Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যান্সার ট্রেন: এক করুণ উপাখ্যান

ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি ছোট কৃষিপ্রধান শহর ভাটিন্ডা। শহরটির মতোই অখ্যাত তার রেলওয়ে ষ্টেশনটি। কিন্তু রাত ৯টা বাজতেই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠে। কারণ প্রতিদিন রাত প্রায় ৯.৩০ টার দিকে ভাটিন্ডা রেল ষ্টেশন থেকে একটি ট্রেন ছেড়ে যায় রাজস্থানের বিকানের শহরের উদ্দেশ্যে। ভারতীয় রেলওয়ের দেওয়া নাম ও নাম্বার হলো আবোহার যোধপুর প্যাসেঞ্জার-৫৪৭০৩। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এখন আর ট্রেনটিকে সেই নামে ডাকেন না। ট্রেনটি এখন সবার কাছেই অধিক পরিচিত ক্যান্সার ট্রেন নামে।

৫৪৭০৩ নম্বর ট্রেনটির এমন নামকরণের পেছনে আছে এক করুণ কাহিনী। জানা যায়, ট্রেনটি প্রতিদিন প্রায় ৬০-১০০ জন ক্যান্সার রোগী ও তাদের পরিবার সহ প্রায় দুই শতাধিক যাত্রী বহন করে নিয়ে যায় রাজস্থানের বিকানের শহরে। রোগীদের সবাই বিকানেরের একটি আঞ্চলিক ক্যান্সার হাসপাতালে যান চিকিৎসা নিতে। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা নিয়মিত এই ট্রেনে যাতায়াত করেন চিকিৎসার প্রয়োজনে।

ভাটিন্ডা জংশন; Image Source: Indianrailinfo

প্রতিদিন রাত প্রায় সাড়ে নয়টায় ট্রেনটি ছেড়ে যায় ভাটিন্ডা ষ্টেশন এবং ভোর ছয়টার দিকে পৌঁছায় বিকানের ষ্টেশনে। ৪৪ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতির ট্রেনটির এই যাত্রার মাঝখানে আছে ২৬টি বিরতি। অনেক দিন এমনও হয় ট্রেনটি নির্দিষ্ট সময় থেকে দুয়েক ঘন্টা দেরিতে পৌঁছায়। জানা যায়, মোট যাত্রীর ৬০ ভাগই বিভিন্ন বয়সের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী। গত এক দশকে এই কারণেই ট্রেনটি লাভ করেছে ক্যান্সার ট্রেন নামক কুখ্যাতি।

১২ কোচের এই ট্রেনটিতে পাঞ্জাব প্রদেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকেই রোগীরা মূলত বিকানের যাওয়ার জন্য জড়ো হন। ট্রেনটি প্রতিদিনই তার ধারণ ক্ষমতার সর্বোচ্চ সংখ্যক যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। টিকেটের মূল্য ২১০ রুপি হলেও রোগীদের কাছ থেকে কোনো দাম নেওয়া হয় না এবং রোগীর সাথের একজন স্বজন টিকিটের দামের উপর পঁচাত্তর শতাংশ ছাড় পান। ট্রেনটিতে মাত্র একটি স্লিপার কম্পার্টমেন্ট আছে যাতে যাত্রীরা শুয়ে শুয়ে যাতায়াত করতে পারেন। বাকি সব কম্পার্টমেন্ট ‘সাধারণ’ ক্যাটাগরির যাতে জায়গা পেতে মোটামুটি যুদ্ধ করতে হয়।

পাঞ্জাবের ভাটিন্ডা থেকে রাজস্থানের বিকানের এর দূরত্ব প্রায় ৩২৫ কিলোমিটার, আট ঘন্টার এক লম্বা সফর – কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন অসুস্থ শরীর নিয়ে এভাবে লোকজন বিকানের এর দিকে ছুটে যাচ্ছে?

রোগী বহন করে যে ট্রেন; Image Source: Washington Post

এই যাত্রার একমাত্র কারণ বিকানেরের আচার্য তুলসী রিজিওনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের বিনামূল্যের চিকিৎসা এবং ন্যায্য মূল্যের ঔষধপত্র। দেখা গেছে, ৫৪৭০৩ নাম্বার ট্রেনটির ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের বেশীরভাগই দক্ষিণ পাঞ্জাবের সাধারণ কৃষক অথবা খেটে খাওয়া গরীব মানুষ। যাদের চিকিৎসার খরচ জোটাতে হিমশিম খেতে হয়। এজন্যই কেউ জমি বেচে আর কেউ ধার দেনায় মিটিয়ে চলেছেন ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার খরচ।

এখন প্রশ্ন হলো, পাঞ্জাবে কি তবে ক্যান্সার চিকিৎসার কোনো সুব্যবস্থা নেই? উত্তরে বলা যায়, আছে। ক্যান্সারের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদী। পাঞ্জাবের অনেক হাসপাতালেই বিশেষায়িত ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে তবে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এটি বিবেচনায় নিয়েই পাঞ্জাব সরকার চালু করেছে, মুখ্যমন্ত্রী পাঞ্জাব ক্যান্সার রাহাত কোষ স্কিম (MMPCRKS); যা থেকে ক্যান্সার রোগীদের নগদ আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগ আছে রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যাতিরেকে এই সাহায্য পাওয়া ভীষণ কঠিন। তাছাড়াও, চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়া এবং সরকারি হাসপাতালগুলোতে গরীব রোগীদের প্রতি অবহেলা করা সহ অনেক অভিযোগ পাওয়া যায় খোদ রোগীদের কাছ থেকেই।

আচার্য তুলসী রিজিওনাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার ভারতের ১৯টি আঞ্চলিক ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারগুলোর মধ্যে অন্যতম। পাঞ্জাব সরকারের মুখ্যমন্ত্রী পাঞ্জাব ক্যান্সার রাহাত কোষ স্কিমের আওতাধীন এই হাসপাতালে বিনামূল্যে ক্যান্সারের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয় এবং স্বল্পমূল্যে ঔষধপত্র দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিকানেরে থাকা খাওয়ার খরচও তুলনামূলকভাবে কম। যেকোনো ধর্মশালায় একটি কক্ষ ৫০ রুপিতে এবং ৫ রুপিতে হাসপাতালের ক্যান্টিনে খাবারের বন্দোবস্ত রয়েছে। এইসব কারণে রোগীদের জন্য হাসপাতালটি হয়ে উঠেছে নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং ভরসার জায়গা।

ট্রেনটিতে আছে ১২টি কোচ বা বগি; Image Source: Wikidata

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে এই দুর্যোগের কারণ কী? এর উত্তর জানতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে পেছনের দিকে। ১৯৬০-৭০ এর দশকে পাঞ্জাবে সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল। সাধারণ কৃষকেরা আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার সুফল পেতে শুরু করেন। যার ফলে উচ্চ ফলনশীল বীজ, নানান ধরনের কীটনাশক ও সার, আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম এর ব্যবহার বেড়ে যায় আর সেখান থেকেই মূল সমস্যার সূত্রপাত বলে অনেকের ধারণা।

অধিক পরিমাণে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ধীরে ধীরে পাঞ্জাবের মাটিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। মাটিতে, পানিতে মিশে যেতে থাকে ভয়ানক রাসায়নিক বিষ। ২০১১ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, যেখানে ভারতের গড় কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ৫৭০ গ্রাম প্রতি হেক্টর সেখানে পাঞ্জাবে এটি ৯২৩ গ্রাম প্রতি হেক্টর। এছাড়াও প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণে শিল্প বর্জ্য পানির সাথে মিশে বিষাক্ত করে তুলছে পাঞ্জাবের ভূগর্ভস্থ পানিকে যা ব্যবহার হচ্ছে ঘরোয়া কাজ থেকে শুরু করে কৃষিকাজে।

পাঞ্জাবের দক্ষিণাঞ্চলের ভাটিন্ডা, ফরিদকোট, মোগা, মুক্তসার, ফিরোজপুর, সাংরুর এবং মানসাসহ আরও কয়েকটি জেলা একত্রে মালওয়া অঞ্চল নামে পরিচিত। পাঞ্জাবের এই অঞ্চল বিশেষভাবে তুলা চাষের জন্য বিখ্যাত। আমেরিকার পরিবেশ সংরক্ষণকারী এজেন্সি বলছে, এই অঞ্চলে তুলাচাষে ব্যবহৃত ১৫টি কীটনাশকের ৭টিতেই ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানের অস্তিত্ব রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কৃষকেরা এই কীটনাশকের ব্যবহার সম্পর্কে এতটাই অজ্ঞ যে, এসব রাসায়নিক দ্রব্যের খালি পাত্রটিও তারা খাবার পানি রাখার জন্য ব্যবহার করেন!

পাঞ্জাবি কৃষক; Image Source: Hindustan Times Photos

কীটনাশকের অধিক মাত্রায় ব্যবহার যে কতটা ক্ষতিকর তার প্রমাণ করতেই যেন মালওয়া অঞ্চলে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি যেখানে তুলাচাষে ব্যাপক কীটনাশকের ব্যবহার সর্বজন স্বীকৃত। পাঞ্জাব স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এর এক সার্ভেতেও এই তথ্য উঠে এসেছে যে, উচ্চ মাত্রার কীটনাশক ব্যবহার করা গ্রামগুলোতেই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। তাছাড়াও শিল্প কারখানার বর্জ্যের সাথে মিশ্রিত ভারী ধাতু এবং কিটনাশকের বিষ সরাসরি নদী-নালার পানির সাথে মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত বিষের সৃষ্টি হচ্ছে যা আবার টিউবওয়েলের পানির সাথে উঠে এসে ব্যবহৃত হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে।

সবুজ বিপ্লব নিশ্চিতরুপে ভারতকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য রপ্তানীকারক দেশে পরিণত করেছে। তবে সবুজ উৎপাদন মানেই যে অকৃত্রিম জৈব উৎপাদন নয় তা নিয়ে এখন অনেক গবেষকই প্রশ্ন তুলছেন। পাঞ্জাবের ক্যান্সার ট্রেন দেখে এটাই ভাবনায় চলে আসে।

দুই নম্বর প্লাটফর্ম ছেড়ে যায় ক্যান্সার ট্রেন © Ed Hanley

প্রতিরাতেই বিকানেরের উদ্দেশ্যে ভাটিন্ডা ছাড়েন ৬০-১০০ জন ক্যান্সার রোগী আর প্রতিদিন ফরিদকোট হাসপাতালে ৩০-৩৫টি নতুন ক্যান্সার কেস আসে। তবুও জীবনের প্রয়োজনে ছুটে চলে মানুষ, বেঁচে থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, লড়াই করে বেঁচে থাকার আশায় বুক বেঁধে উঠে পড়ে ক্যান্সার ট্রেনে, যদিও জানে ভবিষ্যত অনিশ্চিত।

This article is in Bangla language and its about the train called Cancer train in Punjab, India. Locals call No. 339 by a chilling name — The Cancer Train. It routinely carries at least 60 cancer patients who make the overnight journey with their families to the town of Bikaner for treatment at the government's regional cancer center. People say they never used to see so many cancer patients in this farm region.

References: 

1. National Public Radio (In Punjab, Crowding Onto The Cancer Train), Author - DANIEL ZWERDLING, Date - May 11, 2009

2. Times of India (A train ride to cancer care), Author - NANDITA SENGUPTA, Date -  Aug 16, 2011

3. The Business Insider India (The shocking tale of India's 'Cancer Train'), Author - POULOMI DAS, Date- JUN 10, 2016

Feature Image: orientrailjourneys.com

Related Articles