অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স: ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবমান পৃথিবী

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আশীর্বাদ হলো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার। এর ফলে এমন অনেক রোগের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলোর কারণে একসময় মানুষ মারা পর্যন্ত যেত। কিন্তু এখন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে মানুষ কয়েকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে, দিব্যি হেঁটে-চলে বেড়াতে পারছে। সুতরাং অ্যান্টিবায়োটিকের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তবে সম্প্রতি নতুন করে সামাজিক মাধ্যমের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, এবং তা মোটেই ইতিবাচক কোনো কারণে নয়। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট একপ্রকার ব্যাকটেরিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে, যা নাকি অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর বুক থেকে প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে পারে। তাই আর দেরি না করে, চলুন এ বিষয়ে প্রাথমিক ধারণাটুকু নিয়ে আসি।

ব্যাকটেরিয়া কী?

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের জেনে নেয়া দরকার, ব্যাকটেরিয়া কী। এটি মূলত সংগঠিত নিউক্লিয়াসবিহীন এককোষী, আণুবীক্ষণিক একদল অণুজীব। এর প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১৫,০০০। সব ব্যাকটেরিয়াই খারাপ নয়। বরং অনেক ব্যাকটেরিয়াই, এমনকি আমাদের অন্ত্রে বাস করা বেশিরভাগই, অত্যন্ত উপকারী। তবে ব্যাকটেরিয়ার ক্ষতিকর দিকই সচরাচর আমাদের নজরে বেশি পড়ে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম আশীর্বাদ অ্যান্টিবায়োটিক; Image Source: Diet Doctor

অ্যান্টিবায়োটিক কী?

অ্যান্টিবায়োটিকের অপর নাম অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ। এগুলো হলো এমন একধরনের ওষুধ যা মানুষ এবং পশু উভয়ের শরীরেই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এক্ষেত্রে তারা হয় ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে, নয়তো ব্যাকটেরিয়ার দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার রোধ করে। তবে অ্যান্টিবায়োটিক কেবল নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়াঘটিত ইনফেকশনই প্রতিরোধ করে। ভাইরাসের উপর এরা কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কী?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলো এমন একটি অবস্থা যা সংগঠিত হয়, যখন কতিপয় ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। এসব ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এরা অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে অভিযোজিত হয়ে যায় বলে, নিজেদের স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। ফলে মানুষ বা পশুর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে তাদের রোগ সেরে যেত, এখন আর সেই অ্যান্টিবায়োটিকে তা সারে না, বরং ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং এসব রোগাক্রান্ত মানুষ বা পশু অন্য কারো উপস্থিতিতে হাঁচি-কাশি প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের শরীরের আভ্যন্তরীণ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়, এবং তারাও একই রকম দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়।

যেভাবে ঘটে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স; Image Source: The Panama News

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কেন ঘটে?

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ঘটে ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-তে পরিবর্তন বা পরিব্যক্তির ফলে। এছাড়া জিন অপসারণের মাধ্যমেও এক প্রজাতির অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার জিন থেকে অন্য প্রজাতির সাধারণ ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স লাভ করতে পারে। এর ফলে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে এমন সব পরিবর্তন আসে যে, ওই ব্যাকটেরিয়ার জন্য বিদ্যমান অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হলেও, সেটি কোনো ক্ষতি ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। বিষয়টি অনেকটা এমন যে, দশটি ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে আটটি হয়তো সাধারণ, কিন্তু দুটি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। এখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হলে, সাধারণ আটটি ব্যাকটেরিয়া মরে যাবে, কিন্তু বাকি দুটি ব্যাকটেরিয়া টিকে থাকবে, এবং তারা শারীরিক বৃদ্ধি ও বংশবিস্তারের মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তির রোগকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে থাকবে।

একটি-দুটি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ায় পরবর্তীতে বংশবিস্তারের মাধ্যমে বৃহদাকার ধারণ করতে পারে; Image Source: Genome Research Limited

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কেন বাড়ছে?

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স একটি বিশাল বড় চিন্তার কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কেননা সময়ের সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়াদের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ক্ষমতা লাভের প্রবণতা কমছে না, বরং হু হু করে বেড়ে চলেছে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে অত্যধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার। সামান্য কোনো অসুখ হলেই মানুষ অ্যান্টিবায়োটিকের দিকে ঝুঁকছে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ব্যতিক্রমী দুই-এক ক্ষেত্রে রোগীর দেহে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া থেকে যাচ্ছে যাদের উপর অ্যান্টিবায়োটিক কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। এদিকে তারা অ্যান্টিবায়োটিকের সান্নিধ্যে আসার মাধ্যমে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশল শিখে ফেলছে, এবং পরবর্তীতে তাদের মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন ব্যাকটেরিয়ার মধ্যেও একই গুণাগুণ দেখা দিচ্ছে। এভাবে তারা নিজ হোস্টের (যার শরীরে বাসা বেঁধেছে) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তো কমিয়ে দিচ্ছেই, পাশাপাশি সেই হোস্ট অন্যদের কাছে গেলে, অন্যদের শরীরেও তারা ঢুকে পড়ার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। এভাবে একজনের শরীরে এক প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ক্ষমতা লাভ করলে, পরবর্তীতে সেটি অন্য আরো অনেকের শরীরেও সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর ১০ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া; Image Source: Longitude Prize

কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স দূর করা যায়?

যেমনটি আমরা আগেই জেনেছি, কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরও সব ব্যাকটেরিয়া মারা যাচ্ছে না বা নিষ্ক্রিয় হচ্ছে না, এবং তারাই পরবর্তীতে নতুন আরো অনেক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার জন্ম দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো, অনেক রোগীই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের পুরো কোর্স সম্পন্ন করে না। একজন রোগীকে হয়তো সাতদিনের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে দুদিন ওষুধ খেয়েই সুস্থ অনুভব করায় আর ওষুধ খাওয়া প্রয়োজন মনে করল না। এক্ষেত্রে যা হতে পারে তা হলো: ওই ব্যক্তির শরীরের অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়াই মারা গেছে, কিন্তু সামান্য কিছু ব্যাকটেরিয়া টিকে আছে। ওষুধের পুরো কোর্স সম্পন্ন করা হলে তারাও হয়তো মারা যেত। কিন্তু যেহেতু পুরো কোর্স সম্পন্ন করা হয়নি, তাই তারা বহাল তবিয়তে আছে, এবং অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে অভিযোজনের কৌশল রপ্ত করে ফেলেছে। তাই ভবিষ্যতে তারা আবারো বংশবিস্তারের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে রোগাক্রান্ত করে তুলবে। কিন্তু এবার আর আগের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহারের পরও ওই ব্যক্তির রোগমুক্তি ঘটবে না। এজন্য একজন ব্যক্তিকে আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মনে হলেও, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে নির্ধারিত কোর্স অবশ্যই সম্পন্ন করতে হবে।

এছাড়াও আরো যেসব ব্যাপার মেনে চলতে হবে:

  • কেবলমাত্র সার্টিফাইড চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে;
  • চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীকে জোর করা যাবে না অ্যান্টিবায়োটিক দিতে;
  • অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর বলে দেয়া সকল নিয়মকানুন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে;
  • অন্যের বেঁচে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে না, কিংবা নিজের অ্যান্টিবায়োটিক অন্যকে দেয়া যাবে না;
  • সংক্রমণ রোধে নিয়মিত হাত ধুতে হবে, স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করতে হবে, যেখানে-সেখানে কফ-থুতু ফেলা যাবে না, পরিষ্কার রুমাল বা টিস্যুতে নাক-মুখ চেপে হাঁচি দিতে হবে, রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সংসর্গ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে, নিরাপদ শারীরিক মিলন করতে হবে, ভ্যাক্সিনেশন হালনাগাদ করতে হবে;
  • এছাড়াও দেশের ফার্মেসিগুলোকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি, যাতে কেউ বিনা প্রেসক্রিপশনে ক্রেতার কাছে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি না করে।
অতি সামান্য রোগেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রবণতা দূর করতে হবে; Image Source: Shutterstock

শেষ কথা

মানুষ ও পশুর দ্রুত রোগমুক্তি ও গড় আয়ু বৃদ্ধিতে অ্যান্টিবায়োটিকের অবদানের শেষ নেই। কিন্তু কথায় আছে না, লেবু বেশি কচলালে তেতো হয়ে যায়, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রেও ঠিক যেন তেমনটাই হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত রোগমুক্তি ঘটে বটে, কিন্তু তাই বলে এর যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদেরকে খুবই ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। সামান্য একটু অসুস্থ হলেই আজকাল আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি, চিকিৎসককে বলে অ্যান্টিবায়োটিক নিই। অনেকে তো আবার চিকিৎসকের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে আনি। এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের শরীরটাকে এমন বানিয়ে ফেলছি যে, অন্যান্য সমস্যা তো আছেই, এমনকি আমাদের শরীর অতি সাধারণ কোনো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেও একা একা লড়াইয়ের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এভাবে নিজেদের অজান্তেই আমরা অ্যান্টিবায়োটিক-পরবর্তী যুগের দিকে এগিয়ে চলেছি, যখন অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না, ফলে নিউমোনিয়া, মেনিনজাইটিস, স্ট্রেপ থ্রোট, টিউবারকুলোসিস, লাইম ডিজিজ, কানে পচন কিংবা দেহত্বকে ঘায়ের মতো ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে আবারো মানুষ প্রাণ হারাতে শুরু করবে। অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ও যথেচ্ছ ব্যবহারে যদি লাগাম না টানি, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বড় কঠিন সময়ের মোকাবেলা করতে হবে।

চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about antibiotics resistance, which could cause huge trouble to humankind in near future. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © The Conversation

Related Articles

Exit mobile version