Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ব্রুকসিজম বা দাঁত কামড়ানো: বদঅভ্যাস নাকি অসুখ?

X এর বয়স পাঁচ বছর তিন মাস। বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান, তাই যত্নঅাত্তির কোনো কমতি নেই। সমবয়সী অন্যান্য শিশুদের তুলনায় সে অনেক শান্তশিষ্ট এবং চুপচাপও থাকে। একদিন রাতে শোবার সময় X এর মা খেয়াল করলেন, ঘুমের ঘোরে তার সন্তান দাঁত কিড়মিড় করছে। মা ভাবলেন, হয়তো ছেলে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে, তাই এই দাঁত কিড়মিড়ি। অাপনা থেকেই সেরে যাবে। তাই এ ব্যাপারে তিনি অার খুব একটা পাত্তা দিলেন না।

কিন্তু সমস্যা দিন দিন অারো জটিল অাকার ধারণ করতে লাগলো। X এর জোরে দাঁত ঘষার অভ্যাস তো গেলই না, উল্টো অারো তীব্র অাকার ধারণ করলো। জোরে দাঁত ঘষার শব্দের জ্বালায় X এর পাশে কেউ ঘুমুতেই চায় না। কিছুদিন বাদে দেখা গেলো, X এর উপরের চোয়ালের দাঁতগুলো সব ক্ষয়ে গেছে। তার মুখ ও চোয়ালে প্রচন্ড ব্যথা, যার কারণে সে কোনো খাবারই মুখে তুলতে পারছে না।

বাবা-মা ভাবলেন বোধহয় X এর পেটে কৃমি হয়েছে, তাই সে এরকম করছে। তারা তাকে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে শুরু করলেন। কিন্তু কোনো উপকার হলো না। অগত্যা তারা সন্তানকে নিয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, একটি বিশেষ ব্যাধিতে ভুগছে তাদের ছেলে, যার নাম ব্রুকসিজম।

ব্রুকসিজম; Image Source: dcmouthguards.com

ব্রুকসিজম কী?

মূলত অামাদের সবারই কম-বেশি দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস রয়েছে। অামরা অনেকেই যখন রাগান্বিত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকি, তখন অবচেতন মনে দাঁত কামড়াই। একে একটি সাধারণ বিষয় বলে মনে করা হলেও এটি একটি রোগ ছাড়া কিছুই নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে ব্রুকসিজম বলা হয়। খুব অল্প হলে এটি তেমন কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু যদি কারো অনবরত বা মাত্রাতিরিক্ত দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস থাকে তাহলে এ অবস্থা থেকে তার চোয়ালের সমস্যা, মাথা ব্যথা, দাঁতের ক্ষয় এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। এটিকেই বলে ব্রুকসিজম।

ঘুমের মধ্যেও অনেকেরই দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস রয়েছে, যা স্লিপ ব্রুকসিজম নামে পরিচিত। শিশুরা ঘুমের মধ্যে দাঁত কামড়ালে অনেক অভিভাবকই চিকিৎসকের কাছে এসে বলেন শিশুর পেটে কৃমি হয়েছে। আবার অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াও শিশুদের কৃমিনাশক সেবন করিয়ে থাকেন। আসলে দাঁত কামড়ানোর সঙ্গে পেটে কৃমি থাকার কোনো ধরনের সম্পর্কই নেই।

ইতিহাস

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মরিৎজ ক্যারলি নামের ভিয়েনার এক দন্তবিদ রোগটি সবার গোচরে অানেন। তিনি একে ট্রমাটিক নিউরালজিয়া নামে অভিহিত করেন এবং এটিকে পেরিওডন্টাইটিস রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

১৯০৭ সালে মেরি পিয়েতকেউইজ “La bruxomanie” শব্দটি প্রচলন করেন। ১৯৩১ সালে বারট্রান্ড ফ্রম্যান ব্রুকসিজম শব্দটি উদ্ভাবন করেন। অনেকের মতে, ব্রুকসিজম শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘brychien odontas’ থেকে, যার অর্থ দাঁত চিবিয়ে কথা বলা।
বিখ্যাত মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনে করতেন, ব্রুকসিজমের সাথে মানুষের মনোদৈহিক বিকাশের গভীর যোগাযোগ রয়েছে।

ব্রুকসিজমে অাক্রান্ত দাঁত এবং স্বাভাবিক দাঁতের পার্থক্য; Image Source: royaldentalusa.com

শ্রেণীবিন্যাস

ব্রুকসিজম কে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

১. প্রাইমারি (ইডিওপ্যাথিক) ব্রুকসিজম: যখন দাঁত কামড়ানোর পেছনে মানবদেহের স্নায়ুবিক ও শারীরবৃত্তীয় কারণ (যেমন: রোগ, মানসিক ব্যাধি, জীবাণুর সংক্রমণ) জড়িত থাকে।

২. সেকেন্ডারি (ইরাটোজেনিক) ব্রুকসিজম: যখন দাঁত কামড়ানোর পেছনে কোনো পরিবেশগত কারণ (যেমন: ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মাদকদ্রব্য, দূষণ) জড়িত থাকে।

প্রাইমারি ব্রুকসিজমকে অাবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়।

জাগ্রত ব্রুকসিজম: এটি মূলত দিনের বেলায় সংঘটিত হয়। মূলত দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ থেকেই এই ব্রুকসিজমের উৎপত্তি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর বিশ শতাংশ এবং শিশুদের অাঠারো শতাংশ এ রোগে অাক্রান্ত।

ঘুমন্ত ব্রুকসিজম: এটি রাতের বেলায় সংঘটিত হয়। ব্রুকসিজমের মধ্যে স্লিপ ব্রুকসিজমেরই প্রাধান্য বেশি (প্রায় ৮০ শতাংশ ব্রুকসিজমই স্লিপ ব্রুকসিজম) এবং শিশুদের মধ্যে অধিক দেখা যায়। এটি অনৈচ্ছিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত অর্থাৎ এর ওপর রোগীর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে বললেই চলে।

ঘুমন্ত ও জাগ্রত ব্রুকসিজম; Image Source: cerezen.eu

কারণ

ব্রুকসিজম হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে

শারীরিক কারণ: উপরের এবং নিচের চোয়ালের অবস্থান যথাযথ না হলে স্নায়ুর প্রদাহের কারণে ব্রুকসিজম হতে পারে।

মানসিক কারণ: মানসিক চাপ ব্রুকসিজম সৃষ্টি করে। যেমন: দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ, ভীতি, অবদমিত রাগ ও হতাশা কিংবা অতি প্রতিযোগিতামূলক, আক্রমণাত্মক, অতিচঞ্চল মনোভাব থেকেও এমন হতে পারে।

বয়স: দেখা গিয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে দাঁত কামড়ানোর প্রবণতা বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের ব্রুকসিজমের সাথে গ্রোথ এবং ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, শিশুদের ক্ষেত্রে দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস হয়ে থাকে এজন্যই যে তাদের উপরের এবং নিচের দাঁত সব সময় সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। অন্যরা মনে করেন শিশুরা দাঁত কামড়ায় ভয়, রাগ, এলার্জিজনিত সমস্যা থেকে। এছাড়া কান বা দাঁতের ব্যথা থেকেও শিশুরা এমনটি করতে পারে।

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: বিষণ্নতানাশক ওষুধসহ মানসিক রোগের অন্য ওষুুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও কমক্ষেত্রে ব্রুকসিজম দেখা যেতে পারে।

বংশগত কারণ: দেখা গেছে যেসব পরিবারে পিতা-মাতার ব্রুকসিজমের ইতিহাস রয়েছে, তাদের রোগে অাক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি।

রোগজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

(i) বিভিন্ন শারীরিক রোগ যেমন: পারকিনসন্স ডিজিজ, হান্টিংটন ডিজিজ, স্লিপ অ্যাপানিয়া, ডাউন সিনড্রোম।

(ii) মানসিক ব্যধি যেমন: মৃগী, ডিমেনশিয়া, ডিপ্রেশন, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার-অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার- এ সকল রোগের জটিলতা হিসেবে ব্রুকসিজম হতে পারে। এক গবেষণায় দেখা যায়, সেরেব্রাল পালসি রোগাক্রান্ত শিশুরা অন্যদের তুলনায় অধিক দাঁত কামড়ায়।

মাদকদ্রব্য: ক্যাফেইন, টোবাকো, কোকেন, এম্ফিটামিন বা ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনের কারণে ব্রুকসিজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

উপসর্গ

• এত জোরে দাঁতে দাঁত ঘষা যা অনেক সময় পাশে ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিকে পর্যন্ত জাগিয়ে দিতে পারে।
• দাঁতের উপরিভাগ ক্ষয় হয়ে সমান হয়ে যাওয়া।
• দাঁতের এনামেল ক্ষয় হলে যাওয়া।
• দাঁতের সংবেদনশীলতা বেড়ে যাওয়া।
• ক্রমাগত চোয়ালের মাংসপেশীর সংকোচনের কারণে কানে প্রদাহ।
• সকালবেলা হালকা মাথাব্যথা হওয়া।
• চোয়াল বা মুখেব্যথা হওয়া।
• চোয়ালের মাংসপেশী শক্ত হয়ে যাওয়া।
• জিহ্বায় দাগ পড়া।
• গালের ভেতরে দাঁতের ছাপ পড়া।

ব্রুকসিজমের উপসর্গ; Image Source: cerezen.eu

জটিলতা

ব্রুকসিজম হলে নিম্নলিখিত জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে।

• উপরের পাটি ও নিচের পাটির সবগুলো দাঁত বাধানোর ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হওয়া।
• দাঁতের ইমপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়া।
• যথাযথ কামড় বা বাইট না পড়ার কারণে মুখের অভ্যন্তরে মিউকাস মেমব্রেনে আঘাত লেগে মুখের আলসার হওয়া।

চিকিৎসা

এর চিকিৎসা পদ্ধতি ৩ ভাগে বিভক্ত।

১. সার্জারি

• প্রয়োজনে স্প্রিন্ট ও মাউথ গার্ড ব্যবহার করা।
• ক্ষেত্রবিশেষে আকাঁ-বাঁকা দাঁত ব্রেস বা সার্জারি করে ঠিক করা যায়।

২. থেরাপি

• স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য কাউন্সিলিং।
• বিহেভিয়ার থেরাপি। কিভাবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে উপরের পাটি ও নিচের পাটির দাঁত চেপে রাখা যায় দাঁতের ডাক্তারের কাছ থেকে সে পরামর্শ নেওয়া।

৩. ওষুধ

ওষুধ এক্ষেত্রে খুব একটা ভালো কাজ করে না। তবে পেশীতে ব্যথা হলে ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ বা খুব শক্ত হয়ে গেলে ইনজেকশন দেওয়া হয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। রোগীর অবস্থাভেদে মানসিক চাপ মুক্ত করার জন্য কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট অথবা ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে একটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যে, সব রোগীর জন্য একই ওষুধ প্রয়োগ করা যায় না, যদিও রোগের ধরন একই। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা গ্রহণ করবে না।

শিশুদের ক্ষেত্রে ৫-৬ বছর বয়সে ব্রুকসিজম বা দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস দেখা যেতে পারে। সাধারণত ১০ বছর বয়সের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।

ব্রুকসিজম প্রতিরোধ; Image Source: blog.biolase.com

করণীয়

• সবার জন্য অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা দুঃশ্চিন্তা এড়িয়ে চলতে হবে।
• নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি গ্রহণে বিরত থাকতে হবে।
• রাতে ঘুমানোর আগে প্রস্রাবের বেগ থাকলে প্রস্রাব করে ঘুমোতে যেতে হবে।
• হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে সময় নিয়ে রোগীর বিস্তারিত ইতিহাস জেনে রোগ নির্ণয় করে তবেই একটি সঠিক সিদ্ধান্তে এসে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।

Related Articles