয়ে থাকেন!
কানাফে
শুধু লেবাননই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে দারুণ জনপ্রিয় এই খাবারটিকে 'কুনাফে', 'কুনাফা', 'কুনাফে' প্রভৃতি নানানামে ডাকা হয়। অঞ্চলভেদে উচ্চারণের মতোই এর রান্নার ধরন, স্বাদে ও গন্ধেও থাকে ভিন্নতা। কী এই কানাফে?
কানাফে এক ধরনের পেস্ট্রি জাতীয় মিষ্টান্ন। কাদাইফ নামের বিশেষ ধরনের অতি চিকন নুডলস, পনির ও ক্রিমের মিশ্রণে তৈরি কানাফের উপর অংশটি বেশ কুড়মুড়ে। রান্নার পর এটিকে চিনির সিরাপে ডোবানো হয়। রান্নার সময় ফ্লেভারের জন্য এতে যোগ করা সামান্য পরিমাণ গোলাপ জল। তবে বাজারে যে কানাফে পাওয়া যায় তাতে খাবার রং মেশানো হয় বলে কমলা রঙের হয়ে থাকে। সাধারণ নাস্তা হিসেবে চা-কফির সাথে কিংবা উৎসবে-আনন্দে ভুরিভোজের অংশ হিসেবেও লেবাননে কানাফে খাওয়ার রীতি আছে।
ফেটুশ
ফেটুশ এক ধরনের সালাদ যা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশ পরিচিত। এটি পিটা রুটির সাথে খাওয়া হয়। মচমচে করে ভাজা পিটার টুকরো, শসা, টমেটো, পেঁয়াজ কুচি, পুদিনা পাতা, রসুন, লবণ ও কালো গোলমরিচ গুঁড়া একসাথে মিশিয়ে খুব সহজেই বানিয়ে ফেলা যায় ফেটুশ।
এতে সোমাক নামের এক ধরনের লাল মশলার টুকরাও ব্যবহৃত হয়। নানারকম সবজি ব্যবহার করা হয় বলে দেখতে যেমন রঙিন ও মোহনীয় লাগে, তেমনি খেতেও এটি দারুণ সুস্বাদু হয়। অসাধারণ স্বাদ আর গন্ধের জন্য ফেটুশকে সালাদ হিসেবে অনন্য বলতেই হবে।
হামাস
হামাস মূলত এক ধরনের ঘন সস। এটি মধ্যপ্রাচ্যে বেশ জনপ্রিয়। ছোলা বাটা, তিল বাটা, তাহিনি, অলিভ ওয়েল, লেবুর রস, রসুন ও লবণ দিয়ে তৈরী করা হয় এই বিশেষ সস।
এতে নানারকম সবজিও মেশানো হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে হামাসের বেশ সুনাম আছে। ছোলা ব্যবহারের কারণে এটি বেশ পুষ্টিকরও হয় বটে। বাজারে সহজলভ্য হলেও বাসায় এটি সহজেই তৈরি করা যায়।
মানাকেশ
আপনি যদি পিজ্জাপ্রেমী হয়ে থাকেন, তাহলে মানাকেশ আপনার ভালো লাগতেই হবে। কারণ পিজ্জারই লেবানিজ ভার্সন হচ্ছে মানাকেশ। চ্যাপ্টা রুটির উপর পনির, পেঁয়াজ, টমেটো, ও জাতার (এক ধরনের সুগন্ধী মশলা) সহ নানা বিচিত্র উপকরণ সাজিয়ে এটিকে বেক করা হয়।
তারপর স্লাইস করে কেটে বা রুটির মতো ভাঁজ করে খাওয়া হয়। সকালের নাস্তা, এমনকি দুপুরের খাবার হিসেবেও লেবাননে মানাকেশ বেশ জনপ্রিয়।
ফালাফেল
ফালাফেল এক ধরনের পিঠা যার মূল উপাদান হচ্ছে ছোলা। ফালাফেল বানানোর জন্য ছোলা পানিয়ে ভিজিয়ে রেখে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে কাই তৈরি করা হয়। তারপর এর সাথে ধনেপাতাসহ নানারকমের শাকসবজি মিশিয়ে তেলে মচমচে করে ভাজা হয়।
তিলও ব্যবহার করা হয় এতে। অনেকে বেক করে খেতেও পছন্দ করেন। লেবাননের রাস্তাঘাটের পাশের দোকানগুলোতে সবসময়ই ফালাফেল কিনতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় এর উৎপত্তি মিশরে। মিশরেও এটি খুব জনপ্রিয়। তবে এর স্বাদের বদৌলতে মিশরের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিম এশিয়াতেও।
বাকলাভা
বাকলাভা এক ধরনের মিষ্টান্ন। পাতলা ময়দার তালকে বলা হয় ফিলো। ফিলোর কয়েকটি স্তরের মধ্যে পুরে দিতে হয় বাদাম কুচি। স্তরগুলোকে পরস্পর সংযুক্ত রাখার জন্য আঠা হিসেবে ব্যবহার করতে হয় মধু বা চিনির সিরাপ। ব্যস! হয়ে গেল বাকলাভা।
এটি একই সাথে মচমচে এবং নরম স্বাদের যা মুখে পোরার সাথে সাথে আপনি হারিয়ে যাবেন অন্যভুবনে। গ্রিসকে বাকলাভার উৎপত্তিস্থল মনে করা হলেও বাকলাভার আবিষ্কারের কৃতিত্ব মূলত অটোমানদের।
শিশ তাউক
এটি মুরগীর মাংসের তৈরী কাবাব বিশেষ। এই কাবাব লেবাননের অন্যতম প্রধান খাদ্য। শিশ তাউক বানানোর আগে মুরগী মাংস লেবুর রস, রসুন, টমেটো বাটা, ইয়োগার্ট ইত্যাদি দিয়ে মেখে সারা রাত মেরিনেট করে রাখতে হয়। তারপর কাঠিতে গেঁথে গ্রিল করা হয়। শিশ তাউক নানাভাবে পরিবেশন করা যায়। কেউ স্যান্ডউইচ বানিয়ে খেতে পছন্দ করেন, আবার কেউ পিটা রুটির সাথে খান।
লেবুর রস আর রসুনের মিশ্র ফ্লেভার ও নানারকম মশলার ব্যবহার কাবাব হিসেবে শিশ তাউককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শিশ তাউক মূলত তুর্কি খাবার। লেবাননে দীর্ঘদিন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকায় লেবানিজদের খাদ্যভাসে অটোমানদের প্রভাব পড়েছে। তারই স্বাক্ষর শিশ তাউক।
স্ফিহা
এটি মুখখোলা চারকোণাকৃতি এক ধরনের মাংসের পিঠা। স্ফিহা তৈরী করার জন্য ভেড়া বা গরুর মাংসকে ছোট ছোট করে কেটে নেওয়া হয়। তারপর মাংসকে মাখানো হয় লেবুর রস, টমেটো বাটা, পেঁয়াজসহ আরো নানারকম মশলার সাথে। এরপর মেখে নেয়া ময়দার খামিরকে অনেকগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে বেলে নিয়ে তাতে দেয়া হয় মাংসের পুর। তারপর বেক করা হয়। এটি নানা আকৃতিতে বানানো যায়। এর বিশেষত্ব হচ্ছে ভিতরের মশলাদার মাংসের পুর।
আর্টিকেল পড়ে যদি আপনার খাবারগুলো খেতে ইচ্ছা করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে পারছেন না বলে মন খারাপের কিছু নেই। ইন্টারনেটে এই খাবারগুলো তৈরি করার রেসিপি দেয়া আছে। চাইলে নিজেই রান্না করে খেতে পারেন। কেমন লাগলো আমাদের জানাতে ভুলবেন না!
This is a Bangla article on popular foods of lebanese cuisine. Different foods lebanese cooking style and their specialities are disscussed in this article. All the informations are hyperlinked inside the article.
Feature Image: depositephotos.com