Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জিল্যান্ডিয়া: পৃথিবীর বুকে জেগে ওঠা নতুন এক মহাদেশ

সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে আছে কতই না ঐশ্বর্য, আর কতই না রহস্য! এভাবে সমুদ্রের তলায় রহস্যের সন্ধান করতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা এক চরম বিস্ময়ের খোঁজ পেলেন, যা ছিল এক কথায় অবিশ্বাস্য! প্রথম দিকে অনেকেই দ্বিধান্বিত ছিলেন এই ভেবে যে, সত্যিই কি তারা আবিষ্কার করতে চলেছেন কোটি কোটি বছর ধরে প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে শুয়ে থাকা নতুন এক মহাদেশ!

নিউজিল্যান্ড উপকূলের একটি দৃশ্য। ছবিসূত্র: 27vakantiedagen.nl

‘জিল্যান্ডিয়া’ হলো সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীদের সন্ধান পাওয়া এক নতুন অঞ্চলের নাম। গবেষকদের দাবি, মহাদেশ হিসেব স্বীকৃতি পাওয়ার সব ধরনের যোগ্যতাই রয়েছে এই অঞ্চলটির। এটি অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব পাশে অবস্থিত। এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অ্যান্টার্কটিকা, ইউরোপ এবং অস্ট্রেলিয়া- এই সাতটি মহাদেশের বাইরে অষ্টম মহাদেশ হিসেবে ‘জিল্যান্ডিয়া’কে তালিকাভুক্ত করার জন্য বিজ্ঞানীরা জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন।

জিল্যান্ডিয়ার মানচিত্র। ছবিসূত্র: TRT World

নতুন মহাদেশটি কোথায় অবস্থিত? কবে, কোথায়, কীভাবে এর জন্ম হলো? কেনই বা এই নামকরণ? কেমন হবে মহাদেশটির আকার? আয়তনের  দিক থেকে কি অন্য সব মহাদেশের সমকক্ষ হবে, নাকি শুধু ক্ষুদ্র একটি মহাদেশ হিসেবে এই পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব জানান দেবে জিল্যান্ডিয়া? কী জন্যই বা বিজ্ঞানীরা এতটা উঠেপড়ে লেগেছেন একে মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য? চলুন তাহলে মনের মধ্যে জমে থাকা এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।

জিল্যান্ডিয়ার দক্ষিণ অংশের মানচিত্র। ছবিসূত্র: wikimedia commons

১৯৯৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ব্রুস লুয়েন্ডিক ‘জিল্যান্ডিয়া’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। ১৯৬০ সালে সমুদ্রের নিচে তেলের খনি অনুসন্ধানের সময় এই মহাদেশের অস্তিত্ব খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা। তারপর জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আরো বিস্তৃত গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এ সময় বিজ্ঞানীদের হাতে এমন কিছু তথ্য আসে যার উপর ভিত্তি করে তারা জিল্যান্ডিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

জিল্যান্ডিয়া একটি প্রায় নিমজ্জিত মহাদেশীয় ভূ-খণ্ড। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে এক বিশাল অঞ্চল এই জিল্যান্ডিয়া, এটি মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য বলেই দাবি বিজ্ঞানীদের। জিল্যান্ডিয়ার অধিকাংশ অঞ্চলই পানির নিচে নিমজ্জিত। নিউজিল্যান্ড হচ্ছে এই মহাদেশের জেগে থাকা একমাত্র পবর্তের চূড়া।

জিল্যান্ডিয়ার ভূ-প্রকৃতিগত অবস্থান। ছবিসূত্র: wikimedia commons

সমুদ্র তলদেশ থেকে প্রায় ১২,২১৭ ফুট উচ্চতায় এই মহাদেশের অবস্থান। নিউজিল্যান্ডের জিএনএস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের গবেষণায় উঠে আসে মহাদেশটি সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য। মহাদেশটি খুবই সম্পদশালী। এর সমুদ্রের নিচে রয়েছে বিপুল পরিমাণের জীবাশ্ম জ্বালানি, যা পৃথিবীর ভবিষ্যতের দীর্ঘ সময়ের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এর মূল্য হবে বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। বিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্য মতে, ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে অস্ট্রেলিয়া এবং অ্যান্টার্কটিকার চেয়ে একেবারেই আলাদা হবে এই জিল্যান্ডিয়া মহাদেশ।

নতুন মহাদেশ হিসেবে জিল্যান্ডিয়ার অবস্থান (ধূসর অংশটি)। ছবিসূত্র: Maritime NZ

৬-৮.৫ কোটি বছর আগে এটি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং ক্রমাগত পানির নিচে নিমজ্জিত হতে থাকে। পরবর্তীতে ৮.৫-১৩ কোটি বছর আগে জিল্যান্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ও অ্যান্টার্কটিকা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, ২৩ কোটি বছর আগে সম্ভবত মহাদেশটি সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ছিল। বর্তমানে মহাদেশটির সিংহভাগই প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে নিমজ্জিত। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম মহাদেশীয় ভূখন্ডাংশ বা অনুমহাদেশ যার আয়তন প্রায় ৪৯,২০,০০০ কি.মি.।

আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিউজিল্যান্ডের সামুদ্রিক সীমানা। ছবিসূত্র: Maritime NZ

জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব আমেরিকা’-এর প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বিজ্ঞানীরা এই মহাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন। এটি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের সমান। শুধুমাত্র নিউজিল্যান্ডের নর্থ ও সাউথ আইল্যান্ড এবং নিউ ক্যালিডোনিয়া ছাড়া বাকি অংশ জলের তলাতেই রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, জিল্যান্ডিয়ার প্রায় ৯৪ শতাংশই দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নিচে তলিয়ে আছে। পানির উপরে জেগে রয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। এ কারণেই বিজ্ঞানীরা এ মহাদেশের নাম দিয়েছেন জিল্যান্ডিয়া। মহাদেশটি যেহেতু দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের পানির নিচে, সেহেতু নিউজিল্যান্ড এবং ইন্ডিয়া এ দুটি দেশের নাম মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা মহাদেশটির নাম রেখেছেন জিল্যান্ডিয়া।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিউজিল্যান্ড আসলে এই মহাদেশেরই জেগে থাকা অংশ। বলা যেতে পারে, এই মহাদেশের পর্বতচূড়া। নিউজিল্যান্ডের আদি নাম ছিল গন্ডোয়ানা। ৮৫ মিলিয়ন বছর আগে গন্ডোয়ানা বিভক্ত হয়। তখনই সৃষ্টি জিল্যান্ডিয়ার। তবে এর আলাদা হবার ঘটনাটি অদ্ভুত, এটি বিচ্ছিন্ন হবার পর পুরোপুরি ভেঙে না গিয়ে নিজ ক্ষেত্রে একটু প্রসারিত হয়ে যায়। এই মহাদেশ আকারে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সমান এবং ইউরোপের অর্ধেক।

সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে থাকা নতুন মহাদেশ জিল্যান্ডিয়া। ছবিসূত্র: The Odyssey Online

আপাতদৃষ্টিতে জিল্যান্ডিয়াকে বৃহৎ এবং সমন্বিত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। এর অর্থ দাঁড়ায়, জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশ হিসেবে দাবি করা যায় না। এমন যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন একদল গবেষক। কিন্তু সম্প্রতি স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এবং সমুদ্র তলের মাধ্যাকর্ষণ মানচিত্র ব্যবহার করে জিল্যান্ডিয়াকে একটি সমন্বিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রের প্রায় ৩,২৮০ ফুট নিচে নতুন এই মহাদেশটির সীমারেখা দেখতে পাওয়ার পর থেকেই তার উপর ভিত্তি করে ভূতাত্ত্বিকগণ জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশ হিসেবে মেনে নেয়া যায় বলে জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেন।

জিল্যান্ডিয়ার কিছু মাটি ও পাথরের নমুনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। এর মাটির সাথে মহাদেশ ভিত্তিক যে ভূখণ্ড রয়েছে তার আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। কিন্তু সমুদ্রের তলদেশের গঠনের সাথে এই মাটির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশ হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ১১ জন ভূতাত্ত্বিকের দীর্ঘ গবেষণার ফলাফল এই যে, একটি মহাদেশ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় চারটি বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান জিল্যান্ডিয়ার। এর মধ্যে আছে ভূখণ্ডের উচ্চতা, মহাসাগরীয় ভূত্বকের তুলনায় উচ্চ অবস্থান, বৈচিত্র্যময় ভূখণ্ডের আগ্নেয়গিরি, রূপান্তরিত ও পাললিক শিলার উপস্থিতি এবং সমুদ্রের তলদেশের ঘনত্ব গতানুগতিকতার চেয়ে বেশি- এসব বৈশিষ্ট্য। ফলে মহাদেশ হিসেবে বিবেচিত হবার জন্য অবস্থানে আছে জিল্যান্ডিয়া।

গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মানচিত্রে দেখানো কালো বিন্দুগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানান দিচ্ছে। ছবিসূত্র: GNS Science

গবেষণায় অংশগ্রহণকারী বিজ্ঞানী হামিশ ক্যাম্পবেল ২০০৭ সালে তার প্রকাশিত হওয়া ‘ইন সার্চ অব এনশিয়েন্ট নিউজিল্যান্ড’ শীর্ষক বইয়ে নতুন এই মহাদেশের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, “আগে পুরো জিল্যান্ডিয়া মহাদেশটিই জলের তলায় ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে প্লেট মুভমেন্টের ফলে জলের উপরে উঠে আসে নিউজিল্যান্ড। বর্তমানে নিউজিল্যান্ড এবং প্রশান্ত মহাসাগরের আরো একটি দ্বীপ রাষ্ট্র ফরাসি উপনিবেশ নিউ ক্যালিডোনিয়ার মধ্যবর্তী অংশেই জিল্যান্ডিয়ার অবস্থান।” নিউজিল্যান্ডের ভূতত্ত্ববিদ নিক মরটিমার মতে, জিল্যান্ডিয়া নিয়ে বিজ্ঞানীরা দুই দশকের বেশি সময় নিয়ে গবেষণা করছেন।

স্বীকৃতি পেলে মানচিত্রে জিল্যান্ডিয়ার অবস্থান। ছবিসূত্র: Nature

মরটিমা আরো বলেন, একটি মহাদেশ হতে যা দরকার তার চেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব রয়েছে এই জিল্যান্ডিয়ার। মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে প্রয়োজনীয় সকল কোটা পূরণ করেছে এই ভূখণ্ড। তাই একে মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায় বলেই তার অভিমত।

যদি এটি মহাদেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তবে ৪.৯ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার (১.৮৯ মিলিয়ন বর্গ মাইল) আয়তনের জিল্যান্ডিয়া হবে পৃথিবীর অষ্টম এবং ক্ষুদ্রতম মহাদেশ। আশা করা যাচ্ছে এখন থেকে মানচিত্রে জিল্যান্ডিয়ার অবস্থান নতুন করে দেখানো হবে। সাতটি মহাদেশের সাথে যোগ হবে নতুন আরেকটি মহাদেশের।

কালের আবর্তে পৃথিবীতে কি জেগে উঠবে নতুন এক মহাদেশ? এর উত্তর পাওয়া যাবে আগামী দিনগুলোতেই।

ফিচার ইমেজ: TripAdvisor

Related Articles