Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আতাকামা মরুভূমি: বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এক ধূসর মরু অঞ্চল

মরুভূমি শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে খুব শুষ্ক, ঝড়-বৃষ্টিহীন আর চারিদিকে ধু ধু বালিতে ঢাকা একটি বিস্তৃত অঞ্চল। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর স্থলভাগের প্রায় তিনভাগের এক ভাগ হলো মরুভূমি। ভৌগোলিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সাধারণত চার ধরনের মরুভূমি দেখতে পাওয়া যায়। এগুলো হলো, মেরু-অঞ্চলীয় মরুভূমি, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মরুভূমি, শীতপ্রধান মরুভূমি এবং শীত উপকূলবর্তী মরুভূমি।

আতাকামা মরুভূমি; Source: quasarex.com

দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের দেশ চিলি। চিলিতে অবস্থিত আতাকামা মরুভূমি হলো পৃথিবীর শীত উপকূলবর্তী মরুভূমিসমূহের একটি। এর একপাশে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগর ও অন্য সবদিক ঘিরে রেখেছে পেরু, বলিভিয়া ও আর্জেন্টিনা।

মানচিত্রে আতাকামা মরুভূমি; Source: saylordotorg.github.io

এই মরুভূমির পশ্চিমে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় পর্বতমালা, যার নাম কর্দিলেরা দে লা কোস্তা এবং পূর্বে রয়েছে আন্দেস বা আন্দিজ পর্বতমালা। এই পর্বতমালা মরুভূমির দু’পাশ হতে ভেসে আসা বায়ুপ্রবাহ এবং তার সাথে আসা মেঘ আটকে রাখে। ফলে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।

আতাকামা মরুভূমির মূল আয়তন এক লক্ষ পাঁচ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এই মরুভূমির অধিকাংশ জায়গাই পাথুরে ভূমি, ধুসর বালি, লবণ হ্রদ এবং ফেলসিক লাভা দিয়ে ঢাকা। এখানকার বৃষ্টিপাতের ইতিহাস বেশ করুণ। ধারণা করা হয়, ১৫৭০ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে তেমন কোনো বৃষ্টি হয়নি। এই অঞ্চলের গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রতি বছরে প্রায় ১ মিলিমিটার। তবে মরুভূমির মধ্যে এমন কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে কখনো বৃষ্টিপাত হয় না। আবার কিছু স্থানে, যেমন, আরিকা এবং ইকুইকে, এক বছরে ১ থেকে ৩ মি.মি পর্যন্ত বৃষ্টি হয়ে থাকে।

গ্রীষ্মের দাবদাহে আতাকামা মরুভূমি; Source: engagingexploration.wordpress.com

তবে এই অনাবৃষ্টির মাঝেও মরুভূমিটির প্রাকৃতিক কিছু ক্ষমতা রয়েছে। এর বালির নিচে জমা থাকে হাজার হাজার ফুলের বীজ। যখন বৃষ্টি হয়, তখন পানি মরুভূমির বালির নিচ অবধি চলে যায়। বৃষ্টির পানি পেয়ে বালির নিচে সুপ্ত বীজগুলোর মধ্যে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। ধীরে ধীরে শেকড় ও পাতা গজিয়ে বড় হতে থাকে এই গাছ। অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় বেশ দ্রুতই বড় হয় এ গাছগুলো। বালির নিচে পানি জমে থাকে বলে এদের বেড়ে উঠতে তেমন সমস্যা হয় না। ধীরে ধীরে গাছে হলুদ, সাদা, গোলাপী, লাল বিভিন্ন রঙের ফুল ফুটতে থাকে। ফুল গাছগুলো বড় হয়ে উঠলে এক সময় গোলাপী ফুলে ঢাকা গালিচার রূপ ধারণ করে অঞ্চলটি।

দুই-চার বছরে একবার বৃষ্টির মুখ দেখে এই মরুভূমি। মে মাসের দিকে বৃষ্টি হয় আর সেপ্টেম্বর-নভেম্বরের দিকে মরুভূমির মাঝে ফুলের দেখা মিলে। স্থানীয়রা তাই অনেকে একে ‘ফুলের মরুভূমি’ বলেও ডেকে থাকে। সাধারণত পাঁচ-সাত বছর পর পর প্রাকৃতিকভাবে এ ধরনের ফুলের বাগানের দেখা মেলে।

ধু ধু মরুভূমি ফুলের সমারোহে ভরে ওঠে; Source: telegraph.co.uk

২০১৫ সালে এই মরুভূমিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল। সে বছর প্রচুর ফুল ফোটে এখানে। পুরো বিশ্ব অবাক হয়ে দেখে প্রকৃতির এই আজব খেয়াল। ধু ধু মরুভূমির মাঝে বিভিন্ন রঙের ফুলের সমারোহকে খবরের কাগজে বলা হয়েছিল ‘সুপার ব্লুম’।

আতাকামা মরুভূমিতে সুপার ব্লুম; Source: travelandleisure.com

তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০১৭ সালের চলতি মাসে আবার গোলাপী রঙে ছেয়ে গেছে আতাকামা মরুভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল। দু’বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার ফুল ফোটায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফির খবরে এমন ঘটনাকে ‘ডাবল ব্লুমিং’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। ২০১৭ সালের মে মাসের দিকে অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির ফলেই এমনটা হয়েছে বলে ধারণা করছেন প্রকৃতিবিদেরা।

আতাকামা মরুভূমির ফুলের সমারোহে দুই শিশু; Source: inhabitat.com

দুইশ’রও বেশি প্রজাতির গাছপালা রয়েছে এই মরুভূমিতে। তবে পেরানিয়েল প্রজাতির ফুলই সবচাইতে বেশি দেখা যায় এখানে। ফুলগাছগুলো খুব বেশি দিন বাঁচে না বললেই চলে। এমন রুক্ষ পরিবেশে যেকোনো উদ্ভিদেরই বেঁচে থাকা বেশ কষ্টসাধ্য। আকস্মিক ও খণ্ডকালীন এই ফুলের গাছ ছাড়া আতাকামা মরুভূমিতে আর কোনো প্রকার বৃক্ষের খোঁজ পাওয়া যায় না।

এ বছর ৬০০ মাইলেরও বেশি এলাকাজুড়ে ফুল ফুটেছে আতাকামা মরুভূমিতে। ফুলের গাছগুলোর প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে পর্যটকদের। তাই ফুলের পাশাপাশি চিলির এই মরুভূমিতে জমছে বহু পর্যটকের ভিড়। এই ফুল অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ফুটবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নভেম্বরের পর থেকে কমতে থাকবে ফুলের সংখ্যা।

চিলির তামার খনি; Source: 911metallurgist.com

অনাবৃষ্টি, অনুর্বরতা ও অবাসযোগ্য এই মরুভূমিতে ছড়িয়ে আছে প্রচুর পরিমাণ খনিজ সম্পদ। এখানে প্রচুর পরিমাণ সোডিয়াম নাইট্রেট ও তামা পাওয়া যায়। সার ও বারুদ তৈরিতে সোডিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করা হয়। এই মরুভূমির চারপাশ ঘিরে রেখেছে বলিভিয়া, পেরু ও চিলি। উনিশ শতকের শেষ দিকে এসে এখানকার খনিজ সম্পদের দাবিতে তিনটি দেশের মাঝে বিবাদের শুরু হয়। ফলে ১৮৭৯ সাল থেকে ১৮৮৩ সাল পর্যন্ত তিনটি দেশের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ চলে, যা প্রশান্ত মহাসাগরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। মরুভূমির অধিকাংশ এলাকা বলিভিয়া ও পেরুর অধীনে থাকা সত্ত্বেও চিলির যুদ্ধ কৌশল এবং সামরিক শক্তির কাছে দু’দেশই পরাজিত হয়। ফলশ্রুতিতে চিলি মরুভূমির অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়, অন্যদিকে বলিভিয়া তার সমগ্র পশ্চিম সমুদ্র উপকূল হারিয়ে বসে।

আতাকামা মরুভূমিতে নাসার পরীক্ষা-নিরীক্ষা; Source: sservi.nasa.gov

বিজ্ঞানীদের মতে, এই মরুভূমির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং আবহাওয়া, যা কিনা মঙ্গল গ্রহের পরিবেশের সাথে অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে এই মরুভূমির প্রতি ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে নাসার। মঙ্গল গ্রহে কোনো মিশনের আগে সেখানে ব্যবহারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নাসা এখানে পরীক্ষামূলক ব্যবহার করে, যন্ত্রপাতিগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য। হলিউডের অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্রের শুটিংও হয় এই মরুভূমিতে।

আতাকামা মরুভূমি হতে উদ্ধারকৃত মমি; Source: classicalarchives.coml

চিলির আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এখানকার মমির বয়স খ্রিস্টপূর্ব ৭,০২০; যেখানে মিশরের মমি ৩,০০০ খ্রিস্টপূর্বের। বিশেষজ্ঞদের মতে, একমাত্র চরম আর্দ্রতার কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।

বরফে ঢাকা আতাকামা মরুভূমির পর্বতশৃংগ; Source: kuoni.co.uk

এই মরুভূমির আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার প্রাকৃতিক অবস্থার তারতম্য। গ্রীষ্মকালে এখানে গরম ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হয়ে থাকে, যা রাতের বেলা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। অন্যদিকে এখানকার পর্বতগুলো ঢেকে থাকে শুভ্র বরফে। এমনটা হওয়ার মূল কারণ হলো এখানকার পাহাড়গুলোর উচ্চতা। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে অনেকটাই উপরে অবস্থিত বলে এই পাহাড়গুলোতে তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়ে না।

আতাকামা মরুভূমির বুকে রেডিও টেলিস্কোপ; Source: alma.asiaa.sinica.edu

আতাকামা মরুভূমি পৃথিবীতে কয়েকটি স্থানের মধ্যে একটি, যেখানে বছরের অধিকাংশ দিনই মেঘমুক্ত পরিস্কার আকাশ দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীতে সম্ভবত আকাশ নিরীক্ষণের জন্য সেরা স্থানের মধ্যে এটি অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে এই মরুভূমিতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ টেলিস্কোপ ‘আলমা’ স্থাপন করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এখানে ৬৬টি রেডিও টেলিস্কোপ রয়েছে, যা থেকে প্রাপ্ত ছবির সাহায্যে নক্ষত্রের গঠন নিয়ে গবেষণা করা হয়।

হ্যান্ড অফ ডেজার্ট ভাস্কর্য; source: goodfreephotos.com

এই মরুভূমির আরেক অনন্য নিদর্শন হলো ‘হ্যান্ড অফ ডেজার্ট‘। চিলির প্রখ্যাত ভাস্করশিল্পী মারিও ইররাজাবালার তৈরি এই ভাস্কর্য দেখতে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসেন। সবকিছু মিলিয়ে, আতাকামা মরুভূমিটি অনেক প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং বিস্ময়ে ভরপুর। এই মরুভূমিকে কেন্দ্র করে তাই পৃথিবীর মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।

ফিচার ইমেজ- hittheroad.live

Related Articles