Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বান নাপিয়া গ্রাম: বোমার সাথে জীবনের বসতি

সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ পেরিয়ে দূরে রয়েছে পাহাড়ের সারি, আশেপাশেই কুঁড়েঘর জাতীয় কিছু ঘরবাড়ি। প্রত্যেক বাড়ির সামনেই রয়েছে টবে লাগানো ছোট গাছপালা। পাহাড়গুলোর ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়া রোদে টবের ছোট গাছগুলো স্বাভাবিকের থেকেও যেন আরো সবুজ দেখাচ্ছে। মনোরম এই নৈসর্গিক দৃশ্যের মাঝে হঠাৎ করেই হোঁচট খেতে হবে ‘টব’ এর দিকে ভালো করে দেখলে। কারণ এটি তো কোনো যে-সে টব না, এটা তো একটা বোমার খোলস! যেটা কিনা জোড়াতালি দিয়ে এখন টব বানানো হয়েছে!

বোমার খোলসের উপর লাগানো হয়েছে গাছের চারা; source: Mark Watson

এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ লাওসে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘গোপন যুদ্ধের’ ফলাফল হিসেবে, যার জন্য হতভাগ্য লাওসবাসীদের চল্লিশ বছর পরেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। লাওসের এই গ্রামের বাসিন্দাদের বোমার সাথে দৈনন্দিন আর পাঁচটা জিনিসের মতো সম্পর্ক। যুদ্ধ শেষ হওয়ার চল্লিশ বছর পরে এখনো বোমা বিস্ফোরণের ঝুঁকি নিয়ে মাঠেঘাটে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হয় তাদের।

ক্যাফের বাইরের ডেকোরেশনেই শুধু না, ভেতরে টেবিলের অ্যাশট্রেটাও হয়তো বোমার খোলসে তৈরি; source: Michael Craig

গোপন যুদ্ধ বলার কারণ হচ্ছে, তৎকালীন আমেরিকা সহ বিশ্বের কেউই লাওসের যুদ্ধাবস্থা সম্পর্কে জানত না। সবাই শুধু ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছে এমনটাই জানত। ভিয়েতনাম যুদ্ধে কমিউনিস্ট গেরিলাদের সামরিক রসদের যোগান আসত লাওসের ভেতরকার ‘হো চি মিন ট্রেইল’ নামক রাস্তা দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র এই রসদ সরবরাহের রাস্তা বন্ধ করতে লাওসে ব্যাপক বোমাবর্ষণ শুরু করে, যার মোট পরিমাণ ছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মোট বোমার থেকেও বেশি।

উদ্ধারের পর জমা করে রাখা ক্লাস্টার বোমার স্তূপ; source: reader

১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় লাওসে মোট পাঁচ লাখ আশি হাজার টন বোমা ফেলেছিলো মার্কিন বাহিনী। গাণিতিক হিসেবে গড় করলে দাঁড়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি ৮ মিনিটে বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে এবং সেটা চলেছিলো টানা ৯ বছর ধরে। লাওস এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বোমাবর্ষণের শিকার দেশ।

সমস্যার এখানেই শেষ নয়, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়েনি হতভাগ্য লাওসবাসীদের। পাইকারি হারে নিক্ষেপ করা ক্লাস্টার বোমাগুলোর (গুচ্ছবোমা) মধ্যে লাখ লাখ বোমা অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে যায়, যেগুলো এখন দুর্ঘটনাক্রমে বিস্ফোরিত হয়ে মানুষের প্রাণহানি-অঙ্গহানির কারণ হচ্ছে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী নিষিদ্ধ হলেও, যুক্তরাষ্ট্র এই নিষেধাজ্ঞায় সাক্ষর করেনি। ফলে লাগামহীনভাবে লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় ফেলা হয় এসব বোমা।

বাড়ির পাশে দুই-একটা বোমা পড়ে থাকাই এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার; source: Mark Watson

ক্লাস্টার বোমার উদ্দেশ্যই হলো অনেকটা তৎক্ষণিক ক্ষতির পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদের ক্ষতি সাধন করা। এই বোমায় একটি বড় আকারের মূল বোম শেলের ভেতরে ছোট ছোট শ’খানেক ক্ষুদ্র আকৃতির বোমা থাকে। বিমান থেকে নিক্ষেপের পরে বিস্ফোরণের সাথে সাথে ক্ষুদ্র বোমাগুলো বিশাল ব্যাসার্ধের একটি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিছু বিস্ফোরিত হয়ে তাৎক্ষণিক প্রাণহানী ঘটায়, কিছু অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে যায়। যেগুলো পরে ল্যান্ড মাইনের মতো কাজ করে। এছাড়াও বড় বড় আকৃতির অনেক ধ্বংসাত্মক বোমাও ফেলা হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে সেগুলোরও অনেকগুলো অবিস্ফোরিত অবস্থায় থেকে যায়।

আগাছার ফাঁকে পড়ে থাকা ক্লাস্টার বোমা; source: CCBY mines advisory group

মূলত এই অবিস্ফোরিত বোমাগুলো লাওসবাসীর দুর্ভোগকে আরো হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। কৃষকরা জমি চাষ করতে গিয়ে মাটির নিচে পরিত্যাক্ত বোমার সন্ধান পায়, শিশুরা বনেবাদাড়ে খেলা করতে গিয়ে বোমা কুড়িয়ে পায়, জলাশয়ে কাজ করতে গিয়ে পানির নিচে বোমা পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পরিত্যাক্ত বোমাগুলো বিস্ফোরিত হয়ে প্রাণহানি বা অঙ্গহানি ঘটায়, যার অধিকাংশ শিকারই আবার শিশু। ২০১২ পর্যন্ত হিসেবে প্রায় ২৯ হাজার মানুষ এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়।

‘৭৫ সালের পরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর লাওস সরকার যাবতীয় ল্যান্ড মাইন, বোমা ইত্যাদি পরিস্কার করা শুরু করে। এ ধরনের কাজের জন্য উচ্চ প্রশিক্ষিত কর্মী, উন্নত প্রযুক্তি আর পর্যাপ্ত বাজেট দরকার হয়, যার কোনোটিই লাওস সরকারের নেই। এ সময় থেকেই ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্যে ভূমি বোমা মুক্তকরণ চলছে, যা আজও চলমান। ২০১৬-তে এবিসি নিউজের সাথে এক সাক্ষাতকারে লাওসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, লাওসের যে কারিগরী সামর্থ্য, তাতে প্রায় শতাব্দী লেগে যাবে এগুলো সরাতে।

বোমার খোলস দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বেড়া; source: Mark Watson

কিন্তু জীবন থেমে থাকে না, কৃষককে জমিতে কোদালের কোপ দিতেই হবে, শিশুরাও মাঠে খেলতে যাবে। মানুষ বেশ চমৎকারভাবে মানিয়ে নিয়েছে এসব বোমার সাথে। ঘরের সীমানার বেড়া দেয়া হচ্ছে বোমার শেল দিয়ে। কখনো বোমশেল কেটে দু’খণ্ড করে বানানো হয়েছে ফুলের টব। রেস্টুরেন্ট বা ক্যাফেতে ক্লাস্টার বোমার খোল ব্যবহৃত হচ্ছে অ্যাশট্রে হিসেবে, বড় আকারের বোমার খোল ব্যবহৃত হচ্ছে চুলা হিসেবে। নদীতে দেখা যাবে জঙ্গীবিমানের জ্বালানী ট্যাংক (ড্রপ ট্যাংক) দিয়ে দিব্যি নৌকা বানানো হয়েছে। এসব জায়গার মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আসলে বোমা এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগই নেই, মানুষের পুরো চিত্তই দখল করে আছে তা।

জঙ্গী বিমানের ড্রপট্যাংক দিয়ে তৈরি নৌকা; source: Mark Watson

পুরো লাওসের ভেতরে জিয়াংখুয়াং প্রদেশের ‘বান নাপিয়া’ নামক একটা গ্রাম ‘দি বম্ব ভিলেজ’ নামে খ্যাত পরিত্যাক্ত বোমাগুলো বিচিত্রভাবে নিজের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের মাধ্যমে।

বোমার খোলসের মাঝ বরাবর কেটে ফেললেই হয়ে গেল বালতি; source: Mark Watson

প্রথমে খুব সাবধানে বোমার ফিউজ খুলে সেটা নিস্ক্রিয় করা হয়, এরপর ভেতরকার বিস্ফোরক উপাদান বের করে খালি করে ফেলা হয়। এরপর অবশিষ্ট খোলটি বালতিতে পরিণত হবে নাকি বেড়ার খুঁটি সেটা নির্ভর করে সেটির আকৃতির উপর। এছাড়া স্থানীয়ভাবে ধাতুর চাহিদা মেটানোর একটি বড় উৎস এসব বোমার খোল। এগুলো গলিয়ে ফেলে বিভিন্ন কাজে ধাতুর চাহিদা মেটানো হয়।

বান নাপিয়াতে বোমার খোলস গলিয়ে তৈরি করা হচ্ছে নানা জিনিস; source: John Dennehy

সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ নিজ উদ্যোগে এনজিওর সহায়তায় স্বেচ্ছাশ্রমেও বোমা মুক্তকরণের কাজে এগিয়ে আসছে। তবে ‘বান নাপিয়া’ গ্রামটি যে কারণে বিভিন্ন মহলে বেশ সাড়া ফেলেছে তা হলো, গ্রামবাসী বোমার স্ক্র্যাপ গলিয়ে বিভিন্ন রকম স্মারক বস্তু তৈরি করছে পর্যটকদের জন্য। এর মধ্যে আছে চামচ, চাবির রিং, বোতলের ছিপি খোলার যন্ত্র, ব্রেসলেট ইত্যাদি।

বোমার খোলস গলিয়ে তৈরি স্মারক বস্তু; source: saobancrafts

লাওস ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের অনেকেরই ভ্রমণ তালিকায় থাকে বম্ব ভিলেজ বান নাপিয়া। গ্রামটিতে গেলে যুদ্ধের ভয়াবহতার অনেক চিহ্ন এখনও দেখতে পাওয়া যায়। ফসলের ক্ষেতে গেলে দেখা যায় দিগন্ত পর্যন্ত পুরো মাঠ প্রচুর গর্তে ভরা। এসব গর্ত বিমান থেকে ফেলা বোমার বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ড্রোনের মাধ্যমে তোলা প্রচুর ছবির মাধ্যমে ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া যায়।

বিমান থেকে দেখলে পুরো লাওসের ভূমিতেই বিস্ফোরণের গর্ত দেখা যায়; source: reader

এই জিয়াংখুয়াং প্রদেশের রাজধানী আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্যও বিখ্যাত। সেটি হলো ‘প্লেইন অব জার’ নামক অনেক সংখ্যক কলস আকৃতির পাথুরে পাত্র। ধারণা করা হয়, প্রাচীনকালে মদ জমা রাখার জন্যে এসব পাত্র তৈরি করা হয়েছিলো। প্রাচীন নিদর্শনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বোমা বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট গর্তেরও দেখা মেলে।

প্লেইন অব জার এর পাশে বোমা বিস্ফোরণের গর্ত; source: Jen Kraska

শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বা বোমা বর্ষণের ঘটনা পুরোপুরি অস্বীকারই করত, যেন আদৌ এরকম কোন ঘটনা ঘটেনি! ২০১৬ সালে বারাক ওবামা প্রথমবারের মতো কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে লাওস সফর করেন এবং স্বীকার করেন এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের দায়। বারাক ওবামার উদ্যোগে ৯০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়া হয় লাওসের ভূমিকে বোমা মুক্তকরণের জন্যে। লাওসের ভূমি মানুষের নিরাপদ পদচারণার স্থল হোক সেটাই গোটা পৃথিবীর কাম্য।

ফিচার ইমেজ- Amusing Planet

Related Articles