Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হাং সং ডং: ভিয়েতনামের গভীর জঙ্গলে ঘেরা পৃথিবীর বৃহত্তম গুহা

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে ভিয়েতনাম দেশটি সম্পর্কে আমাদের কম-বেশি সকলের ধারণা রয়েছে। এছাড়াও কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে ভিয়েতনামের চালের জন্যেও দেশটি খুব প্রসিদ্ধ। এছাড়াও পাহাড়-পর্বত, বিস্তৃত সমভূমি এবং নদীবহুল এই দেশটিতে রয়েছে অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

ভিয়েতনাম, নদী এবং পাহাড়ের মিলনমেলা; blueskypk.com

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির উত্তরে চীন, পশ্চিমে লাওস ও কম্বোডিয়া এবং দক্ষিণ ও পূর্বে দক্ষিণ চীন সাগর অবস্থিত। ভিয়েতনামের উত্তর-প্রান্ত এবং মধ্যভাগ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রচুর পাহাড়-পর্বত। এসব পাহাড়-পর্বতে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাকৃতিক গুহা। এসকল গুহার মধ্যে একটি গুহার নাম হলো ‘হাং সং ডং’ যেটি কিছু বছর আগে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গুহার খেতাব অর্জন করেছে। তবে দৈর্ঘ্যের বিচারে দীর্ঘতম গুহা ধরা হয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকিতে অবস্থিত ‘ম্যামথ গুহা’কে।

হাং সং ডুং গুহার প্রবেশদ্বার; Source: vietnamtravel.co

ভিয়েতনামের সাথে লাওসের সীমান্তবর্তী প্রদেশটির নাম কোং বিন। এই কোং বিন প্রদেশের একটি জেলা হলো ‘বো টাচ’ যেখানে ফং না কে বাং জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। এই উদ্যানটির প্রাণকেন্দ্রে লাওসের সীমান্তের কাছাকাছি গুহাটির অবস্থান। স্থানীয়ভাবে একে সং ডং বলে ডাকা হয়। তবে ভিয়েতনামের গুহা বলেও এর স্বীকৃতি রয়েছে।

ফং না কে বাং জাতীয় উদ্যান; Source: audleytravel.com

গুহাটির আবিষ্কারের ইতিহাসও কিন্তু বেশ চমকপ্রদ। গুহার কাছাকাছি স্থানীয়দের তেমন বসবাস নেই। গ্রামটিতে বসবাসকারী মানুষগুলো খুব দরিদ্র। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় এই সীমান্তে প্রচুর পরিমাণে বোমা ফেলা হয়েছিল। ফলে এখানকার বন-জঙ্গলে এখনো প্রচুর পরিত্যক্ত বোমা, ডিনামাইট, মাইন ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া যায়। আর এই বোমাগুলো খুঁজে নিয়ে বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়। আর সে কারণেই স্থানীয়দের আয়ের অন্যতম উৎস এটি। তবে এই কাজ খুব বিপদজনকও বটে। অসতর্কতার জন্যে বিস্ফোরণ হয়ে মারা গেছে অনেকেই।

ফং না কে বাং জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথ; Source: steemit.com

১৯৯০ সালের দিকে হো খান নামে একজন স্থানীয় জঙ্গলের মধ্যে শিকারের খোঁজে ঢুকে পড়েন। পথ হারিয়ে অনেকটাই দিশাহীন হয়ে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েন। তখন হঠাৎ শুরু হয়ে যায় প্রচন্ড ঝড়। নিজেকে বৃষ্টির পানি থেকে আড়াল করে নিতে একটি পাহাড়ের খাঁজে আশ্রয় নেন। কিছু সময় চুপচাপ বসে থাকার পর লক্ষ্য করলেন পাহাড়ের একদিকে একটি গর্তের মুখ এবং সেখান থেকে একধরনের স্রোতধারার আওয়াজ বয়ে আসছে। পাশাপাশি সেই জায়গায় বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজ যেন অনেক বেশি তীক্ষ্ণ। অদম্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একা গুহার কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি হো খানের। নিজেকে সামলে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথ খোঁজার জন্যে বেড়িয়ে পড়লেন।

জাতীয় উদ্যানের মধ্যকার বিস্তৃত জঙ্গল; Source: sarastumblinggracefully.com

এদিকে সেই সময় যুক্তরাজ্যের গুহা গবেষণা কেন্দ্রের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাওয়ার্ড এবং ডেব লিমবার্ট জাতীয় উদ্যানের বিভিন্ন জায়গা পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন। তখন তারা স্থানীয়দের কাছে হো খানের এই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে পারেন। হো খানের সাথে দেখা করে তাকে সাথে নিয়ে নিজেদের একটা দল সহ তারা ঐ জঙ্গলে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেইবার ভাগ্য তাদের মোটেই সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই হো খান তাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে পারেননি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেই যাত্রায় আর দেখা মেলেনি সং ডং এর।

ব্রিটিশ কেভ রিসার্চ এসোসিয়েশন; Source: slideplayer.com

এরপর প্রায় ১৮ বছর কেটে যায়। ২০০৮ সালে সেই হো খান আবারো খাদ্যের জন্যে শিকার করতে সেই জঙ্গলে ঢোকেন। তখন তার হঠাৎ মনে পড়ে অনেক বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সেই গুহার কথা। নিজের অজান্তেই গুহাটি পুনরায় আবিষ্কার করার একটা অদম্য ইচ্ছা অনুভব করেন হো খান। জঙ্গলের পথ ধরে একসময় পৌঁছেও গেলেন সেই গুহায়। এবার আর ভুল করেননি হো খান। ফেরার পথে চিহ্ন দিয়ে ফিরলেন যাতে করে আর খুঁজে পেতে সমস্যা না হয়। গ্রামে ফিরে গিয়ে সোজা খবর দিলেন যুক্তরাজ্যের সেই গুহা গবেষণার দলটিকে। ডেব এবং ল্যাম্বার্ট তখনো সেখানে কর্মরত ছিলেন। তারা সহ ভিয়েতনাম সরকারের একটি দলের সাথে যৌথভাবে ২০০৯ সালে গুহাটি আবিষ্কার করেন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা করে গুহার আকার এবং আকৃতির দিক থেকে পৃথিবীর আবিষ্কৃত গুহাগুলোর মধ্যে বৃহত্তম বলে ঘোষণা করেন।

গুহার মধ্যকার ছবি; Source: vietnamgrouptour.com

প্রায় ২০০ মিটার উচ্চতার এই গুহার ৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর অভিযাত্রীদের মতে পুরো নিউইয়র্ক শহরকে এই গুহার ভেতর খুব সহজেই স্থান করে দেয়া যাবে। পুরো গুহাটি ৯ কিলোমিটারের চাইতেও বেশি এবং এর অনেক অংশ বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং বড় বড় পাথরের দেয়ালের কারণে এখনো উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি।

গুহার মধ্যে বড় বড় পাথরে আটকানো পথ; Source: visa2vietnam.blogspot.com

২০১৩ সালে সং ডং গুহাকে প্রথমবারের মতো জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আর ভ্রমণ পিপাসুদের গুহার মধ্যে অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয় একটিমাত্র ভ্রমণ সংস্থা কোম্পানি ওক্লালিসকে। গুহার ভারসাম্য রক্ষার কথা চিন্তা করে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রতিটি অভিযান ৫ দিনের হয়ে থাকে। সপ্তাহে কেবল একবার এই অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং প্রতি অভিযানে মোট ১০ জন অভিযাত্রী অংশগ্রহণ করতে পারেন।

গুহার মধ্যে সফল অভিযান করা একটি দল; Source: youtube.com

যদি ভেবে থাকেন সারা বছর ধরে এই অভিযান চলে তাহলে সম্পূর্ণ ভুল ভাবছেন। বছরের কেবল ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্তই অভিযান উন্মুক্ত থাকে। তবে চাইলেই এই গুহার অভিযানে সামিল হওয়া যায় না। এর জন্যে প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং শারীরিক সক্ষমতা। টানা দুদিন ধরে চুনাপাথরের ভেতর দিয়ে স্বল্প অক্সিজেনের মধ্যে অনবরত হাঁটতে হয়। গুহার মধ্যে রয়েছে বিশাল এক গভীর জলাশয়, যার মধ্যে সাঁতার কেটে পাড়ি দিতে হয় অনেকটা পথ। এছাড়াও পাহারের ধার ঘেঁষে দড়ির সাহায্যেও অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। তাই বোঝাই যাচ্ছে এমন দুঃসাধ্য কাজ যারা অসম্ভব অভিযান প্রিয় এবং যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তারাই কেবল করতে পারে। তবে এই অভিযানে পুরো গুহার এক-তৃতীয়াংশেরও কম পরিমাণ স্থান ঘোরানো হয়। এর পরের পথ অনেক বেশি দুর্গম এবং ঝুঁকিপূর্ণ।

গুহার মধ্যে এক অভিযাত্রীদল; Source: howtospendit.ft.com

তবে ওক্সালিস কোম্পানি অভিযাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সাথে দেখে থাকে। প্রতিটি দলের সাথে থাকে দুজন গুহা বিশেষজ্ঞ, তিনজন স্থানীয় পথ প্রদর্শক, দুজন বাবুর্চি, দুজন বনরক্ষক এবং ২০ জন কুলি। এছাড়াও সাথে থাকে বিভিন্ন প্রাথমিক চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, ওষুধ ইত্যাদি।

গুহার মধ্যে প্রবেশের প্রস্তুতিরত একটি অভিযাত্রীদল; Source: manfrottoschoolofxcellence.com

আগেই বলেছি ভিয়েতনামের কুয়াং বিং প্রদেশটি অসম্ভব দারিদ্র্য সীমায় বাস করছে। ফলে এখানকার মানুষ খাদ্যের জন্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে। সং ডং গুহাটি যেন তাদের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। সং ডং এর পাশাপাশি এই অঞ্চলের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট গুহা এবং জঙ্গল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনো কমতি নেই এই প্রদেশে। দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটন পিপাসু মানুষের ভিড় নিয়মিত বাড়ছে বলে স্থানীয়রা গুহায় বিভিন্ন কাজ পাচ্ছেন। সাথে সাথে পাহাড়ে ওঠা, সাইক্লিং, হাইকিং এর মতো অভিযানের চাহিদা বাড়ছে। ফলে স্থানীয় অঞ্চলটি যেন গুহার সাথে সাথে নতুন একটি জীবন পেল।

অভিযানে আসা অনেকের পথ প্রদর্শক হচ্ছেন স্থানীয়রা; Source: buffalotrip.com

তবে এত সবকিছুর মাঝেও পাহাড়ের জন্যে নতুন হুমকি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভিয়েতনামের একটি আবাসন কোম্পানি ‘সান গ্রুপ’ চাইছে সং ডং এ একটি কেবল কার বা লোকবহনকারী যান বসানোর জন্যে, যাতে করে ঘন্টায় প্রায় ১,০০০ মানুষ পুরো গুহা ঘুরে আসতে পারবে। কিন্তু ইউনেস্কো ও সং ডং রক্ষা কমিটির সক্রিয় কর্মীরা এর প্রতিবাদ করে চলেছে। ২০১৫ সালে এই কেবল কার নির্মাণের কাজ প্রাথমিকভাবে বন্ধ রাখা হয়। তবে এই নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। অনেকের মতে পর্যটক বাড়লে স্থানীয়দের অনেক উন্নতি সাধন হবে, আবার আরেক দলের ভাবনা অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণের ফলে গুহাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্য এবং এখানকার স্বাভাবিক সৌন্দর্য তার বৈচিত্র্য হারাবে।

ফিচার ইমেজ- vietnamnews.vn

Related Articles