চীনের জেজিয়াং প্রদেশের শিয়া বেইকুন গ্রামে পাওয়া গেছে এক প্রাচীন পৃথিবীর খোঁজ। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কিউজিয়াং নদীর তীর ঘেঁষে ফিনিক্স হিল নামের এক পাহাড়ের কাছে আবিষ্কৃত হয়েছে বেলে পাথরের তৈরি বেশ কিছু প্রাচীন গুহা। এ পর্যন্ত ৩৬টি গুহা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। চীনের মানুষের কাছে এ যেন পৃথিবীর প্রাচীন আশ্চর্যগুলোর একটি। প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো গুহাগুলোর আর্কিটেকচারাল গঠন, বৈশিষ্ট্য এবং নির্মাণশৈলী দেখে স্থপতি থেকে পুরাতত্ত্ববিদ সকলেই অবাক। তবে হাজারো লোকের নিরলস পরিশ্রমে নির্মিত মানবসৃষ্ট এই শিল্পমন্ডিত গুহাগুলো সম্পর্কে ইতিহাসে তেমন কোনো তথ্য না পাওয়া সত্যিই বিস্ময়কর।
লংইউ গুহা আবিষ্কৃত হয়েছিল যেভাবে
১৯৫০ সালের দিকে এ অঞ্চলে বড় ধরনের বন্যা হয়। কিউজিয়াং নদীর পানিতে তলিয়ে যায় আশেপাশের অনেক গ্রাম। গ্রামবাসীরা ফিনিক্স হিল পাহাড়ের কাছে আশ্রয় খুঁজে নেয়। কারণ, স্থানটি ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৯ মিটার উঁচুতে। তাই আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে গ্রামবাসীরা আশ্রয়চ্যুত হবেন এমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সুপেয় পানীয় জলেরও কোনো অভাব ছিল না। ফলে দ্রুতই আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আরও লোক এসে ফিনিক্স হিলের পাদদেশে ‘সিয়ান্বি’ নামে এক নতুন গ্রাম গড়ে তোলে।
১৯৯২ সালের জুনে প্রথম লংইউর ২৪টি গুহা আবিষ্কৃত হয়। পরে আরও বেশ কিছু গুহা আবিষ্কৃত হয়। যখন গুহাগুলো আবিষ্কৃত হয় তখন এগুলোর অধিকাংশই পানিতে নিমজ্জিত ছিল। উ আনাই নামের এক গ্রামবাসী আরও কয়েকজনকে সাথে নিয়ে হঠাৎই একদিন এখানকার একটি গুহার পানি নিষ্কাশনের কাজ শুরু করেন। ১৭ দিন ধরে পানি নিষ্কাশনের পর পানি সরে গেলে তারা একটি গুহার সন্ধান পান। গুহার কাঠামো এবং নির্মাণশৈলী দেখে তারা বুঝতে পারেন, এই গুহা মানুষের তৈরি। উ আনাই ও তার সঙ্গীরা আরও উৎসাহিত হয়ে এভাবে আশেপাশের আরও ছয়টি গুহার পানি নিষ্কাশন করেন। এই সাতটি গুহার মেঝে ৩০০-২,০০০ বর্গ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, দক্ষিণ চীনের বেশিরভাগ অঞ্চলে খুব গভীরতাসম্পন্ন পুকুর দেখতে পাওয়া যায়। পুকুরগুলোতে সারা বছরের পানির যোগান থাকে। আর এসব পুকুরে নানা ধরনের মাছও পাওয়া যায়। গুহাগুলো যখন পানিতে নিমজ্জিত ছিল, তখন স্থানীয় গ্রামবাসীরা ভেবেছিলেন এটিও ঐ ধরনেরই কোনো পুকুর হবে। কিন্তু গুহার পানি নিষ্কাশনের পর সেখান থেকে একটি মাছও পাওয়া যায়নি।
কীভাবে গুহাগুলো নির্মিত হয়েছিল?
বিস্ময়কর লংইউ গুহাগুলো নির্মাণে জড়িত শ্রমিকদের কাজের পরিধি এবং তাদের কী ধরনের পরিশ্রম করতে হয়েছিল তা ভাবতে গেলে আজকের স্থপতিরাও বিস্মিত হন। প্রায় এক মিলিয়ন ঘন মিটারের কঠিন শিলাপাথরের দেয়াল কেটে কেটে সাজানো হয়েছে এই গুহা। আর এজন্য শ্রমিকদেরকে কী অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে তা ধারণারও অতীত। অবাক করা বিষয় হলো, গুহার প্রবেশ পথ বেশ সঙ্কীর্ণ হওয়ায় সূর্যের আলো শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট কোণে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে গুহাগুলোতে প্রবেশ করতে পারে। আর গুহার একেবারে ভেতরে সূর্যের আলো পৌঁছানো সম্ভব না। কিন্তু গুহার বিভিন্ন জায়গায় এত নিপুণ কাজ তাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হলো তা এখনও অজানা। বিশেষজ্ঞরা নানা অনুসন্ধান করেও গুহার ভিতরে কোনো আলো বা মশাল জ্বালানোর অস্তিত্ব খুঁজে পাননি।
বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন, এক হাজার মানুষ যদি দিনে-রাতে একটানা পরিশ্রম করেন, তাহলেও এই বিশাল মাপের গুহা তৈরি হতে সময় লাগবে ছয় বছর। আর এই কাজ করতে প্রতিটি গুহার লোক দেখতেই পাননি অন্য গুহায় কী কাজ হচ্ছে। তবে এই গুহাগুলো নির্মাণে, এমনকি গুহার অভ্যন্তরে নানা ভাস্কর্য তৈরিতে কী ধরনের যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছিল তা আজও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা এ অঞ্চলে এবং এর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক অনুসন্ধানের পরও গুহা এবং তার অভ্যন্তরে নির্মিত স্থাপত্যগুলো নির্মাণে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সম্পর্কে কোনো তথ্যই জানতে পারেননি।
গুহার নির্মাণশৈলী
এই গুহার স্থাপত্য কম আশ্চর্যের নয়! মাটির ত্রিশ মিটার নীচে গুহাগুলোর নির্মাণশৈলী সত্যিই চমকে দেয়ার মতো। গুহাভ্যন্তরে সেতু, সুইমিং পুল, জলনিকাশী ব্যবস্থা দেখলে তখনকার স্থাপত্যবিদ্যার উৎকর্ষতা দেখে অবাক বনে যেতে হয়। এমনকি, গুহার পিলারগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যে এত বছর ধরে অত্যন্ত শক্তভাবেই এগুলো ছাদকে ধরে রেখেছে। এর ফলে গুহার একচুলও ক্ষতি হয়নি। শুধু কি স্থাপত্য? ভেতরের দেওয়াল, পাথরের স্তম্ভ আর ছাদে সুন্দর সমান্তরাল লাইনে পাথরের কারুকাজ সকলকে অবাক করে দেয়।
গুহার দেয়ালের সূক্ষ্ণ জ্যামিতিক নকশা, নির্ভুল নির্মাণশৈলীর পরিশীলতাবোধ সত্যিই অবাক করার মতো। এ সবই স্থাপত্যবিদ্যার উচ্চতর কারিগরি দিকের নির্দেশক। প্রতিটি গুহার বৈশিষ্ট্য, প্যাটার্ন এবং স্থাপত্যশৈলী প্রায়ই একই। চারদিকের দেয়াল খাড়া এবং সোজা। নির্মাণ কাজের আগে একটি সুষ্ঠু এবং নিখুঁত নকশা ছাড়া এ ধরনের কাজ সম্পন্ন করা খুবই দুরুহ ব্যাপার। এমন নির্মাণ কাজের সাথে তখনকার দিনের দক্ষ ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণিত হয়। কিন্তু সেসব তুখোড় স্থাপত্যশিল্পী সম্পর্কে ইতিহাসে কিছুই জানা যায় না।
গুহার দেওয়ালের অদ্ভুত প্যাটার্ন
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানকার গুহার দেওয়ালে একধরনের অদ্ভুত প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যায়, যার সাথে ৫০০-৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি মাটির জিনিসপত্রের খুব মিল আছে। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্যটি হলো, ওখানকার সাতটি গুহার গঠনের সঙ্গে নাকি মিল পাওয়া যায় আমাদের খুব চেনা, আকাশের সপ্তর্ষিমন্ডলের সাতটি নক্ষত্রের অবস্থানের। এখানে পৃথিবীর প্রাচীন লগ্নে যদি কোনো সভ্যতা থেকেও থাকে, তা হলে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে তাদের বেশ ধারণা ছিল বলতেই হয়।
গুহাগুলো নিয়ে প্রাচলিত নানা জনশ্রুতি
এমন আশ্চর্য সুন্দর গুহাগুলো নির্মাণের উদ্দেশ্য কী হতে পারে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত রয়েছে। গুহাগুলোর মাঝখানের প্রতিটি দেয়ালের প্রশস্ততা দেখে কেউ কেউ মনে করে থাকেন, এগুলো প্রাচীন রাজাদের সমাধি কিংবা রাজদরবার হতে পারে। কিন্তু গবেষকদের অনুসন্ধানে এখানে কোনো সমাধির চিহ্ন বা রাজদরবার থাকার তথ্য মেলেনি। গুহার মধ্যে কোথাও খাবার ঘর, শোয়ার ঘরের তো হদিসই পাওয়া যায়নি। এমনকি মানুষ বসবাসের কোনো চিহ্নই পাওয়া যায়নি গুহাগুলোতে।
গুহাগুলো যখন প্রথম আবিষ্কৃত হয়, তখন এগুলোর বেশিরভাগ অংশই পানিতে নিমজ্জিত ছিল। তাই অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়তো এখানে কোনো জলপথের সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু পরবর্তীতে অনেক অনুসন্ধানের পরও তেমন কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আবার, প্রাচীন রাজারা তাদের বিপক্ষে থাকা শত্রুপক্ষের আড়ালে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য মাটির নীচে এমন গুহা তৈরি করতে পারেন বলে কেউ কেউ অনুমান করেন। মাটির নীচে রণকৌশল সাজানো এবং নানা নতুন যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করার জন্য এ স্থানকে তারা ব্যবহার করতেন। ফলে বাইরের কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব হতো না। কিন্তু তার জন্য তো আর দেয়ালে অমন নিখুঁত কারুকাজের দরকার হয় না। আর এই নিখুঁত কারুকার্যময় দেয়াল তৈরিতেও অনেকদিন সময় লেগেছিল। ততদিন তো যুদ্ধ আটকে থাকার কথা নয়।
কেউ কেউ মনে করেন, ভিন গ্রহের প্রাণীরা অন্য গ্রহ থেকে এসে নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখার জন্য এই গুহা নির্মাণ করে! কেনই বা তারা এই অঞ্চলে এতদিন ধরে এতগুলো গুহা নির্মাণ করবে তা স্পষ্ট নয়। তবে এ অঞ্চলের অনেকেই এ ধরনের বিশ্বাস করে থাকেন, যার কোনো ভিত্তি নেই।
এত বছর পরও লংইউ গুহাগুলো অবিকৃত রয়ে যাওয়ার নেপথ্যে
গত কয়েক শতাব্দী ধরে চীনের এ অঞ্চল নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং যুদ্ধবিগ্রহে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তারপরও গুহাগুলোর তেমন কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়নি। মাটির নীচের গুহার কাঠামোগুলো প্রায় অক্ষত রয়ে গেছে। গুহা কক্ষগুলোর ৫০ সেন্টিমিটার দেয়ালগুলোতে নানা কারুকার্যময় অলঙ্কার আজও স্পষ্ট। যেন মনে হবে, এই তো কয়েকদিন আগেই নির্মিত হয়েছে।
কার তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল এই বিস্ময়কর গুহা
চীনের এই অদ্ভুত লংইউ গুহা কে বা কাদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং কেনই বা এ ধরনের গুহা তৈরি করা হয়েছিল সে রহস্য আজও উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। তবে গবেষকগণ একটি বিষয়ে একমত, পাথর কাঁটায় নিপুণ হাতযশ না থাকলে এমন গুহা তৈরি করা সম্ভব নয়।
কিন্তু এই কথা ঠিক যে, প্রায় এক মিলিয়ন ঘন মিটার পাথরে তৈরি এই গুহাগুলো কোনো সাধারণ মানুষের হাতে তৈরি হতে পারে না। চীনের প্রাচীর যেমন তৈরি হয়েছিল বাইরের শত্রুদের আটকাতে, তেমনই কোনো এক বিশেষ কারণে কোনো রাজাই এমন বড় মাপের কাজ করার নির্দেশ দিতে পারেন। কিন্তু এতেও প্রশ্ন থেকে যায়? সেই রাজার কথা ইতিহাসের কোনো জায়গায় উল্লেখ নেই কেন? কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হয়েছিল সেই বিষয়ে কোনো তথ্যও ইতিহাসে নেই। তাই কার নির্দেশে এবং কার নেতৃত্বে এই বিশাল কাজ সম্পন্ন হলো সেই রহস্যের প্রহেলিকাটুকু নিয়ে গুহাগুলো শুধু রয়ে গেছে।
This article is in Bangla language. This describes about longyou caves, an ancient wonder of china. All the sources are hyperlinked inside the article.
Feature Image Source: wikimedia commons