Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তপ্ত মরুভূমিতে শীতল প্রশান্তির ছয় অপরূপ মরুদ্যান

‘মরুভূমি’ শব্দটি শুনলে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর অনুভবে কেঁপে ওঠে শরীর, সেই সাথে মনে এসে জড়ো হয় রাজ্যের অজানা ভয়ভীতি। দিগন্ত বিস্তৃত এই বালির সাম্রাজ্যের আনাচে-কানাচে যে ছড়িয়ে আছে বিপদের ভয়! মরুভূমিতে ভয় আছে সত্যি, তবে সৌন্দর্য্যেরও কমতি নেই। মরুভূমির বিশালতা, বিস্তীর্ণ বালুকা প্রান্তরের রুক্ষতাতেও কিন্তু ভিন্নরকম এক সুন্দরের আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়।

তবে মরুভূমির প্রকৃত সৌন্দর্যের নাম আসলে ‘মরুদ্যান’। তপ্ত রোদ্দুর অধ্যুষিত মরুভূমির ধু ধু শূন্যতার বুকে ‘মরুদ্যান’ যেন এক টুকরো প্রশান্তির প্রতীক। মরুদ্যান মরুভূমি পাড়ি দেওয়া দিশেহারা, ক্লান্ত পথিককে আশ্রয় দেয়, খাবার আর পানির বন্দোবস্ত করে, এর চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য দিয়ে পথিকের হৃদয়ে প্রশান্তির পরশও বুলিয়ে দেয়। মরুদ্যান গড়ে ওঠে মূলত কোনো প্রাকৃতিক ঝর্ণা, লেক বা ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকে কেন্দ্র করে। পানির উৎসকে ঘিরে নির্মিত হয় রিসোর্ট, বাড়িঘর। খেজুর, ডুমুর, সাইট্রাসের বেষ্টনী মরুদ্যানে শীতল ছায়া প্রদান করে। মরুদ্যান মরুর অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেকটি মরুদ্যানই সুন্দর, খর মরুতে এক টুকরো শান্তির আবাস। কিন্তু পৃথিবীর কিছু মরুদ্যানের সৌন্দর্য এবং সজ্জা অনন্যসাধারণ এবং খুবই বিচিত্র । হ্যাঁ, পাঠক, আজ চলুন জানা যাক ব্যতিক্রমী সুন্দর এমনই কিছু মরুদ্যান সম্পর্কে।

ওয়াদি বানি খালিদ, ওমান

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানকে মরুদ্যানের স্বর্গ বললে ভুল হয় না। বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন মরুদ্যান রয়েছে ওমানে। ওয়াদি বানি খালিদ তার অন্যতম। এটি মূলত এর অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। এই মরুদ্যানের পানির উৎস পাথুরে প্রাকৃতিক ঝর্ণা। ধূসর পাথর আর ছোট ছোট ঝরণা থেকে পতিত অবিরত জল মিলে তৈরি করেছে স্ফটিকস্বচ্ছ লেক। লেকের পাড়েই ঘন সবুজ নলখাগড়ার ঝাড়। মরুদ্যান জুড়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে হরেক রকম গাছগাছালি। মৃদুমন্দ বাতাস লেগে ঢেউ খেলে যায় গাছের পাতায়। ঘন সন্নিবিষ্ট পাতার আড়াল থেকে কখনো হঠাৎ উড়াল দেয় বিচিত্র বর্ণের পাখির দল। প্রজাপতিরা তাদের সুন্দর ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় ফুটে থাকা উজ্জ্বল বেগুনি রঙের বুগেনভিলিয়া ফুলে। সব মিলিয়ে ওয়াদি বানি খালিদ অতুলনীয় সুন্দর ।

অপূর্ব সুন্দর ওয়াদি বানি খালিদ; Source: wpnature.com

কাফেলার পথিকদের জন্য এটি যেমন একটি আদর্শ আশ্রয়স্থল, তেমনি স্থানীয় লোকজনের জন্য দারুণ এক দর্শনীয় স্থানও। ওয়াাদি বানি খালিদে বিচিত্র বর্ণ ও ধাঁচের পাথরের দেখা মেলে। চাইলে আপনি এর স্বচ্ছ লেকের জলে সাঁতারও কাটতে পারেন!

ক্রিসেন্ট মুন লেক, চীন

অর্ধচাঁদ আকৃতির ক্রিসেন্ট মুন লেক; Source: James photography

ক্রিসেন্ট মুন লেক গোবি মরুভূমির একটি অনন্য প্রাকৃতিক আশ্চর্যের নাম। প্রাকৃতিক একটি লেককে ঘিরে গড়ে উঠেছে অপূর্ব সুন্দর এই মরুদ্যান। নাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, লেকটি অর্ধচন্দ্রাকৃতির। লেকটির পানির রং স্বচ্ছ সবুজ থেকে ঘন নীল। দূর থেকে মরুদ্যানটি দেখলে মনে হয় বিশাল মরুভূমির নিঃসীম বালির বক্ষে যেন খোদাই করে দেওয়া হয়েছে একটি নিঁখুত আধাচাঁদ আকৃতির নীলকান্তমণি বা পান্না। তবে কাছে গেলে ভুল ভাঙে! বোঝা যায়, এটি মূল্যবান কোনো পাথর নয়, বরং একটি অপূর্ব মরুদ্যান। মনের আনন্দে আপনি এখানে ডুব দিতে পারবেন অকল্পনীয় সৌন্দর্য্যের রাজত্বে।

Source: feel the planet

লেকের চারপাশ ঘিরে থাকা সোনালি বালির পাহাড় আর লেকের স্বচ্ছ জলের তীক্ষ্ম বৈপরীত্য এখানে অবতারণা করেছে দুর্লভ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের। লেকের পাড়ে আছে সবুজ নলখাগড়া। আর লেকের পাড় থেকে দূরে তাকালে চোখে পড়ে দিগন্ত ছেয়ে থাকা চৈনিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া মনোমুগ্ধকর সব মন্দির আর তাঁবু। চীনের ডানহুয়াং শহর থেকে প্রায় ছয় কি.মি. দক্ষিণে এবং ইকোয়িং স্যান্ড মাউন্টেনের উত্তরে অবস্থিত এই মরুদ্যানটি জনপ্রিয় একটি পর্যটন আকর্ষণ।

সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরোটা দিন কাটানোর জন্য এখানে দর্শনীয় নানারকম উপকরণ ছড়িয়ে আছে। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সময় আকাশের রঙের আকর্ষণীয় পালাবদল প্রতিফলিত হয় লেকের জলে। আর সন্ধ্যায় লেকের পাড় জুড়ে থাকা নিয়ন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে লেক, যা দেখলে মনে হয় আকাশের চাঁদটাই যেন মরুভূমিতে নেমে এসেছে। এখানে দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য রয়েছে উটের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ, মরু সার্ফিং, গ্লাইডিং, মোটরসাইক্লিং, তীর ছোঁড়া প্রভৃতি নানা আয়োজন। ক্রিসেন্ট মুন লেক ভ্রমণ নিঃসন্দেহে আপনার স্মৃতিতে দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়ে জমা থাকবে।

হুয়াকাচিনা, পেরু

Source: ecophils.com

হুয়াকাচিনা শুধু পেরুই নয়, পুরো দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র মরুদ্যান। পেরুর রাজধানী লিমা থেকে বাসে চড়ে মাত্র পাঁচ ঘণ্টা গেলেই দেখা মিলবে চিত্তাকর্ষক এই মরুশহরের। শহরটি দেখলে মনে হবে যেন হলিউডের কোনো মুভির সেট থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে এটি। একটি লেককে ঘিরে গড়ে উঠেছে শহরটি।

রাতের হুয়াকাচিনা; Source: dreamstime.com

প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু বালির পর্বতের উপত্যকার কেন্দ্রে অবস্থিত এই মরুদ্যানটি। মরুদ্যানের লেকের তীর আলিঙ্গন করে আছে বেশ কিছু পেরুভিয়ান রেস্টুরেন্ট, হোস্টেল, ফেরিওয়ালাদের দোকান প্রভৃতি। রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যায় স্থানীয়দের হাতে তৈরি চিনি, ফল আর শষ্য দিয়ে বানানো সুস্বাদু খাবার। অ্যাডভেঞ্চারের শহর হুয়াকাচিনাতে দিনভর এডভেঞ্চারে মেতে থাকার জন্য রয়েছে মরুভূমির বালিয়াড়িতে বাগি রাইড, স্যান্ডবোর্ডিং এর মতো বিচিত্র সব আয়োজন। রাতের বেলায় আলোর বিচিত্র প্রদর্শনীতে শহরটি হয়ে ওঠে শ্বাসরুদ্ধকর সুন্দর।

উম-আল-মা, লিবিয়া

Source: peacockplume.fr

দক্ষিণ-পশ্চিম লিবিয়ার ভীষণ অনুর্বর অঞ্চলেও বেশ কিছু মরুদ্যান আছে। উম-আল-মা তার অন্যতম। লিবিয়ান সাহারার গভীরে উবারি স্যান্ড সি-এর সুউচ্চ বালিয়াড়ির আড়ালে সযত্নে লুকিয়ে রাখা হয়েছে যেন অনিন্দ্যসুন্দর এই মরুদ্যানটি। ‘উম-আল-মা’ শব্দটির অর্থ ‘Mother of waters’। রুক্ষ এই অঞ্চলে যেখানে পানির ছিঁটেফোটা থাকার কথা নয়, সেখানে গভীর, টলটলে জলের একটি প্রাকৃতিক হ্রদের উপস্থিতি সত্যিই বিস্ময়কর। এই অঞ্চলের মরুভূমির বিস্তৃত প্রান্তরে সফররত কোনো পথিকের চোখে রোদে নাচতে থাকা বাতাস সহজেই মরীচিকা হয়ে দেখা দেয়, জলের সন্ধানে ছুটে যায় পথিক। বেশিরভাগ সময়ই তা বিভ্রম প্রমাণিত হয়। খুব অল্প লেকই আছে এই এলাকায়, যেগুলোতে সারা বছর পানি থাকে। উম-আল-মা তেমনই একটি লেক। এই এলাকার বিচিত্র ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য এভাবেই তৈরি করেছে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর একটি স্থান, উম-আল-মা মরুদ্যান।

মরুভূমির রুক্ষতায় একটুখানি কোমল পরশ, উম-আল-মা মরুদ্যান; Source: twitter

এই লেকের পানি কিন্তু লোনা। তারপরও লেকের পাড়ে রয়েছে বিচিত্ররকম সবুজ গাছপালার সমারোহ। গাঢ় রঙের বালির পটভূমিতে সবুজে ছাওয়া নীল জলরাশির লেক- সত্যিই সে এক অসাধারণ দৃশ্য।

সিউয়া মরুদ্যান,মিশর

সিউয়া মরুদ্যান মরুভূমিতে যেন একটি স্বপ্নের নগরী। লিবিয়া সীমান্ত থেকে প্রায় ৫০ কি.মি. দূরে অবস্থিত এই এলাকাটি একটি উর্বর অববাহিকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫ কি.মি. নিচে অবস্থিত এই মরুদ্যানে জলপাই আর খেজুর বৃক্ষের ছায়ায় বসে, মন মাতানো হাওয়া উপভোগ করতে করতে পর্যবেক্ষণ করা যায় শ্লথগতির মরুর জীবনযাত্রা।

কাদামাটির ইটে গড়া বাড়িঘর, আর ছায়াঘেরা কুঞ্জবনের ফাঁকে ফাঁকে চলে গেছে আঁকাবাঁকা পথ। সে পথে গাধাচালিত গাড়িই এখানে যোগাযোগের একমাত্র উপায়।

সিউয়া মরুদ্যানের একটি রিসোর্ট; Source: viamichelin.com

মরুদ্যানজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু ছোট ঝর্ণা রয়েছে যেগুলো মরুভূমির প্রখর তাপে স্বর্গীয় প্রশান্তি এনে দিতে পারে। মরুদ্যানের সীমানা থেকে দূর দিগন্তে ছড়িয়ে গেছে অসীম বালিয়াড়ি, যার দর্শন মনে মরু অভিযানের অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে।

আইন জেডি, ইসরাইল

মৃতসাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত আইন জেডি মরুদ্যান ইসরাইলের অন্যতম সেরা পর্যটন আকর্ষণ। জেরুজালেম থেকে আইন জেডি একদমই কাছে। এখানে রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন, বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান এবং বিচিত্র প্রাকৃতিক দৃশ্যের হাতছানি।

বিচিত্র গাছগাছালিতে সমৃদ্ধ আইন জেডি; Source: wikimedia commons

‘আইন জেডি’ অর্থ ‘Spring of kid’। এখানে জনপ্রিয় কিছু হাইকিং ট্রেইল রয়েছে। ঝর্ণার আশেপাশে ঐতিহাসিক কিছু স্থাপনাও রয়েছে।

নাইজার, তিউনিশিয়া, আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশে এমন আরো অসংখ্য মরুদ্যান আছে। প্রকৃতির সৃষ্টিবৈচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন মরুভূমিতে বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করে মরুদ্যান। সেইসাথে মরুভূমির বিপদসঙ্কুল প্রান্তরে একটুখানি নিরাপত্তা আর প্রশান্তির আশ্রয়ও পাইয়ে দেয়। মরুদ্যান একটি ব্যাপক পর্যটন সম্ভাবনাও, যা মরুভূমি প্রধান দেশগুলোর অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কখনো সুযোগ পেলে দারুণ সুন্দর এই মরুদ্যানগুলো ঘুরে আসতে ভুলবেন না!

ফিচার ইমেজ- stopovertrips

Related Articles