এই বিশ্ব প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সত্যিই তুলনা নেই। এই পৃথিবীর চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে কতশত নদী-পাহাড়-মরুভূমি, আর তার সাথে নাম না জানা কত গাছপালার সমাহার। এসবই প্রকৃতির দান। রহস্যময় এই প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানেরই একটি নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে। কখনও তা ভয়ঙ্কর রূপে আমাদের সামনে ধরা দেয়, আবার কখনোবা তা আমাদের চোখ মন জুড়িয়ে দেয়। প্রকৃতির এই অপরূপ সৃষ্টির সামনে দাঁড়ালে মানবসৃষ্ট সভ্যতার সবকিছুই যেন তুচ্ছ হয়ে যায়। প্রকৃতির বুকে লুকিয়ে থাকা এই অপার রহস্য মানুষ আজও পুরোপুরি উন্মোচন করতে পারেনি। প্রকৃতির সেসব অজানা কিছু রহস্য নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
যে ফুল ফোটে শত বর্ষ পরে
পৃথিবীর দীর্ঘতম আন্দিজ পর্বতমালায় অদ্ভুত ধরনের এক ফুল গাছ পাওয়া যায়। গাছটি ‘কুইন অব দ্য আন্দিজ’ নামেও অনেকের কাছে বেশ পরিচিত। তবে গাছটির আসল নাম পুয়া রাইমন্ডি। এটি ব্রোমেলিয়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এই পরিবারের ৩০০০ প্রজাতির মধ্যে পুয়া রাইমন্ডিই বৃহত্তম। ১৮৭০ সালে এক দল উদ্ভিদবিজ্ঞানী প্রথম গাছটির সন্ধান পান। গাছটি আন্দিজ পর্বতের ৩,০০০ থেকে ৪,৮০০ মিটার উচ্চতায় জন্মায়। প্রায় ৪০ ফুট লম্বা গাছটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে মাত্র একবারই গাছটিতে ফুল আসতে দেখা যায়।
প্রত্যেক গাছে ৮ থেকে ২০ হাজার ফুল ফুটে এবং তার থেকে ৮০ থেকে ১২০ লক্ষ বীজ তৈরি হয়। আর আশ্চর্য হচ্ছে, এই ফুল আসার পরেই গাছটির মৃত্যু ঘটে। গবেষকদের মতে, বিশ্বের পুষ্পজাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে সবচেয়ে ধীর গতির ফুল ফোটা উদ্ভিদের মধ্যে এটি অন্যতম। দুঃখের বিষয়, বিরল প্রজাতির উদ্ভিদটি বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ হিসেবে তালিকায় স্থান পেয়েছে।
পাতালপুরীর বিস্ময়কর সিনোট (মেক্সিকো)
সিনোট হলো হঠাৎ তৈরি হওয়া বিশাল গহ্বর। এসব গহ্বর মূলত চুনাপাথর, বেলেপাথর ও লবণ-প্রধান উপাদান দিয়ে তৈরি। ভূস্তরের পানির কারণে অনেকসময় এসব উপদান সহজেই গলে যায়। ফলে মাটির নিচে বড় বড় গর্ত তৈরি হয়। হঠাৎ একসময় মাটির উপরিভাগ ধ্বসে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে নিচের ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডার। আর এভাবে তৈরি হয় সিনোট। পাতালপুরীর বুকে জন্ম নেয়া এ ধরনের সিনোট ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি বিস্তৃত। সিনোটের পানি বেশিরভাগ সময় বেশ স্বচ্ছ হয়।
মেক্সিকোর বিভিন্ন অঞ্চলে এ ধরনের প্রচুর সিনোট দেখা যায়। শুধুমাত্র মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপ অঞ্চলেই ৬০০০-এর ওপর সিনোট রয়েছে। আর এজন্য মেক্সিকো নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ সিনোটের জন্য বিখ্যাত। শুষ্ক মৌসুমে এসব সিনোট স্থানীয়দের পানির চাহিদা পূরণ করে। এখানকার প্রাচীন মায়া সভ্যতার মানুষরা বিশ্বাস করতো যে, বৃষ্টির দেবতা ‘চাক’, প্রাকৃতিক কূপের মতো এসব সিনোটে অধিষ্ঠান করেন। তাদের কাছে এই সিনোট হচ্ছে দেবতাদের কাছে তাদের প্রার্থনা পৌঁছে দেয়ার দ্বার। আজও এখানকার কৃষকরা খরা মৌসুমে বৃষ্টির জন্য সিনোটে প্রার্থনা করেন।
এসব সিনোট বিশ্বের তামাম পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। গ্রীষ্মকালে যখন এসব গহ্বরে সূর্যের আলো পড়ে, তখন সিনোটের স্ফটিক, স্বচ্ছ জলে আলো-আঁধারিময় এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি হয় এবং তা পর্যটকদের সম্মোহিত করে রাখে। এমন পাতালপুরীর গহ্বরে ডুবসাঁতার দেয়ার মজাই আলাদা।
আশ্চর্য এক মরুদ্যান- আল আহসা
আল আহসা পৃথিবীর এক বৃহত্তম মরুদ্যান। সৌদি আরবের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে এটি অবস্থিত। মরুদ্যানটি শুধু আকারের দিক দিয়েই নয়, বৈচিত্র্যেও অনন্য। এই মরুদ্যানে ৬০ থেকে ৭০টির মতো প্রাকৃতিক ঝর্ণা রয়েছে, যা ওই অঞ্চলের খাবারের পানির চাহিদা পূরণ করে। এছাড়া এখানকার ২৮০টিরও বেশি আর্টেজীয় কূপ রয়েছে। এই কূপের পানি দিয়ে প্রায় ৩০,০০০ একর জমিতে সেঁচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর্টেজীয় কূপগুলো হল এক বিশেষ ধরনের কূপ, যেখানে ভূগর্ভস্থ ঠাণ্ডা, সুপেয় পানি নিজের চাপে বেরিয়ে আসে।
সারা বছর ধরে এসব কূপ থেকে পানি পাওয়া যায়। আল আহসার ধু-ধু বিশাল মরুভূমিকে সবুজে ছেয়ে দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এ পানি। প্রত্যেক বছর ৭১২ মিলিয়ন ঘন মিটারের এই বিপুল জলভাণ্ডার মরুভূমির এক বিশাল অংশের সবুজায়নে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। মরুভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় ১৫ লক্ষ পাম গাছে ছেয়ে ফেলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ অঞ্চলে গম, তুলা, ভূট্টা এবং খেজুর গাছসহ বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা চাষাবাদের সাথে পশুপালনেও নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে। ফলে কৃষির সাথে সাথে তারা প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটাতেও সক্ষম হয়েছে।
আবার এই আল আহসা মরুদ্যান, বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ তেল উৎপাদক অঞ্চল হিসেবেও বিশ্বে পরিচিত। এজন্য অঞ্চলটিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক হাব হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়া আল আহসা অঞ্চলটি প্রাচীনতম এলাকাগুলোর একটি বিবেচনা করা হয়। প্রায় ৭০০০ বছরের পুরনো এই জনপদটিতে হারিয়ে যাওয়া অনেক সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়।
এখনও এই মরুদ্যানের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাচীন সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনেক সমৃদ্ধ নিদর্শন চোখে পড়ে। তাই ইউনেস্কো এই অঞ্চলটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
রোটোরুয়া, প্রাকৃতিকভাবে তৈরী এক সালফার সিটি
নিউজিল্যান্ডের এক জনপ্রিয় শহর রোটোরুয়া। অতি পরিচিত রোটোরুয়া হ্রদের নামেই শহরটির নামকরণ করা হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী মাওরি ভাষায় রোটোরুয়ার পুরো নাম ‘তে রোটোরুয়া-নুই-আ-কাহুমাতামোমোই।’ এর অর্থ কাহুমাতামোমোইয়ের দ্বিতীয় বড় হ্রদ। ‘রোটো’ শব্দের অর্থ হ্রদ আর ‘রুয়া’ কথার মানে হলো ‘দুই’। রোটোরুয়া শব্দটির সম্পূর্ণ অর্থ হলো ‘দ্বিতীয় হ্রদ’।
রোটোরুয়া হ্রদের দক্ষিণে অবস্থিত শহরটির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য জিয়োথার্মাল শক্তি। এর প্রভাবে সেখানে তৈরি হয়েছে অসংখ্য উষ্ণ প্রস্রবণ বা গিজার। এই অঞ্চলে এত ভূ-তাপীয় শক্তির উৎপাদন হয় যে, এর ফলে এ অঞ্চলে বাতাসে সালফার গ্যাসের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণে শহরের আনাচে-কানাচে সালফারের পঁচা ডিমের গন্ধ সবসময় পাওয়া যায়। এজন্য রোটোরুয়া ‘সালফার সিটি’ হিসেবেও অনেকের কাছে পরিচিত।
রোটোরুয়ার গিজারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে পোহুটু গিজারটি। পোহুটু এর আশেপাশে থাকা অন্যান্য প্রস্রবণের চেয়ে বেশ আলাদা। কারণ সাধারণ গরম পানির গিজার এটি নয়। সেখানে গরম জলের সাথে মিশে থাকে মাটি, ফলে তৈরি হয় কাদার গিজার। আগুনে কোনো তরল পদার্থ অনেকক্ষণ ধরে উত্তপ্ত করলে যেমনভাবে ফুটতে থাকে, তেমনি এই হ্রদের কাদামাটিগুলো প্রতিনিয়ত ফুটতে থাকে।
হ্রদের বুকে এই ফুটন্ত কাদা মাটির গিজার তৈরি হওয়ার পেছনে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। তবে অধিকাংশের মতে, রোটোরুয়া হ্রদের পানি নির্দিষ্ট এই স্থানে উত্তপ্ত পাথরের উপরে বয়ে যায় বলে এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ অঞ্চলে আগ্নেয় দ্বীপ থাকার কারণে এরকম কাদার বুদবুদ তৈরি হয়, যার নিচ থেকে অনেকটা বুদবুদের মতো গ্যাস বেরিয়ে আসে। তারপর এগুলো চূড়ার মতো হয়ে মাড ভলকানো সৃষ্টি করে।
এই অদ্ভুত গিজারের জন্য রোটোরুয়া নিউজিল্যান্ডের বিশেষ এক দ্রষ্টব্য স্থান। প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু পর্যটক এই দর্শনীয় স্থানটি দেখতে আসেন। সকলেই হ্রদের এই ফুটন্ত কাদামাটি দেখে বিস্মিত হন।
This Bangla article is about some mysteries of nature around the world. Necessary references have been hyperlinked.
Featured Image: Barcelo.com