Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডাবের পানি: সুস্বাস্থ্যের জাদুর পানি

কোন সে ফল
কঠোর খোলস, ভেতর কোমল?
পিপাসা মেটায়, পেটও ভরায়
গুণে তাহার জুড়ি নাহি হয়-
এমন ফলের নাম বলো তো ভাই?

এতক্ষণে বুঝতে নিশ্চয় পেরেছেন এখানে কোন ফলের কথা বলা হয়েছে? হ্যাঁ, ডাব। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সবচেয়ে পরিচিত ফলের অন্যতম হলো ডাব। ডাবের ভেতরে যে সুমিষ্ট পানীয় থাকে, সেটি যুগ যুগ ধরে সবচেয়ে উত্তম ও পুষ্টিগুণে ভরপুর প্রাকৃতিক পানীয় হিসেবে মানুষের কাছে স্থান পেয়ে আসছে।

উষ্ণপ্রধান সামুদ্রিক অঞ্চলে ব্যাপক পরিমাণে জন্মায় ডাব বা নারিকেলের গাছ। এই ফল থেকে সারা বছর পাওয়া যায় ভিটামিন, খনিজ উপাদান, শর্করা, অ্যামিনো এসিড সহ অন্যান্য উপাদানে ভরপুর পানীয়। গ্রীষ্মের এই প্রচণ্ড তাপদাহে যখন সবাই গলা ভেজানোর কিছু খোঁজে, আমাদের পাঠকরা যেন নিশ্চিন্তে সবচেয়ে নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর আর শক্তিবর্ধক এই পানীয়টি বেছে নিতে পারেন- এই আশাতেই ডাবের পানির উপকারিতা নিয়ে আজকের এই লেখাটি সাজানো হয়েছে।

বিভিন্ন পুষ্টিগুণে পূর্ণ এই পানীয়; source: booking.com

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, এনজাইম, অ্যামিনো এসিড, ভিটামিন বি, সি, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাংগানিজ, জিংক সহ আরো অনেক উপাদানে ভরপুর এই ফলটি। গাছের কচি ফল থেকে পানি- শাঁসে পরিপূর্ণ ডাব হতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ থেকে সাত মাস।

পাঁচ মাসের কম বয়সী ডাবের পানিতে কোনো পুষ্টি উপাদান থাকে না। আবার এই সময়ের চেয়ে বেশি বয়সী ডাবে ভেতরের শাঁসের জন্য পানির পরিমাণ কম হতে থাকে। ডাবের পানির এত পুষ্টি উপাদান থাকলেও এতে চিনির পরিমাণ কিন্তু অন্য যেকোনো ফলের রস বা কৃত্রিম পানীয়ের তুলনায় অনেক কম থাকে, প্রায় নেই বললেই চলে। তাই সকল বয়সী মানুষের জন্যই তৃষ্ণা মেটাতে এটি নিঃসন্দেহে প্রকৃতি প্রদত্ত এক দারুণ পানীয়। এমনকি ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্যও এটি উপকারী প্রমাণিত হয়েছে।
প্রচণ্ড গরমে যখন শরীর পানির নিদারুণ চাহিদায় ভোগে, তখন ডাবের পানির মতো উপকারী আর কী হতে পারে? শরীরের পানির চাহিদা পূরণের সাথে সাথে ক্লান্ত দেহে শক্তি ফিরিয়ে দিতেও কাজ করে এটি। এই পানিতে থাকা পর্যাপ্ত শর্করা তাতে ভূমিকা রাখে। এছাড়া গরমের কারণে হওয়া ডায়রিয়া, বমি ও হজমের সমস্যাতেও শরীরের জন্য খুবই ভালো এই পানি। পাকস্থলির হজম প্রক্রিয়া সহজ করে এটি।

রক্তচাপ কম রাখতে

ভিটামিন সি, পটাসিয়াম আর ম্যাগনেসিয়াম জাতীয় উপাদানের জন্য ডাবের পানি রক্তচাপ কম রাখতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে। এর পটাসিয়াম হৃদযন্ত্রের ওপর সোডিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাব কাটাতে সাহায্য করে, যার ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ২০০৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিয়া মেডিকেল জার্নাল নামক এক স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা পত্রিকার পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ডাবের পানি অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আর মানসিক চাপও নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য এরকম ভালো পানীয় আর কী হতে পারে?

হৃদযন্ত্রের সুরক্ষায়

হৃদযন্ত্রের সুরক্ষার একটি প্রাকৃতিক টনিক হলো এই অতি সাধারণ ডাবের পানি। কোলেস্টেরল ও চর্বিমুক্ত এই পানীয় দেহের ক্ষতিকর চর্বি কমায়, আবার অন্যদিকে উপকারী স্নেহজাতীয় উপাদানের বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। সেই সাথে এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অপ্রদাহী উপাদান ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।

রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা কমাতে

অ্যালকোহলের নেশা কাটাতেও দারুণ কাজ করে ডাবের পানি। অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণের ফলে দেহে পানির যে ঘাটতি তৈরী হয়, প্রথমত তা পূরণ করে দেহের জলীয় ভারসাম্য বজায় রাখে। আবার নেশাগ্রস্থ ব্যক্তি হঠাৎ অ্যালকোহল পান না করলে যে ক্লান্তি সৃষ্টি হয়, ডাবের পানি তা কাটাতেও ভূমিকা রাখে। ডাবের পানির সাথে দুই বা তিন টুকরা কাঁচা আম, দুই বা তিন টেবিল চামচ লেবুর পানি, দুটি তাজা পুদিনা পাতা আর অর্ধেক কাপ বরফের মিশ্রণে তৈরী পানীয়, কিন্তু অ্যালকোহলে অভ্যস্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্য রক্ষায় ও হজম প্রক্রিয়া ভালো রাখতে প্রাকৃতিক ওষুধের কাজ করে।

এদেশের সর্বত্র বেশ সহজলভ্য এই ফল; source: gardeningknowhow.com

 ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান? মাঝেমধ্যে ডাবের পানি পান করুন। ওজন কমানো ছাড়াও ডাবের পানি শরীরে অতিরিক্ত পানি জমতে দেয় না এবং দেহ থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। মাইগ্রেন সংক্রান্ত মাথাব্যথা নিয়ন্ত্রণেও ডাবের পানি প্রকৃতির আশীর্বাদ। মাইগ্রেনের রোগীরা সাধারণত ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে ভোগেন এবং তাদের শরীরে পানিশূন্যতাও দৃশ্যমান। উভয় ক্ষেত্রেই যে ডাবের পানি কত সমৃদ্ধ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিডনির সুরক্ষায়

কিডনিতে পাথর জমতে না দেওয়া ডাবের পানির অসাধারণ স্বাস্থ্যোপকারিতাগুলোর একটা। কিডনিতে স্ফটিকজাতীয় পদার্থের উপস্থিতির ফলে কিডনিতে পাথর জমা হওয়ার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। এই স্ফটিকজাতীয় পদার্থ মূত্রত্যাগের মাধ্যমে দেহের বাইরে চলে যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ডাবের পানি কিডনি থেকে এই জাতীয় পদার্থ বের করে আনতে যথেষ্ট কার্যকর একটি পানীয়।

হাড় ও পেশীর গঠনে

হাড় ও পেশীর সুরক্ষার কথা ভাবলেও কিন্তু মাঝেমধ্যে অতি সাধারণ এই ডাবের পানির কোনো বিকল্প নেই। হাড়ের জন্য ক্যালসিয়াম অতি দরকারি হলেও আরো কিছু উপাদান প্রয়োজন হয় হাড় মজবুত ও ঘনত্ব ঠিক রাখতে। এই প্রয়োজনীয় উপাদানের অনেকগুলো দ্বারাই সমৃদ্ধ থাকে ডাবের পানি। এছাড়া ডাবের পানির ক্যালসিয়াম হাড় মজবুত করে এবং এতে উপস্থিত ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধিসহ অন্যান্য কাজে অংশ নেয়। পেশী গঠন ও সচল রাখতেও কাজে দেয় ডাবের পানির পটাসিয়াম। আর বদহজম, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রেখে হজম ক্রিয়া ভালো রাখতে এর উপকার? এই একটা কথাতেই এর উত্তর দেওয়া যায় যে, দেহের দৈনিক প্রয়োজনীয় মোট ফাইবারের শতকরা প্রায় ৯ ভাগ পর্যন্ত এই পানীয় থেকে পূরণ হতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ভূমিকা রাখে এই পানি।

সকল বয়সের জন্যই ডাবের পানি দরকারি; source: onegreenplanet.org

পিএইচ এর সামঞ্জস্য রক্ষায়

পরিবেশে থাকা অনেক রাসায়নিক ও বিষাক্ত উপাদান আমাদের শরীরের পিএইচ মাত্রার অসামঞ্জস্য সৃষ্টি করে, আর তা ডেকে আনে হাড়ের সংযোগস্থলের ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক, মুটিয়ে যাওয়া, ডায়াবেটিস, বুক জ্বালাপোড়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়াসহ আরো অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যা। ডাবের পানি শরীরে এই পিএইচ মাত্রার সামঞ্জস্য ধরে রাখে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং দেহে টিউমারের সৃষ্টি রোধ করতে কাজ  করে, এমনকি ক্যান্সারের চিকিৎসায় যে কেমোথেরাপি দেওয়ার ফলে যে ক্ষতি হয়, তা পূরণেও সাহায্য করে ডাবের পানি।

চোখ আর মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী এটি। প্রতি কাপ ডাবের পানিতে প্রায় ০.৭ গ্রাম থায়ামিন থাকে। দুই কাপ ডাবের পানি চোখের জন্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ১.৪ গ্রাম ভিটামিন বি এর চাহিদা সম্পূর্ণ পূরণ করে। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা পালন করে ডাবের পানি।

মা ও শিশুর জন্য

গর্ভবতী ও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও প্রকৃতির এক অতুলনীয় দান এই শক্ত খোলসের ফলটি। গর্ভকালীন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা কাটাতে সাহায্য করে এই পানি, তার মধ্যে আছে সকালের অস্বস্তি, বমি বমি ভাব, মাংসপেশিতে টান ইত্যাদি। আবার বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদেরও পরামর্শ দেওয়া হয় নিয়মিত ডাবের পানি খাওয়ার জন্য। এটি বুকের দুধে রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান বৃদ্ধি করে।

গর্ভবতী নারীদের জন্য আশীর্বাদ পানীয়; source: dinaris.org

এমনি আরো অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতায় পূর্ণ মানুষের প্রতি স্রষ্টার দেওয়া এই দারুণ উপহার। এর উপকারিতার গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়। কৃত্রিম কোমল পানীয়ের তুলনায় এ যেন এক জাদুর পানি! প্রচন্ড গরমে ডাবের ঠাণ্ডা পানি দেহ ও মন দুটোই জুড়িয়ে তোলে, শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় মানুষের তাপদগ্ধ শ্রান্ত জীবনে।

ফিচার ইমেজ: q8rashaqa.com

Related Articles