Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

টেস্ট অফ বাংলাদেশ: টিকে থাকুক বাংলার স্বাদ

বাংলার খাবারের ইতিহাস অনেক পুরনো। বিশেষত ভাত-মাছের কথা যদি বলি, তাহলে ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, খ্রিস্টের জন্মের দেড় হাজার বছরের বেশি আগে থেকে বাংলা অঞ্চলে ধান চাষ হতো। আর নদী-নালা-খাল-বিলের দেশ হিসেবে মাছ তো সবসময়ই খাওয়া হতো, তবে শুরুটা ঠিক কবে, তার সুনিশ্চিত ইতিহাস পাওয়া যায় না। চন্দ্রকেতুগড়ে মাছের ছবি সম্বলিত এক ফলক পাওয়া যায়, নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, যেটি চতুর্থ শতকের। আর পুরো বাংলার ইতিহাসের মধ্যে যদি শুধু আমাদের বাংলাদেশের কথাই বলি, তাহলেও ঐতিহ্যবাহী খাবারের পরিমাণ কিন্তু কম নয়। প্রাত্যহিক খাবার তো আছেই, সেই সাথে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে বিশেষ রান্না, কিংবা ঋতুভিত্তিক পালা-পার্বণের পিঠাপুলি- লিস্টি করতে গেলে আস্ত একটা বই লিখে ফেলা যায়।

তবে এই দৃশ্যগুলো কিন্তু এখন বদলে যাচ্ছে। আমাদের শহরগুলোতে সবার প্রিয় খাবারের তালিকায় থাই-চাইনিজ, ফাস্টফুড, পিজা-বার্গার অথবা ফ্রাইড চিকেনের জয়জয়কার এখন চোখে পড়ার মতো। পেছনের কারণ হিসেবে দেখানো যায় সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, রুচি-চাহিদার পরিবর্তন, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা, অথবা নিছকই সময়ের অভাবে তাড়াহুড়োর অভ্যাসকে। পরিবর্তনের সাথেই যে প্রশ্নটা উঠে আসে, তাও সবারই জানা- দেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো কি তবে হারিয়ে যাবে একটা সময়ে? এই প্রসঙ্গে আজকের লেখাটা হোক বাংলাদেশের কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার, বিশেষত রান্না নিয়ে। বলাই বাহুল্য, অনেক খাবারই বাদ পড়বে, কিন্তু পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটাতে তা না করেও উপায় নেই।

ঢাকাই খাবার বলতেই প্রথমেই মাথায় আসে একটি শব্দ- বিরিয়ানি; Image Source: Jugantor

মাছ দিয়ে শুরু করা যাক। মাছের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ইলিশ দিয়ে রান্না হয় হরেক রকমের পদ। মশলা মাখিয়ে তেলে ভেজে ইলিশ ভাজা, কাঁচা মরিচ আর সরিষা দিয়ে সর্ষে ইলিশ, তরকারি, পেয়াঁজ-মরিচ দিয়ে ইলিশ ভুনা, কিংবা কলাপাতায় মুড়িয়ে ভাপা ইলিশ- কী নেই! সাথে রুই-কাতল দিয়ে কোপ্তা, মাছের মাথা আর মুগডাল দিয়ে মুড়িঘণ্ট, ছোট মাছের চচ্চড়ি, চিতল মাছের ঝোল অথবা পথ্য হিসেবে জিওল মাছের (শিং, শোল, টাকি) তরকারি বা ভর্তা- মোটকথা মাছ দিয়ে পদের কোনো অভাব এই দেশে নেই।

ইলিশ দিয়ে রান্না হয় হরেক রকমের পদ © samitacuriouscook

ঢাকাই খাবার বলতেই প্রথমেই মাথায় আসে একটি শব্দ- বিরিয়ানি। পুরান ঢাকার এই ‘ডেলিকেসি’কে তো বিশ্ব খাদ্য ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসেবে ইউনিসেফের ঘোষণা দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন বিখ্যাত খাদ্য বিশেষজ্ঞ, মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়ার সঞ্চালক ম্যাট পিটারসন। মূলত দুই ধরনের বিরিয়ানি দেখা যায় ঢাকার রান্নাতে- কাচ্চি আর পাক্কি। খাসির মাংস আর আলুতে মশলা, দই আর দুধ মেখে ডেকচিতে মশলা মাখা মাংস আর পোলাওয়ের চাল স্তরে স্তরে দিয়ে রান্না করা হয় কাচ্চি। গরুর মাংস দিয়েও কাচ্চি রান্না হয়।

পাক্কি রান্নার ধরনটা একটু আলাদা, মাংসটা আগেই রান্না করে তারপর চালের সাথে দিয়ে আবার রান্না করা হয়। মাংস হিসেবে মুরগীই মূলত দেওয়া হয় পাক্কিতে। তবে পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ির নান্না বিরিয়ানিতে চিকেন কাচ্চিও পাওয়া যায়। পোলাওয়ের চালের জন্য বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই দিনাজপুরের ‘কালিজিরা’ চালের ব্যবহার তো আছেই, সাথে ভারতীয় বা পাকিস্তানি রান্নার আদলে বাসমতী চালও চলে বিরিয়ানি রান্নায়।

বিরিয়ানির কথা যেহেতু উঠলো, ছোট্ট করে তেহারির কথাও বলে যাই। গরু বা খাসী, দুই দিয়েই তেহারি রান্না করা যায়, তবে মাংসের ধরনের কারণে গরুই বেশি চলে। মাংসের টুকরোগুলো কাচ্চির মতো বড় হয় না, বরং ছোট ছোট করে কাটা হয়। অনেক জায়গায় রান্নার তেল হিসেবে সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়, ফলে তেহারিতে আসে আলাদা একটা ঝাঁজ। 

মাংসের ধরনের কারণে তেহারিতে গরুই বেশি চলে © Fiaz Fahim Khan

সিলেটের রান্নাবান্নার কথা বললে সাতকরা (সিলেটিতে ‘হাতকরা’) আসবেই। লেবুর মতো এই ফলের ব্যবহার সিলেট অঞ্চলে বলা চলে রান্নার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। টক-মিষ্টি স্বাদ, সাথে দারুণ ঘ্রাণের এই ফল বিশেষ রেসিপি অনুযায়ী গরুর মাংস রান্নায় দিলে যে স্বাদ আসে, তা এক কথায় অতুলনীয়। শুধু মাংসই নয়, বড় মাছের সাথেও সমানভাবে চলে হাতকরা। শুকনো বা কাঁচা, দুই অবস্থাতেই তরকারিতে দেওয়া চলে এই ফল।

সিলেটের অনেকের কাছে সকালের নাস্তায় কিংবা রমজান মাসে ইফতারে পাতলা খিচুড়ির উপর কোনো খাবার হয়ই না। আর খিচুড়ি যখন আসলই, নাগা মরিচের আচার তো থাকবেই। প্রচণ্ড ঝাল হলেও গন্ধ আর স্বাদে তুলনাই হয় না এই আচারের।

সিলেটের অনেকের কাছে সকালের নাস্তায় কিংবা রমজান মাসে ইফতারে পাতলা খিচুড়ির উপর কোনো খাবার হয়ই না © Trissa Huq

উত্তর থেকে এবার সোজা দক্ষিণাঞ্চলে চলে আসি। সিলেটে যেমন সাতকরা, যশোর-খুলনা-সাতক্ষীরায় তেমনি আছে চুইঝাল। এই অঞ্চলগুলোতে খাসির মাংস রান্নাই হয় না চুই ছাড়া। পানগাছের মতো দেখতে এই লতাজাতীয় গাছ চুইয়ের কাণ্ড বা লতা দুইই রান্নায় দেওয়া যায়। চুই ব্যবহারে আলাদা একটা ঝাল আসে স্বাদে, যার ঝাঁজটা গতানুগতিক ঝাঁজের মতো স্থায়ী হয় না।

চিংড়ির মালাইকারীর স্বাদ হয়তো ঘরে বসেই নেওয়া সম্ভব রান্নার বই বা ইন্টারনেটে পাওয়া রেসিপির কল্যাণে, কিন্তু বরিশাল-সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে না এলে নারকেলের দুধ আর চিংড়ির এই রান্নার প্রকৃত স্বাদ পাওয়াটা আসলে অসম্ভব। আর মশলামাখানো চিংড়ি নারকেলে ঢুকিয়ে জ্বলন্ত চুলায় রান্না করা ‘নারকেলের পেটে চিংড়ি’ বরিশালের বিখ্যাত খাবার, যা বরিশাল ছাড়া দেশের অন্য জায়গায় পাওয়াই যায় না বললেই চলে।

এদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের পরিমাণ কিন্তু কম নয়! © Farjana’s Recipe

চল্লিশা, আকিকা, বৌভাত কিংবা আরও নানান অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের খাবারের মেন্যুর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ মেজবানের মাংস। একজন অভিজ্ঞ ও দক্ষ বাবুর্চি পান চিবুতে চিবুতে গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে রান্না করবেন বিশাল সব হাড়িতে, রসনা তৃপ্তি ঘটবে হাজারও মানুষের- এমন চিরচেনা দৃশ্যে পুরো আয়োজনটাই একটা উৎসবের মতো। আর স্বাদ? সাদা ভাতের উপর একজন লাল ঝোলের ঝাল মেজবানি মাংস তুলে দিচ্ছেন, আরেক দিক থেকে আরেকজন তুলে দিচ্ছে বুটের ডাল দিয়ে রান্না করা গরুর পায়ার ঝোল- অতুলনীয়, অসাধারণ, অবিশ্বাস্য সেই অভিজ্ঞতা। সাথে যদি থাকে আরেক ঐতিহ্যবাহী খাবার কালাভুনা কিংবা মাংসের ঝুরি! সেসবের তুলনা কি আদৌ আছে কিছু! গরুর বা খাসীর মাংসকে লোহার কড়াইয়ে জ্বাল দিয়ে দিয়ে ঝুরঝুরে করে রান্না করা কালচে মাংসের ঝুরি রুটি আর পরোটার সাথে খাওয়া হয় কোরবানির ঈদের কয়েকদিন পর।

শেষ করি পাহাড়ি খাবার দিয়ে। বনমোরগের মাংসে মশলা মাখিয়ে বাঁশের ভেতর পুরে সোজা আগুনের উপর দিয়ে রান্না যার পাহাড়ি নাম চুমাত কুরা হেরা, কিংবা কচি তেতুল পাতা দিয়ে মুরগীর স্যুপ- জিভে জল চলে আসার মতোই সব খাবার। আর হরেক রকমের শুটকি দিয়ে ভর্তা তো আছেই, সাথে কচি আমপাতা ভর্তা, আস্ত কলাগাছ ভর্তাও আছে ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি খাবারের তালিকায়।

এর পাহাড়ি নাম চুমাত কুরা হেরা © Peda Ting Ting

অনেক খাবারের কথাই বাদ গেছে। সত্যি বলতে কী, শত পাতা লেখা হয়ে যাবে শুরু করলে, কারণ, এদেশের প্রতিটি অঞ্চলই কোনাে না কোনাে খাবারের জন্য বিখ্যাত। এই জনপ্রিয় আঞ্চলিক খাবারগুলাের সাথে বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে এসিআই পিওর ফুডস্ আয়ােজন করতে যাচ্ছে ‘Taste of Bangladesh’ ক্যাম্পেইন। পাঠক, আপনার অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার কোনটি এবং কেন তা এত বিখ্যাত, জানিয়ে দিন আমাদেরকে, চোখ রাখুন এসিআই পিওর ফুডস্-এর পেইজে। আপনাদের পাঠানাে খাবারগুলাের নাম থেকে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারটির মিক্সড্ মশলা তৈরি করবে এসিআই পিওর ফুডস্। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই আঞ্চলিক খাবারটির স্বাদ নিতে পারবে দেশের সবাই, সেইসাথে এই আঞ্চলিক খাবারগুলাে রয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আর আপনাদের মধ্য থেকে বাছাইকৃত সেরা ১০ জনকে এসিআই পিওর ফুডস্-এর পক্ষ থেকে দেওয়া হবে আকর্ষণীয় গিফট হ্যাম্পার!

এসিআইয়ের সাথে সাথে এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরও। ইন্টারনেটের যুগে ফুড ভ্লগিং হতে পারে বেশ ভালো একটি মাধ্যম৷ দেশে অনেকেই এখন পেশাদারভাবেই ফুড ভ্লগ তৈরি করছেন, তারা চাইলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আঞ্চলিক খাবারগুলোর ইতিহাস, উপাদান, রান্নার কৌশলগুলোকে ক্যামেরায় ধরে রাখতে পারেন। ব্লগ লেখা হতে পারে আরেকটি দারুণ মাধ্যম, বিশেষ করে রেসিপিগুলো বাইরের দেশগুলোতেও ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে ব্লগের মাধ্যমে। এছাড়াও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে রিভিউ কিংবা রেসিপি শেয়ারের মাধ্যমেও ধরে রাখা যেতে পারে খাবারের ইতিহাস, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটা বিরাট অংশ যেহেতু ফেসবুক ব্যবহার করে। ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর উপর পত্রিকায় ফিচার ছাপানো বা টিভির জন্য ডকুমেন্টারি/প্রামাণ্যচিত্র তৈরিও হতে পারে আরেকটি ভালো উপায়। মোদ্দা কথা, আমাদের হাতে মাধ্যম আছে অনেকগুলোই, সেটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। দরকার শুধু নিজেদের ইচ্ছা আর প্রচেষ্টার, যা হয়তো শতবছর পরেও ধরে রাখবে আবহমানকালের বাঙালি খাবারদাবারের ঐতিহ্যকে। 

Related Articles