Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বরিশাল গানস: যে শব্দের উৎস আজও রহস্যাবৃত

“দ্যাখো এই বর্ষাকাল,
গাঁ-গেরামে ফুঁসে ওঠে নদী
হাঁসেরা নেমেছে জলে আমাকে বিভোর করো যদি,
কীর্তনখোলার বুকে উঠিয়াছে পূর্ণিমার চাঁদ
সেখানে পরাণসখা-তুমি আমি দুজনে বিবাদ

(কবি মহাদেব সাহার ‘এই যে বর্ষার নদী’ কবিতার অংশবিশেষ)

এমনই এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলায় উন্মত্ত এই কীর্তনখোলা নদী। এর নামের মতোই যেন উজাড় করে দেয়া তার চারপাশ। এই নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা শহর বরিশালকে বলা হয় প্রাচ্যের ভেনিস। কোনো এক বর্ষণমুখর রাতে পূর্ণিমার আলোয় মোহিত বাংলাদেশের দক্ষিণের এই মনোমুগ্ধকর দ্বীপটি হয়তো কোনো এক কবির চোখে ‘চন্দ্রদ্বীপ’ হয়ে ধরা দিয়েছিল, যা পরবর্তীতে নামের পরিবর্তনে হয়ে ওঠে বরিশাল।

মানচিত্রে বরিশাল। ছবিসূত্র: newsbijoy.com

এই দ্বীপের বুকেই জন্ম নেন এক বিপ্লবী কিন্তু রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ মানসকবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। কিছু না পাওয়ার এই কবিকে সব উজাড় করে দিয়েছিল যে নদী, তার স্মৃতিচারণে তিনি উল্লেখ করেন-

“এই সৌরমন্ডলের
এই পৃথিবীর এক কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে
যে-শিশুর জন্ম।
দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন
যে-কিশোরের।
জোৎস্না যাকে প্লাবিত করে।
বনভূমি যাকে দুর্বিনীত করে।
নদীর জোয়ার যাকে ডাকে নেশার ডাকের মতো।

(রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘ইশতেহার’ কবিতার মধ্যমভাগের কিছু পঙক্তি)

কীর্তনখোলা নদী। ছবিসূত্র: অঙ্কন ঘোষ দস্তিদার

কীর্তনখোলা আর বরিশাল নিয়ে এতো আলোচনা করা হলেও আজকের প্রসঙ্গটা একটু ভিন্ন। যদিও এই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেই চিরচেনা বরিশাল। তাই মূল ঘটনার পূর্বে সামান্য প্রস্তাবনা হয়তো কারও বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবে না।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। বাংলাদেশ নামটার অস্তিত্ব তখন ছিল না, সেটা বলাই বাহুল্য। পুরো ভারতবর্ষে তখন ইংরেজদের আধিপত্য। সালের হিসেবে সেটি ১৮৭০ সালের আশেপাশে। শীতের আমেজ প্রায় জেঁকে বসেছে সবদিকে। হালকা ফিনফিনে হাওয়ায় তাই বাড়ির বাইরে খুব বেশি লোকের ভিড় নেই। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নেয়া হয়ে গেছে। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। অনেকের চোখেই তখন ঘুম ঘুম ভাব। প্রতিটি ঘরের আলোও একে একে নিভে আসছে। এমনই সময় চারপাশ সচকিত করা এক বিকট শব্দ। তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল বরিশাল এলাকার অনেক মানুষের। সাড়া পড়ে গেল চারিদিকে। সকলের মনে একটাই প্রশ্ন, গগনবিদারী এই আওয়াজ কীসের? ভয় এবং চমকের অভিব্যক্তিতে সকলের চোখ যেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উদগ্রীব। আর বরিশালের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘটা এই বিকট শব্দগুলোর নামই হলো ‘বরিশাল গানস’ বা ‘গানস অব বরিশাল‘, যা আজকের আলোচনার মূল বিষয়। 

মানচিত্রে বরিশাল। ছবিসূত্র: globalsecurity.org

ইতিহাসবিদ সিরাজউদ্দিন আহমেদের মতে, একজন ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট, যার নাম হেনরি বেভারিজ, তিনিই সর্বপ্রথম ‘গানস অব বরিশাল’ নামটি ব্যবহার করেন। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত তার লেখা বই ‘ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ‘-এ এই শব্দের ব্যাপারে উল্লেখ রয়েছে। এই লেখা থেকে জানা যায়, ফ্রেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসে বরিশাল থেকে দক্ষিণ কিংবা দক্ষিণ পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ শোনা যায়, যা অনেকটা কামান ফাটানোর শব্দ বলে মনে হয়। স্থানীয়রা এই শব্দকে ‘বরিশাল কামান’ বলে ডাকতে থাকে। আর তাই তিনিও তার লেখায় এর আওয়াজের নাম দিলেন ‘গানস অব বরিশাল’। কখনো কখনো একটা শব্দ শোনা যেত, আবার কখনো দুই বা তিনটি শব্দ একসাথে শোনা যেত। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, শব্দটা যে আসলে কী এবং এর উৎসটাই বা কী, তা কিন্তু আজও সকলের কাছে অজানা।

গানস অব বরিশাল। ছবিসূত্র: globalsecurity.org

এই শব্দ-রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা সেই ব্রিটিশদের সময় থেকে শুরু হয়। ইংরেজদের প্রাথমিক ধারণা ছিল, হয়তো ডাচ কিংবা পর্তুগিজ জলদস্যুরাই বরিশালে কোনো গোপন ঘাঁটি করে ভয় দেখানোর জন্য এই আওয়াজ করছে। কারণ মোঘল যুগে বরিশাল-পটুয়াখালী অঞ্চলে পর্তুগীজ এবং ডাচ জলদস্যুদের বেশ তাণ্ডব ছিল। অনেকের ধারণা, পর্তুগিজ জলদস্যুরা একটা খাল খনন করে সাগর থেকে নদীতে আসার জন্য। আর এই খালটি পরবর্তীতে পটুয়াখালী নামে পরিচিতি লাভ করে। তাই ইংরেজদের এমন ধারণা বেশ প্রখর হয়ে ওঠে। শুরু হয়ে যায় খোঁজাখুঁজি। তন্যতন্য করে খোঁজার পরেও কোনো জলদস্যু জাহাজ বা ঘাঁটির খোঁজ বের করতে পারেনি ইংরেজ সৈন্যরা।

পরে ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরের গভীরে হয়তো কোনো আগ্নেয়গিরি রয়েছে। ওই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের শব্দ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয় এটিকে। কিন্তু সম্ভাব্য সব অনুসন্ধানেও এমন কোনো নজির পায়নি ব্রিটিশরা। আরেক দলের যুক্তিতে, সাগরে হয়তো কোনো গ্যাসক্ষেত্র আছে যেটি মৃত। শব্দটা ঐ মৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকেই আসছে। ব্রিটিশরা সাগরে উপকূল ঘেঁষে অনেক সন্ধান করে কিন্তু কোনো সমাধানে আসতে পারেনি।

বরিশাল গানস। ছবিসূত্র: topfivebuzz.com

এরপর ধারণা করা হয়, সাগর তীরে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে শব্দটা হয়েছে। কিন্তু এমন যুক্তির পক্ষে এখনও পর্যন্ত কোনো জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আরেকটি ধারণা অনুযায়ী কুয়াকাটা, কলাপাড়া ও মঠবাড়িয়া- এই তিন এলাকা সাগরের একটা জায়গায় এসে মিশেছে। জোয়ারের সময় প্রবল ঢেউয়ের কারণে এরকম শব্দ হতো বলেও মনে করা হয়। এখন ঐ এলাকায় সাগরের উচ্চতা কম। পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে অনেকটা জায়গা। সে কারণে আগের মতো আর শব্দ পাওয়া যায় না।

তবে বিশেষজ্ঞদের মতে এ ধরণের় শব্দগুলোকে একত্রে ‘মিস্টপুফার্স’ বা ‘স্কাই কোয়াক’ বলা হয়। বরিশালের মতো ভারতের গঙ্গা নদীর তীর, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, স্কটল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর সাগরসহ আরও কিছু এলাকায় এ ধরনের শব্দ শোনা গিয়েছে বলে নথিবদ্ধ রয়েছে।

১৮৮৬ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, হরিশপুর প্রভৃতি স্থানেও বরিশাল গানসের মতো শব্দ শোনা গিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ১৮৯০ সালের ‘ব্রিটিশ এসোসিয়েশন অব এডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স’-এর বার্ষিক অধিবেশনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বরিশাল গানস কেবল গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ নয়, ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপেও শোনা গেছে।

এই বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামাবাড়িতে জন্ম নেন বাঙালি নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ কবি ও সাহিত্যিক বেগম সুফিয়া কামাল। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার আত্নজীবনীমূলক রচনা ‘একালে আমাদের কাল’-এ বরিশাল গানসের কথা উল্লেখ আছে। তার মতে শৈশবে এই ধরনের রহস্যময় বিস্ফোরণের আওয়াজের কথা তিনি তার মামা এবং বয়স্কদের কাছে শুনেছেন। তবে তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, ১৯৫০ সালের পরে আর কেউ এই শব্দ শুনেছেন বলে তিনি শোনেননি।

কবি সুফিয়া কামাল। ছবিসূত্র: jjdin.com

অনেকেই হয়তো জানেন না যে, যুক্তরাষ্ট্রে ‘দি গানস অব বরিশাল’ নামে একটি ইন্সট্রুমেন্টাল ব্যান্ড দল রয়েছে। ২০০১ সালে ‘রেডক্যাপ’ নামক ব্যান্ডটি ভেঙে ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের সিয়াটলে এই ব্যান্ডটি নতুন করে গড়ে ওঠে এই নতুন নামে। তাদের ওয়েবসাইটে এই নামকরণের পেছনের ইতিহাস হিসেবে বঙ্গোপসাগর হতে উদ্ভূত এই শব্দের কথাই বলা হয়েছে।

ব্যান্ড ‘দ্য গানস অফ বরিশাল’। ছবিসূত্র: metal-archives.com

তবে সর্বশেষ আলোকপাতে এটিই বলতে হয় যে, বরিশাল কামানের শব্দের উৎপত্তির রহস্য জানতে অনেক চেষ্টা করা হলেও এর কার্যকরী কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। তাই অমীমাংসিত রহস্য হিসেবে আজও সকলের কাছে অচেনা এই ‘গানস অব বরিশাল’ বা ‘বরিশাল কামান’।

ফিচার ছবিসূত্র: doubtfulnews.com

Related Articles