চিকিৎসাবিজ্ঞানের দুর্লভ কিছু অসুখের মধ্যে অন্যতম কোটার্ড সিনড্রোম। এতটাই দুর্লভ এই সমস্যা যে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে বিশেষ বিশেষ রোগীর বর্ণনাই কেবল আমাদের তথ্যের মূল উৎস। রোগ নিয়ে বড় আকারে গবেষণা সুযোগ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
কিন্তু কি এই কোটার্ড সিনড্রোম? এটি মূলত মস্তিষ্কের অসুখ, যেখানে রোগীর মধ্যে ভ্রান্ত কিছু ধারণা উৎপত্তি হয়। রোগী নিজের শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গের অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সবাই দেখতে পাচ্ছে রোগীর দুহাতই সুস্থ সবল, কিন্তু রোগী নিজে বলতে থাকেন তার বাম বা ডান হাত নেই। সেই হাতে কোন অনুভূতিও পাননা তিনি।
চরমক্ষেত্রে রোগী এমনকি নিজের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসতে পারেন। তার বয়ানে তিনি মৃত, এই পৃথিবীতে তার কোন অস্তিত্ব নেই। কেউ কেউ তো মৃত মানুষের পচনশীল দেহের গন্ধ পেতে থাকেন। এজন্য কোটার্ড সিনড্রোমের আরেক নাম “Walking Corpse Syndrome”।
উৎপত্তি
কোটার্ড সিনড্রোম নিশ্চয় বহু আগে থেকেই ছিলো, তবে বিজ্ঞানের নজরে প্রথম এর আবির্ভাব ১৭৮৮ সালে। যুক্তরাজ্যের চিকিৎসক ডঃ চার্লস বনেট প্রথম এর সন্ধান পান।
বনেটের কাছে এসেছিলেন এক বৃদ্ধা মহিলা। তিনি খাবার তৈরি করার সময় হঠাৎ শরীরের একপাশ অবশ হয়ে যায়। কিছুসময় পর অবশভাব কেটে গেলে তিনি মেয়েদের বলেন তাকে উপযুক্ত কাপড় পড়িয়ে কফিনে শুইয়ে দিতে।
প্রথমে মেয়ে আর আত্মীয়স্বজনেরা তার কথাকে সাময়িক প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু বৃদ্ধা দিনের পর দিন একই কথা বলতে থাকেন, তিনি মৃত, তাকে যেন কবরে রেখে আসা হয়। আত্মীয়রা শেষ পর্যন্ত তাকে ঠাণ্ডা করতে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করল।কিন্তু “মৃত” মহিলা সেখানেও নানা অনুযোগ করতে থাকেন, যে কাপড় পড়ানো হয়েছিল তার রঙ পছন্দ হয়নি তার।
মহিলা অবশেষে ঘুমিয়ে পড়লে পোশাক পাল্টে তাকে বিছানায় শুইয়ে দেয় পরিবার। এরপর ডাক্তারকে খবর দেয় তারা। বনেট কিছু পথ্য দিয়ে চিকিৎসা করার পর তার সমস্যা দূরীভূত হয়েছে বলে মনে হয়, তবে মাসখানেক পরেই তা ফিরে আসে।এই ঘটনাই বনেট বর্ণনা করেছিলেন।
কিন্তু কোটার্ড সিনড্রোম নাম কেমন করে এলো? এই নাম ফরাসী চিকিৎসক জুলস কোটার্ডের নামানুসারে। বনেট প্রথমে কোটার্ড সিনড্রোম সনাক্ত করলেও তিনি এর কোন নাম দেননি। পরবর্তীতে ১৮৮০ সালে জুলস কোটার্ড যখন একই রকম রোগী পেলেন তিনি এর নাম দেন “নেতিবাচক বিশ্বাসে’র রোগ” ('delire de negation')। তার মৃত্যুর পর যা কোটার্ড সিনড্রোম নামে পরিচিতি পায়।
জুলস কোটার্ডের রোগী ছিলেন এক ৪৩ বছর বয়স্ক ভদ্রমহিলা। তিনি ডাক্তারের কাছে এসে জানান তার কোন মগজ, স্নায়ু, বুক, পেট কিচ্ছু নেই। কেবল পচতে থাকা দেহে চামড়া আর হাড়। মহিলার দাবি ছিলো তার আত্মা, ঈশ্বর, শয়তান কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
ভদ্রমহিলা বলেন যেহেতু তিনি মৃত তার খাদ্যগ্রহণ অপ্রয়োজনীয়।তার পক্ষে স্বাভাবিক মৃত্যু দ্বিতীয়বার সম্ভব নয়, একমাত্র উপায় পুড়িয়ে ছাই করা। কেবল আগুনের মাধ্যমেই মুক্তি পেতে পারেন তিনি।
রোগের বৃত্তান্ত
এখন অবধি মাত্র ২০০ রোগীর কোটার্ড সিনড্রোম আছে বলে সনাক্ত হয়েছে।ফলে খুব সামান্যই জানা গেছে কোটার্ড সিনড্রোম নিয়ে। ধারণা করা হয় যেকোন বয়সেই এই রোগ হতে পারে, তবে বেশিরভাগ রোগীই পঞ্চাশোর্ধ্ব।
এই রোগীরা যে সবসময়েই নিজেদের মৃত বলে দাবি করেন তা কিন্তু নয়। অনেক সময় তারা অদৃশ্য কণ্ঠ শুনতে পান, যা তাদেরকে মৃত বলে বর্ণনা করে। অনেকে একেবারেই কথাবার্তা বন্ধ করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। কোন কোন ব্যক্তি খাওাদাওয়া ছেড়ে দেন, এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ক্ষতি করার চেষ্টাও করেন কেউ কেউ।
বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন মানসিক অন্যান্য কিছু রোগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কোটার্ড সিনড্রোম দেখা যেতে পারে। এগুলির মধ্যে অন্যতম সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, মস্তিষ্কে টিউমার, মস্তিষ্কে রক্তপাত, উচ্চমাত্রায় শক্তিশালী মাদক সেবন ইত্যাদি।
কোটার্ড সিনড্রোমের কিছু উদাহরণ
১৯৯৬ সালে এক এক স্কটিশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েন। মাথায় আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাকে। সেরে ওঠার পর তার মধ্যে ধারণা হলো আসলে তিনি মারা গেছেন। এরপর তার মা ছেলেকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা চলে যান। সেখানে চিকিৎসকদের কাছে তিনি একই কথা বলেন, দাবি করেন দক্ষিণ আফ্রিকার গরম আবহাওয়ায় তার বিশ্বাস জন্মেছে তিনি আসলে নরকে আছেন, কেবল নরকই এতো গরম হতে পারে।
গ্রীসে ২০০৩ সালে চিকিৎসকেরা এক অদ্ভুত রোগীর সন্ধান পান। রোগীর ধারণা তার মাথার ভেতর ফাঁপা, হাড়-মগজ কিছুই নেই। আত্মহত্যার চেষ্টা করতে গেলে পরিবারের লোকেরা তাকে ধরেবেঁধে নিয়ে আসে। প্রশ্নের উত্তরে সে জানায় যেহেতু তার মগজ নেই তাই বেঁচে থাকার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা সে। সেবছর তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও পরের বছর আবার সে ফিরে আসে।এবার চিকিৎসা করা হলে বেশ সুস্থ হয়ে ওঠে সে।
২০০৫ সালে ইরানের একদল চিকিৎসক ৩২ বছরের এক রোগীর কথা জানান। এই ব্যক্তি হাসপাতালে এসে বলেন যে তিনি শুধু মারাই যাননি, মৃত্যুর পর পরিবর্তিত হয়েছেন কুকুরে। এমনকি তার স্ত্রী’ও নাকি সেই দুর্ভাগ্য বরণ করেছেন। তার তিন কন্যাও মৃত, এবং প্রত্যেকে রূপান্তরিত হয়েছেন ভেড়ায়।
রোগী এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে বিষ দেয়ার অভিযোগ তোলেন তিনি। তবে ঈশ্বরের ইচ্ছায় তিনি মৃত হলেও তার কোন ক্ষতি হয়নি বলে দাবি করেন। চিকিৎসকেরা তাকে বৈদ্যুতিক শক চিকিৎসা (electro-convulsive therapy) দেন। অধিকাংশ সমস্যা এরপর সেরে যায়।
নিউ ইয়র্কের মনঃচিকিৎসকেরা ২০০৮ সালে এক রোগীর কথা রিপোর্ট করেছিলেন। লি তার পরিবারকে অনুরোধ করছিলেন তাকে মর্গে রেখে আসতে। তারা জরুরী নাম্বারে কল দিয়ে সাহায্য চাইলে প্যারামেডিকরা হাজির হয়। মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে তারা।
লি নামে সেই ভদ্রমহিলা চিকিৎসকদের জানান তিনি মরে গেছেন এবং তার দেহ পচতে শুরু করেছে। নাকে সেই গন্ধ পাচ্ছেন তিনি।তিনি অভিযোগ করেন যে লোকেরা তাকে হাসপাতালে এনেছে তারা তার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। প্রায় এক মাস চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয়েছিলেন তিনি।
২০০৯ সালে এক ৮৮ বছরের এক বেলজিয়ান বৃদ্ধ হাসপাতালে আসেন। তার বিষণ্ণতার সমস্যা আগে থেকেই ছিলো। তিনি জানালেন এই সমস্যা আরো বেড়ে গেছে, কারণ তিনি মৃত্ কিন্তু কেউ তাকে কবর দিচ্ছেনা!
চিকিৎসা
কোটার্ড সিনড্রোমের কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। যদি অন্তর্নিহিত কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে তার চিকিৎসা দিলে রোগী সুস্থ হতে পারেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক শক বা ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি শেষ চেষ্টা হিসেবে দেয়া হয়। তবে রোগমুক্তির কোন গ্যারান্টি নেই।
This is a Bengali language article about Cotard’s syndrome. This article describes some interesting facts and cases of Cotard’s Syndrome.
References
- Sahoo ABS & Josephs KA (2018). Neuropsychiatric Analysis of the Cotard Delusion. The Journal of Neuropsychiatry and Clinical Neurosciences; 30:58-65.
- Paknikar, s. (2020). Walking Corpse Syndrome: Symptoms, Signs, Diagnosis & Treatment.
- Kudlur SNC, George S, & Jaimon M. () M.S.An overview of the neurological correlates of Cotard syndrome. The European Journal of Psychiatry; 21(2).
- Cotard’s syndrome.
- What Is Cotard's Syndrome (Walking Corpse Syndrome)?
- Cunha, JP (2020). What Are the Symptoms of Walking Corpse Syndrome?
- Soniak, M. (2013). 10 Case Reports of Cotard’s Delusion.
- https://www.mentalfloss.com/article/50197/plight-living-dead-10-case-reports-cotard’s-syndrome
- Huarcaya-Victoria J, Ledesma-Gastañadui M& Huete-Cordova M. (2017). "Cotard’s Syndrome in a Patient with Schizophrenia: Case Report and Review of the Literature", Case Reports in Psychiatry.
Feature Image: indianapublicmedia.org